আমি আমার বাবার বিয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম!
বাবার এখন ছিয়াত্তর বছর চলছে। যার সাথে বিয়ে দিচ্ছি তিনি আমার ঘুরানো প্যাচানো সম্পর্কের খালা হন। আমার নানাবাড়ি নিশিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। খালার বয়স পঞ্চাশ। কুড়ি বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। তারপর লেখাপড়া শেষ করে চাকরী। আর বিয়ে করেননি।
বাবাকে এই বিয়েতে রাজি করাতে আমি পাঁচ বছর ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছি! বাবা বিয়ে করবেনই না। মা’র স্মৃতি বুকে নিয়ে বাবা কবরে যেতে চান।
মা চলে গেছেন পনের বছর চলছে। সেবার এক রোজার ঈদের রাতে মা’র বুকের বাম পাশে চাপ ধরা ব্যথা। আমরা ভাবলাম বুঝি গ্যাসের ব্যথা। মাঝরাতে সেই ব্যথা তীব্র হলো। আমাদের এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেবার বিশ মিনিটের মধ্য মা মারা গেলেন। মা কিছুই বলে যেতে পারলেন না, অনেক অগোছালো কাজ গুছিয়ে যেতে পারলেন না। বাবা অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। আমি তখন দুই সন্তানের জননী, একমাত্র ভাই তিতাস দু’বছর হয় কুয়েতে, ছোটবোন চিত্রা অনার্স পড়ছে। আমরা কেউ তত ছোট নই, তবু মনে হয়েছিল পৃথিবীর সব’চে অসহায় মাতৃহীন তিনটি সন্তান আমরা। আমাদের শিকড় উপড়ে চলে গেছে ঝড়ে!
বিরাট বড় বাড়ি শূন্য হয়ে গেল! এখানে,সেখানে, সবখানে মা’র স্মৃতি, মা’র ছায়া! ছোট বোনটা ঘরের কোনায় কেঁদে বেড়ায়, বাবা তখন মা’র বালিশটা পাশে নিয়ে, বুকে নিয়ে শুয়ে থাকেন, ছাদে গিয়ে একা একা পায়চারী করেন, গভীর রাতে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থাকেন।
ঘর-সংসার, বাজার-হাট করার জন্য গ্রাম সম্পর্কের চাচা লস্কর মিঁয়া ও তাঁর স্ত্রী হনুফা চাচীকে রেখে আমি দুই সন্তান বুকে নিয়ে আনিসুলের সাথে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দশ কিলোমিটার দূরে শশুরবাড়ি মু্ন্সীপাড়ায় চলে এলাম।
••••••••••••
লস্কর চাচা মারা গেলেন ছয় বছর হলো। হনুফা চাচী শরীর মনে ক্লান্ত এক মানুষ। কোনকরম দুটো ভাত, তরকারী বাবার সামনে দেন। ঘর-বাড়ির বেহাল দশা, যেন ভুতের আবাস। চিত্রা বিয়ের পর ঢাকাতে, তিতাস বৌ বাচ্চা নিয়ে কুয়েত। আমি মোটামুটি কাছে থাকাতে রান্না-বান্না করে নিয়ে মাসে দু’একবার বাবার কাছে আসি। বাবাকে কাছে বসিয়ে খাওয়ায়, ঘরগুলো সাফ করি তারপর দিনশেষে নিজের সংসারে ফিরে আসি। কত বড় সংসার আমার! শশুর, শাশুড়ী, উনাদের সেবা-যত্ন, ছেলেমেয়ে, ওদের কলেজ, আনিসুল, তাঁর ব্যস্ত জীবন। আমারই বা অবসর কই বাবার দেখাশোনা করার!
হনুফা চাচীই প্রথম কথাটা আমাকে বলে।
-তিস্তা মা, তোমার আব্বার কথা একটু ভাবো। আমি আর পারি না রে, বেটি! ছেলে আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে চায়।
-তুমি চলে গেলে বাবার কী হবে চাচী? আমরা তো পরের ঘরে!
-তোমরা খুব বড় একখান ভুল করছো, তিস্তা!
-কী ভুল?
-ভাইসাহেবকে বিবাহ না দিয়ে।
-বিয়ে? বাবাকে? তুমি পাগল হলে!
-পাগল না রে মা, এইটাই সত্য। আরো আগে তোমাদের এইটা ভাবা উচিৎ ছিল।
-আমরা ভাবলেই হতো? সাহস করে বাবাকে এ কথা বলতে পারতাম? নাকি এখন পারবো?
-তুমি বড় সন্তান, তোমাকেই পারতে হবে। জীবন কার কতটুকু এইটা কেউ জানেনা! ভাইসাহেবের বয়স হইছে, উনার সাথে দুইটা কথা বলার, যত্ন আত্তি করার একটা মানুষ তো দরকার! স্ত্রীর কাজ কি ঝি দিয়ে হয়? তোমরা না শিক্ষিত? এগুলা বুঝো না কেন?
