ভালোবাসার অনুরণন
____ফারজানা ইসলাম
***********************
পুষ্পিতা আর রুশো, দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে লেখাপড়া করেছিল। প্রথমে সহপাঠী থেকে ওদের বন্ধুত্ব হল। এরপর বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। তারপর লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ওরা বিয়ে করল। বিয়ের পর হল ছেড়ে কিছুদিন শ্যামলের বাড়িতে থেকেছিল পুষ্পিতা-রুশো। শ্যামলের মা-বাবা দেশের বাইরে থাকেন। শ্যামল ওদের মিরপুরের বাড়িটায় একাই থাকত। তাই ওরা বেশ কিছুদিন আরামেই থাকতে পেরেছিল। এরপর রুশো’র চাকরি হতেই নিজেদের এক চিলতে ঠিকানা জোগাড় করে নিয়েছে এই শহরের বুকে। একটা একটা খড়কুটো দিয়ে পাখি যেমন বাসা বানায়, ঠিক তেমনি একটা একটা করে জিনিস দিয়ে ভরে উঠছিল ওদের সংসার।
পুষ্পিতার ন’টা-পাঁচটা অফিসের কাজে অনীহা। তারপরও কয়েক জায়গায় চাকরির আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল; কিন্তু কোথাও থেকেই ডাক আসেনি। এরপর পুষ্পিতা আর চাকরির খোঁজই করেনি। একটা স্কুলে জয়েন করেছে। স্কুল থেকে দুপুর একটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসে, তারপর বাকিটা দিন নিজের মতো করে কাটায়।
দুই কামরার একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া দিতে রুশোর বেতনের অর্ধেক টাকা বেরিয়ে যায়। এরচেয়ে ছোটো জায়গায় থাকাও যায় না। প্রায় সময়ই ওদের দুজনের গ্রামের বাড়ি থেকে মা-বাবা, ভাই-বোন, কেউ না কেউ আসেই। বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে, সংসারের বাকি খরচ সামলে, বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে, মাস শেষে হাতে আর কিছু থাকেই না বলতে গেলে। তাই বিলাসিতা আর শখগুলোকে আপাতত শিকেয় তুলে রেখেছে ওরা। কেউ কাউকে কিছু বলেনি; কিন্তু মনে মনে বুঝে নিয়েছে এই সীমাবদ্ধতাটুকু। তাইতো একে অপরের প্রতি কোনও অনুযোগ নেই। দিনশেষে হাসিমুখে, শান্তিতে ঘুমাতে যায় দু’জন।
পুষ্পিতা কখনও কোনও কিছু না চাইলেও, রুশো’র মনটা খচখচ করে। সে জানে, পুষ্পিতা কখনোই মুখ ফুটে কিছুই চাইবে না; কিন্তু রুশো’র মন চায় বাড়ি ফেরার পথে পুষ্পিতার জন্য কিছু আনতে। মেয়েটা মনিপুরী শাড়ি খুব পছন্দ করে। বিয়ের আগে রুশো, পুষ্পিতাকে বিভিন্ন রঙের মনিপুরী শাড়ি পড়তে দেখত। বিয়ের পর এই পর্যন্ত একটা কাতান শাড়ি ছাড়া আর আর কিছুই দেওয়া হয়নি। গতমাসে পুষ্পিতার জন্মদিন ছিল। রুশো আগেই ঠিক করে রেখেছিল, বেতন পেয়ে পষ্পিতাকে সুন্দর একটা শাড়ি কিনে দেবে। শাড়ি কিনতে গিয়ে কয়েক দোকান ঘুরে মনের মতো মনিপুরী শাড়ি না পেয়ে, টাঙ্গাইল শাড়ি বিতানে ঢুকেছিল। যে শাড়িগুলো ওর পছন্দ হচ্ছিল, তার সবই আড়াই- তিন হাজার করে দাম! সুতির শাড়ির যে এত দাম হতে পারে, এটা নিয়ে রুশোর কোনও ধারণাই ছিল না৷ অনেক খুঁজেপেতে বাজেটের মধ্যে মোটামুটি পছন্দসই একটা শাড়ি সে কিনেছিল। শাড়িটা দেখে পুষ্পিতার সে কী আনন্দ! রুশোর তখন মনে হয়েছিল, এই সুখের তুলনায় ঐ কয়টা টাকা একেবারেই সামান্য।
