বসন্তদিনের স্মৃতি
_____রবিউল করিম পলাশ
খোলা জানালা ভেদ করে সকালের মিষ্টি সোনারোদ বিপ্লবের চোখে মুখে এসে পড়তেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আড়মোড়া ভেঙ্গে সে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। চারিদিকে গাছে গাছে রঙিন ফুলের সমারোহ। রঙিন প্রজাপতি এফুলে ও ফুলে আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে কোকিলের কুহুতান। হঠাৎই যেন বাতাসে ভেসে এলো উর্মির রেশমী চুলের ঘ্রাণ। মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। বিপ্লব অবাক হয়ে ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। সে নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা যে উর্মি তাকে ফোন দিয়েছে। বিপ্লব ফোন রিসিভ করতেই উর্মির মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, শুভ সকাল। কেমন আছো? আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। বিপ্লব বলল, কি সারপ্রাইজ? উর্মি, আজ বিকেলে আমরা নদীর পারে দেখা করবো। বিপ্লব আশ্চর্য হয়ে মানে?এ কিভাবে সম্ভব! উর্মি তোমায় সারপ্রাইজ দেবো বলে জানাইনি। আমি এখন তোমার শহরে। গতকাল এসে এক আত্নীয়ের বাসায় উঠেছি। ধরে নাও, এটা তোমার বসন্তদিনের উপহার। বিপ্লব নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখে বলল, সত্যি জানো আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা।
উর্মি বিপ্লবের গার্লফ্রেন্ড। উর্মি অসাধারণ মনের একজন মানুষ। বিপ্লব এবং উর্মি দু’জন দু’জনকে খুব ভালোবাসে। তারা দু’জন দেশের দু’প্রান্তে থাকে। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে বিপ্লব চাকরির চেষ্টা করছে। আর উর্মির বিয়ের জন্য তার পরিবারের লোকজন উঠেপড়ে লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ হবার পর অনেকদিন উর্মির সাথে বিপ্লবের দেখা হয়নি। আজ তাই তাদের দু’জনার মনেই চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিপ্লব চট জলদি তার হলুদ পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামাটা আলমারি থেকে বের করে আয়রন করতে শুরু করে। এরপর সে ক্লীন সেভ করে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে ভালো করে গোসল সেরে নেয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। বিপ্লবের উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে তার হৃদস্পন্দন। হঠাৎ বিকেল চারটায় মোবাইলে উর্মির একটা ম্যাসেজ চলে আসে। তাড়াতাড়ি নদীর পারে চলে আসো, আমি বেশিক্ষণ তোমার সাথে থাকতে পারবোনা। আজ সন্ধ্যায় আমাকে আমার আত্নীয়ের বাড়িতে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।
বিপ্লব দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বাসার সামনে সে একটি রিক্সা পেয়ে যায়। ডাবল ভাড়া দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে দ্রুত নদীর পাড়ে যেতে বলে বিপ্লব। রিক্সাওয়ালা ডাবল ভাড়ার কথা শুনে হাওয়ার বেগে খুব দ্রুত নদীর পারে চলে যায়। নদীর পারে বিপ্লবকে রিক্সা থেকে নামতে দেখে উর্মি পাগলের মতো ছুটে যায় তার কাছে। দু’জন দু’জনার খুব কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। উর্মির মুখের দিকে বিপ্লব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে!পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের লাল আভা উর্মির সৌন্দর্যরূপ দ্বিগুণ করে দিয়েছে আজ। তার খোলা রেশমী চুল যেন শত সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ। উর্মির নীল টানা টানা ডাগর দু’টি চোখের দিকে তাকালে মনে হয় সারাটাজীবন পার হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ পর উর্মি বিপ্লবকে বলে উঠলো, কেমন আছো? বিপ্লবের কণ্ঠস্বর যেনো আজ রুদ্ধ হয়ে আসছিলো। সে তখনো ঘোরের ভেতর ছিলো। আদৌ সেকি জেগে আছে না স্বপ্ন দেখছিলো! বিপ্লব এতক্ষণে বলল, ভালো আছি। তুমি বড্ড রোগা হয়ে গেছো। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছোনা বুঝি? উর্মি হেসে উঠে বলল, ভালোবাসার মানুষের কাছে তার প্রিয় মানুষটাকে সবসময় রোগাই মনে হয় বুঝলে। ভালো করে তাকিয়ে দেখো, আমি অনেক মুটিয়ে গেছি।
বিপ্লব বলল, আমি সত্যি খুব দুঃখিত, তাড়াহুড়া করে চলে আসায় তোমার জন্য ফুল আনতে পারিনি। উর্মি তাতে কি হয়েছে। আমাদের দেখাটাত হয়েছে। তুমি খুশি হওনি? বিপ্লব মুচকি হেসে, আমি সত্যি বিশ্বাস করতে পারছিনা জানো। উর্মি, থাক ওসব কথা, চলো ফুচকা খাবো। উর্মির ফুচকা খুব প্রিয়। বিপ্লব ফুচকার দোকান থেকে ফুচকা এনে নদীর তীরে উর্মির পাশে বসে। উর্মি ফুচকা হাতে নিয়ে বিপ্লবকে আদর মাখা হাতে খাইয়ে দেয়। বিপ্লবও উর্মিকে নিজ হাতে ফুচকা খাওয়ায়। চারিদিকে যেন খুশির জোয়ার নেমে এলো।
সূর্য ডুবতে বসেছে। তারা নিজেদের মধ্যে খুব সুন্দর একটি সময় কাটাচ্ছিলো। এমন সময় হঠাৎ উর্মির মোবাইল বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করেই উর্মি উঠে দাঁড়ায়। ফোনে কথা,বলা শেষ করে উর্মি বলে, আমাকে এখন আত্নীয়ের বাসায় ফিরতে হবে। পাত্রপক্ষ কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। বিপ্লবের মুখে আঁধার নেমে আসে। সে উর্মিকে বাঁধাও দিতে পারছেনা। তারা দু’জন এখন বিয়ে করলে উর্মিকে সে শুধু কষ্টই দেবে। সে এখনও বেকার। টিউশনি করে যা পায় তার অর্ধেকটা দিতে হয় ছোট বোনটার লেখাপড়ার জন্য। রিটায়ার্ড বাবার সীমিত পেনশনে তাদের সংসারে টানাপোড়েন লেগে আছে। বিপ্লব উর্মির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার কন্ঠরূদ্ধ হয়ে আসে। উর্মি বিপ্লবের চোখে চোখ রেখে বিদায়বেলা বলে, ভালো থেকো। পারলে আমাকে ভুলে যেও। আমি বাবা-মা’র সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবোনা। উর্মির চোখের দিকে তাকিয়ে বিপ্লবের চোখ দু’টো ছলছল করে ওঠে। উর্মি কি যেন লুকিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায়।
বিপ্লব স্তব্ধ হয়ে উর্মির চলে যাওয়া দেখতে থাকে। সে মনে মনে বলে, আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? আমি কি চিরতরে কোন অমূল্য সম্পদ হারিয়ে ফেললাম? আমি এই যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়াবো কেমন করে..?
এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। উর্মি আর কখনো বিপ্লবকে ফোন দেয়নি। বিপ্লব ফোন দিলেও উর্মির কোন সংযোগ পায়নি। হয়তো উর্মির এখন সংসার হয়েছে। বিপ্লব এখন একটি বড় কোম্পানিতে ভালো বেতনে অনেক বড় পদে চাকুরি করে। তারও সংসার হয়েছে। কিন্তু মন থেকে বিপ্লব আজও সেই বসন্তদিনের কষ্টের স্মৃতি ভুলতে পারেনি। ঋতু পরিক্রমায় বছর ঘুরে বসন্ত আসে বসন্ত যায়, বিপ্লবের জীবনে আর কখনো বসন্ত আসেনি !
জীবনের টুকরো, টুকরো স্মৃতিগুলো আমৃত্যু বেঁচে থাকে মানুষের হৃদয় গহীনে। বিপ্লবের মনের গহীনে আজও উর্মির স্মৃতিগুলো প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খায়। উর্মির জন্য আজও তার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচরে যায়! উর্মির জন্য এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে আজও বিপ্লবের হৃদয়জুড়ে…..
Views: 37