অপালার ডায়েরি
___নাহিদ ফারজানা সোমা
ধারাবাহিক গল্প(৫ম পর্ব)
কে এই অপালা? এখন কতো বছর বয়স? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়তো এটা বুঝা গেছে, কিন্তু কোন শিক্ষাবর্ষ? দরকার হয় ঢাকা ভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে খোঁজ নিবো। কিন্তু অপালা যদি শুধুই ওর ডাক নাম হয়? মেয়েটা আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। রোগটাকে আমি হারাতে পারিনি, অপালা কি পেরেছে? কি জানি! সব না পড়লে কি ভাবে বুঝবো? জিতে যায় যেন অপালা, পরাজিত করতে পারে যেন অসহনীয় যন্ত্রণাময় রোগটিকে।
অপালার ডায়েরি
………………………
আমি এখন চোর। কয়েকদিন আগে আমি প্রথম চুরি করেছি। তাজিনের পার্স থেকে তিন হাজার টাকা। পার্সটা টেবিলে ফেলে রেখে সে দৌড়ে ঢুকেছিল ওয়াশরুমে। পার্সটা নয় মাসের গর্ভবতীর মতো ফুলে ছিল টাকা দিয়ে। সবসময় তেমনি থাকে। পার্সটার চেইনটাও খোলা। ঘরে দ্বিতীয় কেউ নেই। নিয়ে নিলাম তিন হাজার টাকা। বুকটা ধড়ফড় করছিলো।
তাজিন টেরও পায়নি। পরের দিন এক হাজার তুলে নিলাম একই পার্স থেকে। আশ্চর্যের ব্যাপার,পারফেকশনিস্ট এই আমির কোনো অনুশোচনা বা লজ্জা হচ্ছে না। কেন? কেন? চুরি করাটা আমার মন জায়েজ করে নিলো কেন? কেন মন বলছে চুরি নিয়ে ভাবার দরকার নেই, চুরির ব্যাপারটা মাথায় রেখো না?
নিজেকে একটু নির্ভার লাগছে। টাকা নিয়ে আর পেরেশানি নেই। বিবেকও কষ্ট দিচ্ছে না। সেদিন রাতে আদিবকে নিয়ে ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি খেয়েছি। রিক্সাতে ঘুরে বেড়িয়েছি। হোটেল রাজ্জাকে যেয়ে ফালুদা খেয়েছি। আদিবকে বড় একটা হরলিক্স আর এক কেজি আপেল কিনে দিয়েছি ওর তীব্র আপত্তি স্বত্বেও। আদিব বললো,” তোমার কাছে তো আর একটা পয়সাও বোধ হয় নেই, ছোট আপা। তুমি কিছু টাকা রাখো।” আমি আদিবকে আশ্বস্ত করলাম, আমার কাছে টাকা আছে, বরং ওর লাগলে ও যেন আমাকে বলে।
চুরি করা আমার নেশা হয়ে গেলো। নিজের রুমমেটদের ব্যাগ থেকে, অন্যান্য রুম থেকে, সুযোগটা শুধু পেলেই হলো। আগে সহজে কারোর রুমে যেতাম না, এখন পড়াশোনার ছলে,নোট দেয়া নেয়ার নাম করে এই রুম-ওই রুমে যাই,বুদ্ধি করে চুরি করি। সেদিন নায়লার টেবিলে দেখলাম সোনার চেইন আর আংটি। আমি তুলে নিলাম। অনেক দূরের একটা সোনার দোকানে যেয়ে ওগুলো বিক্রি করে দিলাম। পঁচাশি হাজার টাকা হলো। টাকাটা হজম করি কিভাবে? কিছুদিন আগে একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছি। কেউ জানেনা। আশি হাজার জমা দিলাম। তারপর ক্লান্ত শ্রান্ত মুখ করে হলে ফিরলাম।
রুমে তখন তুমুল হৈচৈ। তাজিন বলছে,”হয়তো তুই অন্য কোথাও রেখেছিস।ভালো করে খুঁজে দেখ্। এখান থেকে নেবে কে?”
মৌরি বললো, “সেদিন আমার পার্স থেকে এক হাজার উধাও। ”
“কই,বলিসনি তো?”