*************
রুশো বইমেলায় যাওয়ার কথা বলতেই পুষ্পিতা খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠল, “সত্যি আমরা বইমেলায় যাব!” পরক্ষণেই আবার বলল, “না থাক, বাদ দাও। কতবারই তো গেলাম। এখন আর যেতে মন চায় না।”
“কেন মন চায় না? চলো, গেলে তোমার ভালো লাগবে।”
থাক না, বাদ দাও। গেলেই সিএনজি ভাড়ায় একগাদা টকা বেরিয়ে যাবে। এখন তো আর আগের মতো বই পড়া হয় না। খামোখা এতগুলো টাকা নষ্ট করার কোনও দরকার নেই।”
“টকা নষ্ট হবে কেন! বইমেলায় যাওয়া মানে কী টাকা নষ্ট?”
“আমার যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।”
রুশো বুঝতে পারে, টাকা বাঁচানোর জন্য পুষ্পিতা বইমেলায় যেতে চাইছে না। সে বলল, “আজ আমরা বইমেলায় যাবই। ঝটপট তৈরি হয়ে নাও তো। মেলায় গেলেই তোমার ভালো লাগবে, দেখো।”
এরপর আর সাধাসাধি করতে হল না। পুষ্পিতা বইমেলায় যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিল।
টিএসসির সামনের ব্যারিকেড পেরোতেই পুষ্পিতার মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল। বইমেলার প্রবেশ পথে এসে সে থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত। চোখ ভরে দেখল চারপাশটা। তারপর রুশোর হাত ধরে ভেতরে ঢুকল।
পুষ্পিতার হাতটা ধরে হেঁটে বেড়াতে খুব ভালো লাগছে রুশো’র। ওরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, তখন প্রতিদিন আসা হত। সারা মাসে ওরা হয়ত দু’টো বা তিনটে বই কিনত; কিন্তু মেলায় আসত পুরো আটাশ দিন।
সময়ের পরিক্রমায় সবকিছুই বদলায়। আগের মতো আর বইমেলায় আসা হয় না। আজকে মেলার বিশতম দিন। দুই বছর পর ওরা আজ বইমেলায় এসেছে। দুজনের চাকরি আর সংসার সামলে, অনেককিছুই আর করা হয়ে ওঠে না এখন। এতদিন পর মেলা প্রাঙ্গনে পা দিতেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর মতোই ভালোলাগায় মনটা টইটম্বুর হয়ে উঠল দু’জনের।
বইয়ের দোকানে দোকানে ঘুরছে দুজন, নেড়েচেড়ে বই দেখছে। কোনও কোনও বইয়ের কিছু অংশ পড়ে আবার জায়গায় দেখে রেখে দিচ্ছে। পুষ্পিতার এমন প্রাণবন্ত উচ্ছাস দেখে রুশোর খুব ভালো লাগছে৷ তার মনে হচ্ছে তারা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়গুলোতে ফিরে এসেছে।
হাঁটতে হাঁটতে পুষ্পিতা বলল, “দেখো, মেয়েরা মাথায় কী সুন্দর ফুলের মুকুট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“হুম, অনেক সুন্দর। তুমি নেবে একটা?”
“আরে না, একশ টাকা দাম! কী দরকার ফালতু খরচের।” কথাটা বলেই পুস্পিতা সামনে এগিয়ে যায়।
একটু পর রুশো ওর মাথায় একটা ফুলের মুকুট পরিয়ে দিতেই পুষ্পিতা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, “কেন শুধু শুধু টকাটা নষ্ট করতে গেলে?”
