নির্বাসন
______নাসরীন সুলতানা
কালো হলে নাকি বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়, শুনেছি জন্মের পর সবাই বলেছিল আমি চাঁদের মতো সুন্দর তবে আমার সাথে এমন কেন হলো! নিশা আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে দেখতে চোখ ভরা হতাশা নিয়ে নিজের দিকে চেয়ে রইলো খানিকক্ষন।
নিশা সবেমাত্র সপ্তমে পড়ুয়া মেয়ে,যেমন তার চেহারা তেমনি মিশুকে চরিত্রের।ছোটবেলায় পাড়া প্রতিবেশিরা সবসময় তার মাকে বলতো ভাবী ওকে বাইরে নেবেন না কারও কোলে দেবেন না,নজর লেগে অসুখ বিসুখ হবে।ওর মা তাই ভয় পেয়ে ছোট থেকেই ওকে বিধিনিষেধ এর মধ্যে রাখতো। নিশার বড় আরও দুই ভাই বোন আছে নয়ন আর নীলিমা,ওরা দুজনের সাথে বয়সের অনেকটাই ফারাক।
নিশার আগমনটা একরকম অপ্রত্যাশিত ই ছিল তবুও, তার আগমনের খবর নিশার বাবা মাকে অখুশি করেনি।অখুশি করেনি তার দুই ভাইবোনকেও।সন্তান আল্লাহর রহমত বলেই মনে করতেন তারা।যদিও আত্নীয় পরিজন আর পাড়া প্রতিবেশীদের এ নিয়ে কান কথার কমতি ছিলো না।”দুইটা আছে আবার আরেকটা হইলো ” এসব কথা শুনে নিশার মায়ের মন মলিন দেখে নিশার বাবা সবসময় তার মাকে বোঝাতো সন্তান আমাদের তাই মায়াটা তাদের থাকবে না তুমি কারও কথায় মন খারাপ করবে না।তিন সন্তানকে সাধ্যমতো মানুষের মত মানুষ করবো আমরা।এরপর আর নিশার মায়ের মন খারাপ হত না কোনদিন,স্বামীই যখন তার পাশে আছে।
নিশার বাবা মেডিসিন কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ, সারাদিন মটর সাইকেলে করে মেডিসিন সরবরাহ করে ক্লায়েন্টদের কাছে, তাতে তার যা আয় হয় তা দিয়ে খুব হিসেব করে তাদের সংসার চলে যায়।
বড় দু’ভাইবোন স্কুল পেরিয়ে গেছে,আর ছোট নিশাকে নিয়ে কাটতে থাকে তার মায়ের দিনগুলো।একটু একটু করে চোখের সামনে সেদিনের জন্ম নেয়া নিশার বেড়ে ওঠার প্রতিটি ক্ষণের সাক্ষী হয়ে থাকতে যেন অদ্ভুত সুখানুভূতি অনুভব করে তার মা।এর আগেও সে দু’বার মা হয়েছে,কিন্ত এবারের অনুভূতিটা যেন একেবারেই ভিন্ন্য হয়ত নিশা চঞ্চল, চপলা শিশু নয় বলেই।তা মায়া যেন তাকে কাছ ছাড়া করতেই চায় না এক মুহূর্তের জন্যও।
নিশা বড় হয়ে উঠছে আর কি এক অজানা শংঙ্কায় ছেয়ে যাচ্ছে মায়ের মন।ইদানীং মেয়ের মধ্যে যেন এক বিষণ্ণতার ছায়া দেখতে পায় তার মা।নিশা কাউকে কিছু বলে।এক বিকেলে কলেজ পড়ুয়া ভাই রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে ঘরে ফেরে, সে সাপের মতো ফুসতে থাকে,নিশার মা কিছুই বুঝতে পারে না।ওদিকে নিশা কাঁদছে, সে স্কুল থেকে ফেরার পথে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে বখাটে এক ছেলে তাকে নানা ভয় ভীতি দেখায় অগত্যা আজ ভাইয়ের চোখে পড়ায় তার ভাই তাকে বেদম পিটিয়ে ঘরে ফিরেছে।মায়ের মনে নানান আশংকা জমতে থাকে।তার বাবা সারাক্ষন জীবিকা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকে,সংসার ও সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব অলিখিতভাবে নিশার মায়ের ওপরেই।
আত্নীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীও নিশার এই রুপ নিয়ে নিশার মাকে নানান কথা বলতো।নিশা ভীত হরিনীর মত দিন কাটাতে লাগলো। তার মা সিদ্ধান্ত নিলো সে তাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। আত্নীয় স্বজন কেউ ই কিছু জানতে পারলো না,পাছে জানলে তার জীবনের উপর আঁচড় আসে।যদিও বাবার আপত্তি ছিল তারপরেও সে মত দিলো, কারন এই মুহুর্তে তার পক্ষে এ শহর ছেড়ে অন্যত্র যাওয়াও সম্ভব না।আর একা মেয়েকে শহরে হোস্টেলে রেখে পড়াবার ব্যপারেও তাদের সায় ছিলো না।অগত্যা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিয়ে হয়ে গেলো নিশার।
নতুন পরিবেশে এসে এই বয়সে নিজের আপনজনদের কাউকে না পেয়ে নিশার ভীতি দিন দিন বাড়তে থাকে।
নিশা আয়না দেখে না বহুদিন।আজ সকালে সে আয়নায় তাকিয়ে নিজের মুখ দেখছে আর ভাবছে এ জগতে একটা মেয়ে দেখতে খারাপ হলে নাকি তাকে কেউ দাম দেয় না,তাহলে তাকে যে সবাই চাঁদের মতো বলতো আচ্ছা চাঁদ কি দেখতে খারাপ?সে যদি দেখতে ভালোই হয় আর ভালো মেয়েই হয় তবে আমার এমন হলো কেন?নাকি সবাই মিথ্যে বলতো তাকে সবসময়।
এইটুকু ছোট মেয়েটা নিজের মনকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় তবে কি এখানে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াটাই অপরাধ?কিন্ত আমি তো ইচ্ছে করে মেয়ে হয়ে জন্মাইনি তাহলে আমার দোষ কি?এই যে এইসব অচেনা মানুষদের মধ্যে চলে আসতে হলো এ দোষ কি আমার?
সে উপলব্ধি করে সমাজ আর বাস্তবতার ঘোরটোপে পড়ে সে যেন নির্বাসিত।তার গাল বেয়ে নীরবে দু’ফোটা অশ্রু গলে পড়ে।সে জানে না এই অশ্রু কোনদিন সে থামাতে পারবে কিনা।কাউকে দেখাতে পারবে কিনা।সে যেন অজানা অচেনা কোন এক নির্বাসনে নির্বাসিত হয়েছে, এই নির্বাসিত থেকে হয়তো কোনদিনই মুক্তি মিলবে না তার।এত আলোর ভিড়েও যেন তার চারিধার ঘিরে আসে নি:সীম অন্ধকার।
Views: 53