“বলিনি,কারণ ভাবছিলাম আমিই বোধহয় ভুল করছি। এখন তো মনে হচ্ছে সত্যি আমার টাকা চুরি গেছে। হলে চুরির উপদ্রব তো ছিলো না।”
আমি এগিয়ে যেয়ে নায়লাকে বললাম,”কি হয়েছে নায়লা? কি হারিয়ে গেছে তোমার?”
“হারিয়ে যায় নি, চুরি হয়েছে। একটা এক ভরি গলার হার,মোটা একটা আংটি। ”
আমি আঁতকে ওঠার দারুণ অভিনয় করলাম।
নেত্রীদের কানে কথাটা গেছে। তারা এসেছে তদন্ত করতে। আমাদের সবার ট্রাংক,বাক্স পেট্রা হাতানো হলো। এমনকি কুমকুম আপা মেয়েদের জামার মধ্যেও হাত গলিয়ে দিলো। বাজখাঁই গলায় বললো,”যে চুরি করেছিস,ভালোই ভালোই দিয়ে দে। নইলে সবার প্যান্টি খুলে চেক করবো,প্রমিজ।”
অনেক তল্লাশি হলো। অনেক প্রশ্ন -উত্তর পর্ব চললো। ঘটনার সুরাহা হলোনা।
আমি কিছু দিন চুপচাপ থাকলাম। আমার জামাকাপড় বড্ড সাধাসিধে, মফস্বলের দর্জির বানানো, দেখতে তেমন সুবিধার নয়। পুরানো ডিজাইন। এটা নিয়েও সবাই হাসাহাসি করে। বলে,”এবারে ক্ষ্যান্ত দে মা। এই কামিজগুলো দিয়ে চেয়ার টেবিল মোছ্। এতো লম্বা ঢোলা কাপড় কেউ পরে?তুই ঢাকা ভার্সিটির ইকোনোমিকসের স্টুডেন্ট। দেখলে তা মনে হয় না। এই রকম গেট আপ দিয়ে কারোর মন জয় করতে পারবি না ইয়ার। চাকরি বাকরিও জুটবে না। ইদানিং চাকরি বাকরিতে ড্রেস আপ,গেট আপ ভীষণ ইম্পরট্যান্ট, সেই সাথে স্মার্টনেস আর ফ্লুয়েন্টলি ইংলিশ। দিনে পাঁচ বার জায়নামাজে ঢিপঢিপ করলেই আল্লাহ চাকরি জুটিয়ে দিবেন না।”
এসব কথা ভর্তি হওয়ার পর থেকে শুনে আসছি। ” এমন প্রিন্টের জামা কেউ পরে? ইয়াল্লাহ, কি কটকটে রঙের সোয়েটার। এই বিছানার চাদর বিছানো চলবে না,পুরো রুমের সৌন্দর্যের বারোটা বেজে যাবে। তোর স্যান্ডেলগুলা ফেলে দে তো অপালা, বুয়ারাও এগুলো পরবে না। দুই স্যান্ডেলে চালালি তো দেড় বছর।”
ইদানিং আমার সুন্দর সুন্দর জামা পরতে ইচ্ছা হয় আর সবার মতো, সাথে মানানসই ব্যাগ, জুতা, লিপস্টিক। আমার বাবা-মা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। কতো টাকাই বা বেতন পান? দু’জনের কেউই অংক,ইংরেজি , বিজ্ঞান এসব সাবজেক্টের টিচার না। কাজেই ছোটখাটো মফস্বলে তাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়তে কেউ আসে না বললেই চলে। চালটা দাদার বাড়ির জমি থেকে আসে। এতো কম আয় উপার্জন দিয়ে বাবা-মা আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে পড়িয়েছেন। আমরা পাঁচ জনই খুব মেধাবী। সরকারি স্কুল-কলেজে পড়ায় বেতন খুবই কম লেগেছে। আমরা এসএসসি পর্যন্ত কেউ প্রাইভেট পড়িনি। বাবা-মা পড়াতেন। কোথাও না বুঝলে বাবা-মায়ের অনুরোধে তাঁদের কলিগরা যেমন অংকের সুরেন্দ্র স্যার, বিজ্ঞানের সালমা আপা, মালা দিদি, ইংরেজির স্বপন স্যার আমাদের বিনা পয়সায় বুঝিয়ে দিতেন। কলেজে উঠে আমরা সব ভাইবোন টিউশনি করেছি