রেস্টুরেন্ট
_____ ইসরাত জাহান নিতা
আমার স্বামী কোনোদিন ভালো রেস্টুরেন্টে খায়নি।আমাদের বাড়ি গ্রামে।গ্রামের বাজারে কোন রেস্টুরেন্ট হয় না, মামুলি ভাতের হোটেল আছে।আমার ভাসুরের বাড়ি ঢাকায়, ঢাকায় যেয়ে জায়ের সাথে এক দুবার ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
তিনদিন আগে হঠাৎ রাত দুইটার সময় ফোন বাজল। এত রাতে ফোন! অবাক হলাম।
হয় কোনো দুঃসংবাদ আর না হয় আমার মেয়ে আমেরিকায় পড়াশোনা করে সেই সাথে ছোটখাট চাকরি করে সে হয়ত।
হুম যা ভেবেছি তাই মেয়ে ফোন দিয়েছে।
ফোন ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এল
হ্যালো মা,আমি একশো ডলার পাঠালাম সামনে তোমাদের ম্যারেজ ডে তুমি আব্বুকে নিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে আর খাবার খাওয়ার ছবি আমাকে পাঠাবে।
আমি করুণ গলায় বললাম, মারে তোর আব্বু রেস্টুরেন্টে যাবে না, ও তো মিষ্টি পছন্দ করে একশো ডলার দিয়ে রসগোল্লা কিনে দিই আরাম করে খাবে।
না মা, আমি এখানে মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে খাই তোমাদের জন্য খুব খারাপ লাগে। তুমি অবশ্যই আব্বুকে নিয়ে যাবে।
মাগো, তোর আব্বু কিছুতেই যাবে না।
মা শোনো,সন্তানের জন্য বাবা মা কত কিছু করে আর আমার খুশির জন্য আব্বু সামান্য রেস্টুরেন্টে যেতে পারবে না?
ঠিক আছে সোনা আমি চেষ্টা করছি।
আমাদের ম্যারেজডের দিন মেয়ের আব্বুকে খুব করে বললাম মেয়ের ইচ্ছার কথা। কিছুতেই যাবে না। ভালো রেস্টুরেন্ট মানে যশোর শহরে যেতে হবে।বাড়ি থেকে পনেরো মাইল দূরে কিছুতেই যাবে না।
শেষে মেয়ের ডায়লগ দিলাম
“সন্তানের জন্য বাবা মা কতকিছু করে আর তুমি সামান্য রেষ্টুরেন্টে যেতে পারবে না”।
এই কথায় কাজ হলো। ঠিক হলো,আমরা যাবো সন্ধ্যার একটু আগে।
আমিতো খুশিতে বাকবাকুম করতে লাগলাম। চুলে শ্যাম্পু করে ঝকমারি একটা শাড়ি পরে মাঞ্জা দিয়ে সাজলাম।
ও আমাকে দেখে অবাক।
এত সাজুগুজু করেছো কেন? বিয়ে বাড়ি যাচ্ছ?
ভাবের সাথে বললাম, ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে এভাবে সাজতে হয়।তুমিও সাজো।
ও কোনমতে সার্ট প্যান্ট পরে বলল, চলো।
এমন মুখ কালো করে রেখেছে, মনে হচ্ছে নিমের পাচন খেতে যাচ্ছে।
বাসে করে আমরা সন্ধ্যার পর যশোরে পৌঁছালাম।
একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে যেয়ে করুণ গলায় বলল, নিতা এখান থেকে ছবি তুলে মেয়েকে পাঠালে হয়না? চলো বাড়ি ফিরে যাই।
কি আবোলতাবোল কথা বলো! মেয়ে খাবার খাওয়ার ছবি পাঠাতে বলেছে। চলো ভেতরে চলো,আমি হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলাম মনে হচ্ছে কুরবানীর গরু, হাত ফসকে দৌড় মারলে কেলেঙ্কারি।
রেস্টুরেন্টের দরজার দারোয়ান যখন আমাদের স্যালুট দিলো তখন নিজেদের খুব হোমড়াচোমরা মনে হলো।
খাবারের অর্ডার আমিই করলাম স্যুপ, চিকেন ফ্রাই, ফ্রায়েড রাইস, ভেজিটেবলস উইথ প্রন।
গরম খাবার আসলো, আমি ঝটপট দু তিনটি ছবি তুললাম।
ও তো খাবার দেখে নাক সিটকালো।এক চামচ স্যুপ খেয়ে বলল,এ ভাতের মাড় আমি খাব না।
বেশ তুমি স্যুপ না খেয়ে অন্য খাবার খাও।
সে কিছুই খাবে না। মুখ গোজ করে বসে থাকলো।
অভুক্ত মানুষের সামনে আমি নিজেও কিছু খেতে পারলাম না।
মরিয়া হয়ে বললাম, অন্তত একটা চিকেনের পিস মুখের সামনে ধরে হাসো,যাহোক তিনি আমার কথা শুনলেন, আমিও ঐ ভাবে হেসে সেলফি তুললাম।
ছবি তোলা শেষ হয়েছে? এবার বাড়ি চলো। এই বলে মুখ বেজার করে রাখলো।
বিল আসলো দুইহাজার টাকা ওর তো মাথা ঘুরে অজ্ঞান হবার মতো অবস্থা।
কোনোমতে হাত ধরে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম।
বেশ রাত হয়েছে শেষ বাস চলে গেছে। অগত্যা অটো ভাড়া করে বাড়ি ফিরলাম। সারা পথ বকতে বকতে আসলো।এত টাকা খরচ করে মানুষ কেনো এত পঁচা খাবার খায়! এত্তগুলো টাকা জলে গেল সাথে অটো ভাড়া।
রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরেই মেয়েকে ছবি পাঠালাম। ফ্রেশ হয়ে শুতে যাব।
হঠাৎ উনি বলে উঠলেন, কোথায় যাও? আমার খুব খিদে পেয়েছে, গরুর গোশত আর ভাত রান্না করো।
কি আর করা, সেই রাতে রান্না করে আমরা দু’জন তৃপ্তি করে গরুর গোশত আর গরম ভাত খাচ্ছি সে সময় মেয়ের ম্যাসেজ আসলো,
” মা তুমি আর আব্বু রেষ্টুরেন্টে যেয়ে এত তৃপ্তি করে খেয়েছো দেখে আমার খুব ভালো লাগল, আমি অনেক শান্তি পেয়েছি মা”।
আমরা দুজন মুখ চাওয়াচায়ি করে হাসলাম, যাহোক দুইহাজার টাকায় মেয়ের আনন্দ কিনতে পেরেছি এটাই বা কম কিসের।
( জীবনের গল্প)
Views: 17