দিয়েগো দীপের দ্যুতি
_________অরণ্য আন্ওয়ার
গৌতম বুদ্ধের মগ্নতায় ঘড়ির কাঁটায় তখন
রাত তিনটে সম্ভবতঃ ,
আমাদের ঘুমগুলো তখনও উড়ে যাচ্ছিল
গরম ভাতের ধোঁয়া , কিংবা পাখির মতো ।
আঙুলের ডগায় পুড়ে যাচ্ছিল সিগারেট
ধোঁয়ারা কুয়াশা হয়েও বাঁচতে পারেনি
ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানের ব্লেডের আঘাতে ,
চায়ের উষ্ণতা , উত্তেজনার চানাচুরও ধীরে ধীরে
মরে যাচ্ছিল , ব্যস্ত হৃদপিণ্ডের ভাবনার আড়ালেই ;
কালের ধুলোয় লেখা হয়েছিল নতুন এক ইতিহাস
যে রাতে ।
কিছু মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত কখনও শূণ্যে তোলে
কখনও মানুষ উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে ,
কখনও হতাশায় মুষড়ে পড়ে মানুষ
আঙুলের স্পর্শ রাখে , ভাঁজ হয়ে আসা কপালে
স্বেদ উঠলে ফুটে ।
স্তব্ধ মানুষের মিছিলে এখানে শুধু নগন্য কিছু
আমাদের চারপাশে , আমাদের শহরে ,
আজতেকা স্টেডিয়ামে আছে এক লাখ
সাড়ে চৌদ্দ হাজার ;
রেডিওতে কান লাগানো আছে ১০০ কোটিরও ওপরে ।
সত্য – প্রতিরোধের ব্যারিকেড ভেঙে
শৈল্পিক এক ফুটবল নিয়ে অবশেষে এলেন তিনি ।
আশ্চর্য দক্ষতায় ফুটবলটাকে
পোষমানা কোন প্রাণীর মতো
নিজের কাছে আটকে রেখে ;
দমবন্ধ করে রাখতে আমাদের ;
এলেন , ফুটবলের অবিশ্বাস্য সেই জাদুকর ,
ক্ষিপ্ত নেকড়ের মতো
আকাশের প্রতিদ্বন্দী চিলের মতো
অজানা উড়ুক্কু মাছের মতো হাওয়ায় শরীরকে ভাসিয়ে
টেনে ছিঁড়ে ফেললেন , প্রতিপক্ষের রক্ষণবূহ ;
রূপকথার গল্পের সাপের মাথার মণিতে
হাত রাখা রাজপুত্র দিলেন , এক মুগ্ধ প্রহর ।
ল্যাটিনের বঞ্চিত মানুষ মুহূর্তেই জিতে যায়
উপনিবেশবাদী ইংল্যান্ডের হয় পরাজয় ,
দুইশ বছরের শাসনের ইতিহাসের কুশপুত্তলিকা
পোড়ায় তখন , আমাদেরও মৌন হৃদয় ।
” হ্যান্ড অব গড ” বিতর্কের ছাপ দেওয়া
গোলের অভিযোগ কাঁধে
ঝড়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে এক ঝড়ের পাখি
মানুষের ভালবাসা কুড়ায় অনায়াসে ,
গলির মোড়ের আড্ডায় শীতকালের বিষন্নতা সরিয়ে
বসন্তের কোকিলের সুর এনে দেয়
স্নেহ কাতর উদার বাতাসে ।
অবিরাম করতালি , অফুরান ভালবাসার সঞ্চয় নিয়ে
একজন চলে আসে প্রাণ প্রদীপের আলোয় ;
ভীষণ লড়াই করে , দাঁতে দাঁত ঘষে ,
ল্যাটিনের ছেলে নিপুণ কৌশলে
কপাল পোড়া দেশের মানুষের জয় করে নিয়ে হৃদয়
বুকের মধ্যে ঢুকে বসে ।
আমাদের যে জীবন জুড়ে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বণি
যে জীবন নির্জনতায় ডুবে ছিল চাল ,ডাল , নুন , তেলে ,
কাছের মানুষ হয়ে সেই জাদুকর, শোনালো আমাদের
শেকল ভাঙার কথা ;
স্বপ্নের মহানায়কের মতো শেখালেন
বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে উল্টোপথে হেঁটে চলা ;
হত্যা , অশ্রু , রক্তপাতে ক্লান্ত হৃদয়ে
বিপ্লবের মন্ত্র দিলেন ঢেলে ।
চৌত্রিশ বছরের পুরোনো সে রাত
আমি ভুলিনি আজও ;
নতুন এক আনন্দ যে রাত , এনেছিল বয়ে ,
উচ্চকিত স্বপ্ন ছাড়া সত্যিই বাঁচা বড় দায়
যে জীবন নিয়ে ;
সে জীবনে দিয়েগো নামের দ্যুতি
কালের রূঢ় দুঃসময়ে উঠেছিল
বেপরোয়া আর ভীষণ সাহসী এক
স্বপ্ন হয়ে ।
যে দিয়েগো দিয়ে গেছে এলেমেলো জীবনের গল্প
ফুটবল মাঠের এক বর্ণাঢ্য অধ্যায় ও স্মৃতিসম্ভার ,
যে গল্প পড়া হয় প্রতিদিন , যে স্মৃতি খুঁড়ে আজও
মাটির সৌরভ মিশে থাকা মাঠের চাষিও
দিয়েগোর দ্যুতি আজও প্রেরণা সবার ।
উল্লাসে ফেটে পড়া যমদূত , ঈশ্বরের যে বিধান মেনে
এই পৃথিবীর নক্ষত্র চুরি করে ;
সে বিধানেই মৃত্যুর অনিবার্য সমীকরণ মেনে
দিয়েগো হারায় তার , বাতাসের ঘর্ষনে
আগুন জ্বলে ওঠা শৈল্পিক ডানা ভাঁজ করে ,
হাওয়ার গতিপথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে
মৃত্যু হয় কেবল শরীরের ;
হারিয়ে যাক যতই বিস্ময় জাগানিয়া সেই জাদুকর
আজও তো তারই নামে পৃথিবীর সব গ্যালারীতে
কান্নার বৃষ্টি ঝরে ।
Views: 63