আর সেই টাকায় প্রাইভেট পড়েছি। মায়ের ভালো শাড়ি চার পাঁচটা। জর্জেট। বিয়ের কাতান শাড়ি ইঁদুর কেটে ফেলেছে। ঘরে মা ম্যাক্সি পরেন। তিন-চারটা ম্যাক্সি, ওড়না। সারাজীবন মায়ের সাজ বলতে পরিপাটি করে চুলে বেণী বা খোঁপা বাঁধা, সোনার একটা ছোট্ট নাকফুল, গলায় আটআনা সোনার হার, বাম হাতে খুব সাধারণ একটা ঘড়ি। বাইরে পরার অতি সাধারণ স্যান্ডেল একজোড়া, লিপস্টিক একটা, কাজল একটা। এই সম্পদেই মা সবসময় পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন, ফিটফাট। আমাদের তিন কামরার বাড়িতে দেয়ালে কখনো ঝুল থাকে না, মেঝে ঝকঝকে পরিস্কার, বিছানার চাদর টানটান,সব মায়ের কল্যাণে। এতোটুকু বিলাসিতা নেই আমাদের ছোট্ট বাড়িটাতে। বাবা-মা আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে পুষ্টিকর খাবার খাইয়েছেন, সব্জি খিচুড়ি, নইলে ভাত, শাক, সব্জি, ছোট মাছ, ডাল, ঘরে বানানো মোয়া,সুজি, পায়েস ইত্যাদি। ডিম,বড় মাছ বা মাংস কম খাওয়া হয়। বাড়ির সামনে এক চিলতে বাগানে বাবা-মা শাকসবজি লাগান। আমাদের পরিবারের কারোর টাচ মোবাইল নেই। বাবা-মা আমাদের খাওয়া আর লেখাপড়ার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন,আর নজর রাখেন নামাজ,রোজা, স্বভাব চরিত্রের দিকে। গল্পচ্ছলে মা আমাদের সংযমের শিক্ষা দিয়েছেন, নির্লোভ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। আর তাঁদের মেয়ে কিনা চোর।
ঈদে মিলাদুন নবী, হলে মিলাদ হবে, চাঁদা দাও। বিদ্যা দেবী স্বরস্বতীর আরাধনা, হলেও, কেন্দ্রীয় ভাবেও,চাঁদা দাও, বন্যার্তদের জন্য চাঁদা দাও, ভার্সিটির একজন ছাত্রের ক্যান্সার,চাঁদা দাও। দাও,দাও,দাও। চারিদিকে শুধু দাও। কিন্তু যা দেওয়া হয়, তা কোন কোন খাতে খরচ হলো,তা জানার অধিকার আমাদের নেই।
অঞ্জন থেকে কচি কলাপাতা রঙের সুন্দর একটা ড্রেস কিনলাম। পারসোনায় যেয়ে হেয়ার ট্রিটমেন্ট, ফেসিয়াল, পেডিকিওর, ম্যানিকিওর করালাম। সুন্দর করে চুল কাটালাম, ভুরু প্লাক করালাম। সুন্দর দেখে একজোড়া স্যান্ডেল, তিনটা লিপস্টিক , ভালো একটা শ্যাম্পু, দামী বিদেশি সাবান, দারুণ মিষ্টি গন্ধের ব্র্যান্ডের ক্রিম কিনলাম। হলে যাওয়ার পরে সবাই চরম বিস্মিত। মলিন মুখ করে বললাম, “ছাত্রীর মা দিয়েছেন। এই ড্রেস , ক্রিম আর লিপস্টিক। মেয়ে পরীক্ষায় খুব ভালো করেছে,তাই ড্রেসটা। উনার বোন বিদেশ থেকে এসেছেন, সেখান থেকে ক্রিম,শ্যাম্পু, সাবান আর লিপস্টিক। স্যান্ডেল আমিই কিনলাম।”
“বাপরে বাপ। তোর স্টুডেন্টের মা দেখি দাতা হাতেম তাই। পার্লারেও গিয়েছিলি নাকি? ”
” হ্যাঁ। মনটা খুব খারাপ। অল্প কিছু টাকা জমেছিলো, পার্লারে যেয়ে চুল কাটালাম, ভুরু প্লাক করালাম। ”
“চুলগুলো তো ঝলমল করছে, মুখও চকচকে। আরও কিছু করেছিস নাকি?”