“আমার ইচ্ছা হয়েছে, তাই নষ্ট করেছি। সবসময় এত টাকার হিসাব করবে না তো। সবাই কী সুন্দর ফুলের মুকুট মাথায় দিয়ে বেড়াচ্ছে আর তোমার জন্য তো এটা পরা বাধ্যতামূলক।”
“মানে কী!”
“মানে হল, যার নাম পুষ্পিতা, তার মাথায় পুষ্পের মুকুট থাকতেই হবে। বুঝেছ? চলো সামনে এগোই।”
পুষ্পিতার খুব শখ ছিল রবীন্দ্র রচনাবলী কেনার। বিয়ের পর সে প্রায়ই বলত, প্রতিমাসে একটা করে খন্ড কিনে পুরো সেট বানাবে। প্রথম খন্ডটা কেনার পর আর কেনা হয়ে ওঠেনি। সংসারের আলু-পেঁয়াজের হিসেব মেলাতে গিয়ে কখন যেন মনের খোরাক মেটাতে বেমালুম ভুলে গেছে সে। পুষ্পিতা দোকানে ঢুকে রচনাবলীর অন্য খন্ডগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। পছন্দের আরও কিছু বই হাতে নিয়ে, পরম মমতায় হাত বুলিয়ে, বইগুলো আবার জায়গায় মতো রেখে দিল। যেন ছুঁয়ে দেখতে পেয়েই ও খুব খুশি। রুশো মেলায় আসার আগেই ঠিক করেছে, আজ পুষ্পিতার পছন্দের বইগুলো কিনে দেবে। যদিও সে এখনও এই বিষয়ে কিছুই বলেনি।
বই দেখে দেখে রেখে দিচ্ছে বলে রুশো পুষ্পিতাকে বলল, “শুধু দেখছ কেন? কোনটা নেবে, নাও না।”
“আরে দেখাতেই তো আনন্দ । নতুন বই ছুঁয়ে দেখতে খুব ভালো লাগে। দেখো না, তুমিও ছুঁয়ে দেখো, ভালো লাগবে।”
“ছুঁয়ে তো দেখবই: কিন্তু তোমার ভালোলাগার বইগুলো নাও আজকে। তুমি রচনাবলীর বাকি খন্ডগুলো নিতে চেয়েছিলে।”
“আরে না। এতো দাম দিয়ে বই নিয়ে করব কী এখন? পড়ার সময় কই? শুধু টাকা নষ্ট।”
“আবার টাকার হিসাব!”
“স্যরি।”
“আমি বলছি, তুমি বই নাও। টাকার চিন্তা কোরো না একদম। আমার কাছে টাকা আছে। সবসময় তো হাতে টাকা থাকে না।”
“তোমার টাকার হিসাব আমার কাছে আছে রুশো । তোমার হাতে বাড়তি কোনো টাকা থাকার কথা না।”
“আহা,, বললাম তো আছে। কিছু টাকা জমিয়েছি।”
“কোনটা! টেবিল কেনার টাকাটা?”
“আরে, এত কথা বলো না তুমি, ভাল্লাগে না । বলছি টাকা আছে।”
“এটা কী টেবিল কেনার টাকাটা রুশো? প্লিজ বলো।”
“তুমি না একদম…. হুম, ওখান থেকে কিছু নিয়েছি আর বই কেনার জন্য কিছু টাকা আলাদা রেখেছিলাম। এবার হল তো? চলো এবার, বই নাও।”
“টেবিল কেনাটা খুব জরুরী, জানো তো? আব্বা’র বিছানায় বসে খেতে কষ্ট হয়। আমরা কিন্তু ঠিক করেছি, এ মাসেই টেবিল কিনব।”
“কিনব তো । এমাসেই টেবিলও কিনব। সবই হবে।”
পুষ্পিতার অনেক নিষেধ সত্ত্বেও পছন্দের অনেকগুলো পছন্দের বই কিনে ফেলল ওরা। বইয়ের দাম দেখে পুষ্পিতাতা বারবারই অস্থির হয়ে উঠছে, “এই দেখেছ, কমিশনের পরও আটশো টাকা! বাদ দাও তো। না, না এটা নেব না।” বারবার ওর অস্থির হওয়া দেখে রুশো বলল, “আজ একটু নিজের মতো করে বাঁচি আমরা, প্লিজ। আজ একটু হাত খুলে খরচ করতে দাও। নতুন বইয়ের ভাঁজে যে ভালবাসার ঘ্রাণটুকু আছে, পুরোনো বইয়ে সেটা কোথায়?”