সত্যিই তো! হনুফা চাচীর কথা খুবই যুক্তিযুক্ত! আমি ভাবতে থাকলাম। আকাশ-কুসুম দিনরাত ভাবতে থাকলাম। কাকে পাবো, কোথায় পাবো এমন একজন মানুষ, যে আমাদের বাবার পাশে দাড়াবেন?
ভাবতে ভাবতে একদিন আমার আলো খালার কথা মনে পড়লো। আলেয়া বানু আলো। আমার চেয়ে বছর তিনেক বড়। ছোটবেলা খুব ভাব ছিল আমাদের। নানাবাড়ি গেলে মাঠ, ঘাট একাকার করে বেড়াতাম আমি, আলো খালা আর ছোট চিত্রা।
আমি সময় করে একদিন আলো খালার কাছে গেলাম। আবার গেলাম, বারবার গেলাম! কাজ হলো। এবার বাবার মতামত।
•••••••••••••
-তিস্তা, এমন কথা তুমি আর আমাকে বলবে না! যেদিনই আসো, সেদিনই এই এক কথা! তুমি বোঝো তোমার মায়ের স্থান আমার কতটা জুড়ে!
-বাবা, এ সংসারে কেউই কারো পরিপূরক হতে পারেনা। মা তো মা’র জায়গাতেই আছেন, থাকবেন। কিন্তু আপনার কথা ভাবেন! আমাদের কথা ভাবেন! আপনাকে এভাবে একা রেখে আমরা তো একটুও ভালো থাকি না, বাবা!
আমি হাল ছাড়লাম না। নিজে বলার সাথে সাথে বড়খালুকে, বড়খালাকে জোঁকের মত বাবার পিছনে লাগিয়ে রাখলাম!
তিতাস খুব বেশী আপত্তি করলো না। করবেই বা কেন? কুয়েতে ব্যাবসা-বানিজ্য করে সবাই মিলে নিজেদের মত ভালোই তো আছে! নাকি বাবা তার কাছে কুয়েত গিয়ে থাকবে, নাকি সে দেশে এসে বাবার পাশে দাড়াবে। হয়তো এটাই পৃথিবীর নিয়ম। বড় অদ্ভুত এই নিয়ম!
বাবার বিয়েতে বাঁধ সাধলো চিত্রা। এই মেয়ে কেঁদে কেটে একাকার!
-এই আপা, এটা তুমি কী বলো?
-কেন, সমস্যা কী?
-বিরাট সমস্যা!
-তো তুই বাবাকে কাছে রাখ!
-বাবা কি তাই থাকবেন? তাছাড়া আমার শাশুড়ী আছেন না?
-শাশুড়ী থাকলে বাবাকে রাখা যাবে না?
-তো তুমি রাখছো না কেন?
-আমার কি শশুর-শাশুড়ী নেই? আনিসুল তাদের একমাত্র ছেলে। তাঁরা এই বয়সে কোথায় থাকবেন?
-কিন্তু বাবার বিয়ে হলে মানুষে কী বলবে, আপা?
-মানুষের বলার কাজ বলবে! কোন মানুষ কি বাবার পাশে এসে একবেলা দেকভাল করবে, চিত্রা?
-ও আপা, আমার শাশুড়ী কী বলবে? নাইমুলই বা কী বলবে? মান-সম্মান তো সব যাবে! ছেলেমেয়েরাও তো বড় হয়েছে!
-চিত্রা, এ কী বলবে, ও কী বলবে, এই নিয়েই কি তুই পড়ে থাকিস? আজব তো! আমাদের সমস্যা আমাদেরকেই সমাধান করতে হবে! নাকি?
-তুমি যাই বলো আপা, এসবে আমি নেই!
-তোকে থাকতেই হবে! নাইমুল বুদ্ধিমান ছেলে, বাস্তব বুঝবে! খালাম্মাও বুঝবেন! না বুঝলে নাই! আমি অনেক কষ্টে বাবাকে রাজি করিয়েছি, তুই ঝামেলা করবি না, চিত্রা!
••••••••••••••
১৫ই আশ্বিন আমাদের বাবার বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। আমি লোকজন দিয়ে বাড়িঘর পরিষ্কার করে ফেললাম। বাবা বললেন, মা’র ঘরের কোন জিনিসে হাত না দিতে।দিলাম না। থাক বাবা-মায়ের স্মৃতির ধুলো মাখা ঘরখানি, মায়ের গায়ের গন্ধ নিয়ে!