“না রে, আর কিছু না।”
“কোন পার্লারে গিয়েছিলি?”
“ছাত্রীর বাসার কাছেই একটা ছোটখাটো পার্লার।”
“ড্রেসটা পর দেখি।”
“কাল গোসল করে পরি?আজ এই ঘামে ভেজা গায়ে পরতে ইচ্ছা করছে না।”
অনেক রাতে ডায়েরি লিখলাম।
মিথ্যা ঃ অনেক মিথ্যা বলেছি। পাশে অনেক বড় ক্রস চিহ্ন। মনটা অসম্ভব খারাপ ও অস্হির। এই ক’দিনে বড় বড় কিছু চ্যাপ্টার পড়েছিলাম, কোরান শরীফ প্রথম হতে পড়া শুরু করেছিলাম অর্থ সহ। আজ মিথ্যা বলায় আগের সব অর্জন বরবাদ হয়ে গেলো। আগামীকাল হতে সব আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
ফজরের নামাজের পরে আড়াই ঘন্টা সময় নিয়ে গোসল করে নতুন জামাটা পরে মনটা ভালো হয়ে গেলো। হেয়ার কাটটা মানিয়েছে বেশ। বাহ্,আমি তো বেশ সুন্দর। লিপস্টিকটা লাগানোর পরে সৌন্দর্য শতগুণে বেড়ে গেলো। আমার সৌন্দর্যে আমি নিজেই অভিভূত হয়ে গেলাম।
আমাকে ঘিরে বড় জটলা। সবার চোখে মুগ্ধতা। “তুই তো দেখতে দারুণ সুন্দর। এই হেয়ার কাটিংএ আর ভুরু প্লাক করে তোকে তো দারুণ দেখাচ্ছে। আর কি হয়ে থাকতিস। উদ্ভট জামা কাপড়, টেনে চুল বাঁধা, ঝোপের মতো ভুরু! পুরানো জামাকাপড় সব ছুঁড়ে ফেলে দে আজকে। কয়েক সেট নতুন ড্রেস কিনে ফেল্। ”
বিষন্ন হাসি হেসে বললাম,”আমার সামর্থ্যের কথা জানো তো তোমরা। নেহায়েত একজন কিছু জিনিস ভিক্ষা দিয়েছেন। ”
ইস্! মিথ্যা বলা হয়ে গেলো। আজকের দিনটাও নষ্ট হয়ে গেলো। মন ভালো ভাব মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো।
“এই জামার সাথে এই ব্যাগ একেবারে যাচ্ছে না। নতুন ব্যাগ লাগবে। এই ব্যাগটা নিস না অপালা।”
“কি করবো বলো? আমার গো একটাই ব্যাগ। ভালো ব্যাগ কিনতে হলে আরও দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে।”
“আমার একটা ভালো ব্যাগ ব্যবহার কর নতুন ব্যাগ না পাওয়া পর্যন্ত। ”
“না রে ইতু, এভাবে কি চলা যায়?”
“আচ্ছা, আজকের জন্য নে অন্ততঃ। ”
নিলাম। ব্যাগ আমি গতকালই কিনতে চেয়েছিলাম। একসাথে এতো জিনিস কিনলে কারোর সন্দেহ হতে পারে,তাই কিনি নি।
ঐ বিকেলে আমি আবার চুরি করলাম । আমাদের মুখোমুখি রুমের মেয়েটার ড্রয়ার আর তাজিন-ইতুর ব্যাগ থেকে। মোট আট হাজার। টাকাটা লুকিয়ে রাখলাম এমন জায়গায় যা মানুষের কল্পনাতেও আসবে না।
চলবে।
Hits: 9