“কিন্তু টেবিল….”
“আমার কথা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? বলেছি তো টেবিল কিনব। না হয় একটু ছোটোই কিনলাম। না হয় দুটো চেয়ার কমই নিলাম। বাকি মাসটা না হয় আলুর দম আর ডিম ভাজায় পার করে দিলাম। আমার কিন্তু একটুও কষ্ট হবে না, সত্যি বলছি। তবে আজ যদি তুমি বইগুলো না নাও, তাহলে ভীষণ কষ্ট পাব।”
পুষ্পিতার চোখ চকচক করে উঠল বইগুলো হাতে নিয়ে। মুখভরা প্রশান্তির ছোঁয়া। না চাইতেও অপ্রত্যাশিতভাবে এতটা পাওয়ার আনন্দে আপ্লুত হয়ে আছে মেয়েটা। নাকের কাছে বই নিয়ে নতুন পাতার ঘ্রাণ নিচ্ছে। খুশিতে ওর চোখে পানি চিকচিক করছে। এই ক’টা বইয়ে এত আনন্দ লুকিয়ে ছিল! রুশো অবাক হয়ে পুষ্পিতার উচ্ছ্বাস দেখে। ওর খুুশি দেখে রুশোরও খুশিতে মন মেতে ওঠে।
দুজন দুহাত ভরে বইয়ের ব্যাগগুলো নিয়ে হাঁটছে। রুশো বলল, “আচ্ছা, তোমার পছন্দের বইগুলো নিলে। এখন কী আমার পছন্দের একটা বই নেবে তুমি?”
“এগুলো সবই তো আমাদের দুজনের পছন্দের বই। তুমি আবার কোন বইটার কথা বলছ?”
“ইয়ে,, মানে, সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি।” ভয়ে ভয়ে বলল রুশো।
কটমট করে রুশোর দিকে তাকাল পুষ্পিতা। রুশো করুণ চাহুনি দিয়ে বলল, “শুধু এই একটা বই-ই তো চেয়েছি।”
রুশোর বলার ধরণে পুষ্পিতা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
ঘোরাঘুরি আর বই কেনা শেষে বাড়ির পথে রওনা দিল ওরা। অটোরিকশায় বসে পুষ্পিতা রুশোর হাতটা ধরে রেখেছে। চোখ কী হালকা ছলছল করছে ওর? আজ অকারণেই বারবার হেসে উঠছে মেয়েটা। রুশো মুগ্ধ নয়নে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, পুষ্পিতা গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আজকের দিনের জন্য থ্যাংকস। তুমি আমার মনটা এত্ত ভালো করে দিয়েছ।”
রুশো হাতের আঙুলগুলো পুষ্পিতার আঙ্গুলের ফাঁকে আটকে, ওর হাতটা মুঠোবন্দি করল। সে ঠিক করল, এখন থেকে এই ছোটো ছোটো ইচ্ছে আর ভালোলাগাগুলো অবশ্যই পূরণ করবে। মনকে সুস্থ রাখতে হলে, মাঝেমধ্যে মনের খোরাক মেটাতে হয়। পুষ্পিতা আঙুল দিয়ে রুশোর হাতে আঁকিবুঁকি কাটছে। পুষ্পিতার আঙুলের ছোঁয়ার মধ্যে দিয়ে ভালোবাসাটুকু রুশোর হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে অনুরণন তৈরি হচ্ছে। ঐ অনুরণনটুকু সে প্রাণভরে উপভোগ করছে।
Views: 24