আমার আর চিত্রার ছেলেমেয়েরা নিজেদের জন্য বেশ শপিং টপিং করলো। নানার বিয়ে! আমি চিত্রাকে নিয়ে আলো খালার জন্য কয়েকটা শাড়ী, পেটিকোট, ব্লাউজ, স্যান্ডেল কিনলাম। আলো খালা আগেই বলেছেন, কোন বাড়াবাড়ি যেন না করি আমরা। বাড়াবাড়ি হলো না, খালু, চাচা,মামা, ফুফারা বাবাসহ আটজন গিয়ে বিয়ে দিয়ে আলো খালাকে নিয়ে এলেন আমাদের ঘরে।
আলো খালা বললেন,
-তিস্তা, তোর ঘরটাতেই আমি থাকি? যদি তোর আপত্তি না থাকে!
-কেন? তুমি মা’র ঘরে থাকবে! তুমিই তো আমাদের ছোট’মা!
বড় বেশী ক্লান্ত এই আমি আলো খালাকে ছোট’মা বলে ডেকে অবুঝ শিশুর মত কেঁদে ফেললাম! চিত্রাও কাঁদছে! আলো খালা আমাদের দু’বোনকে পাশে নিয়ে খাটে বসলেন।
-শোন্ তোদের যদি ইচ্ছে হয় আমাকে ছোট’মা ডাকতে তবেই ডাকবি! আমি কোন কিছুতেই কিছু মনে করবো না। তবে তোদের আমি সন্তানই মনে করবো! আমার তো আর কোন সন্তান নেই! ভাগ্যগুনে আজ তোদের পেলাম!
আমরা আরো কয়েকদিন বাবার বাড়ি থাকলাম। ছোট’মা মজার মজার রান্না করেন। বাবার বিছানায় নতুন চাদর, মাথার কাছে ফুলদানীতে তাজা গোলাপ! দু’স্যুটকেস কাপড় সেই বিছানায় ঢেলে উনি আমাদের দু’বোনকে ডাকলেন।
-তিস্তা, চিত্রা এদিকে আয় তো! তোদের পছন্দমত বেছে নে!
-এতো শাড়ি?
-কতদিনের জমানো শাড়ি! আমি শাড়ি কিনতে খুব পছন্দ করতাম। এগুলো এখন তোরা পরিস।
-তুমি কী পরবে?
-তোদের বাবা হাল্কা রং পছন্দ করেন, আমিও স্কুলে হাল্কা রঙের শাড়িই পরি। হাল্কা রঙের দু’চারটা রেখে তোরা সবগুলো নে। চিত্রা, তুই এই বেগুনী জামদানীটা পরে আয় তো মা! এই শোন্, এই চেইনটা গলায় দে! মুখটা কালো করে রাখিস না। এতো সুন্দর মুখ তোর! বুবুর মুখ পেয়েছিস তুই!
•••••••••••••••
আজ আমরা বাবার বাড়ি থেকে নিজের সংসারে চলে যাবো। আনিসুল, নাইমুল আমাদের ছেলেমেয়ে সব মিলে যেন চাঁদের হাট। তবুও শূন্যতা, সারা বাড়ি জুড়ে শূন্যতা! বুকের ভেতর গুমোট কান্না! আমরা আমাদের মাকে খুঁজি! বাবা বোধহয় ছাদে। সকাল থেকে হাল্কা জলপাই রঙের শাড়ী পরে যে রমণী ঘর থেকে রান্নাঘর ছুটে চলেছেন, কে কী খাবে, কাকে কী দেবেন, বাবার গোসলের গরম পানি, লেবু চা, চিত্রার চুলের বেনী বাঁধা, আমার কানের কাছে টুকটাক কথা বলা সেই রমনীর জন্য আমার এতো মায়া লাগছে কেন? এই মায়ার উৎস কী, কোথায়? আমি তার তল খুঁজে পাই না!
চিত্রাকে কাছে ডেকে বসাই। অভিমানী ছোটবোন আমার। কত অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছে! আমিও ততটা সময় দিতে পারিনি ওকে। সময় অনেক কিছু আমাদের পারতে দেয় না!
-চিত্রাসোনা, আর কাঁদিস না! চলে যাবার সময় হলো যে!
-আপা, সত্যিই কি উনাকে ছোট’মা ডাকতে হবে?
-সমস্যা কী ডাকলে? উনার কথা একবার ভেবে দেখ! কত সহজে আমাদের সবাইকে আপন করে নিলেন! বাবার একটা সঙ্গী হলো। এই বয়সে একটা পথ চলা সঙ্গীর খুব দরকার রে! শুধু কী শরীরের জন্যই সঙ্গী লাগে চিত্রা? মনের জন্য, নির্ভরতার জন্য, নিজেকে নির্ভার করার জন্য একটা কাঁধ, দুটো বিশ্বস্ত হাত খুব দরকার জীবনে! চল বিদায় নিতে হবে।
বাবা চোখের পানি লুকাতে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। আরো একজন শাড়ির আঁচলে মুখ লুকালেন, যখন আমরা দু’বোন বললাম,
-ছোট’মা আসি!
Views: 70