” আমি বলি কি, যদি কোনো ব্যাক্তি আলু সত্যি ভালোবাসে, তবে সে লোক ভালো না হয়েই যায় না।”— এ এ মিলনে।
লেখকের সাথে আমি একমত। তবে এখন পর্যন্ত এমন কাউকে পাইনি যে আলু ভালোবাসেনা। আলু আমরা সবাই ভালোবেসে খাই, যে কোনো ফর্মে— ভাজি, ভর্তা, তরকারি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এমনকি পিঠাও।
আলু আজ সহজলভ্য, সব জায়গায় পাওয়া যায়। কিন্তু আলুকে আমরা ভালোবেসে রান্নাঘরে ঠাই দিয়েছি মাত্র কয়েকশো বছর হল। তার আগে বেচারাকে অনেক ‘দূর ছাই’ করা হয়েছে, অনেক অপবাদও দেয়া হয়েছে।
আলু এসেছে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। পেরুর ইনকা প্রজাতি আন্দেজ পর্বতমালার গায়ে আলু চাষ করত, খেত, এমনকি এর পূজাও করত। এছাড়াও আরো কিছু জিনিসে আলুর ব্যবহার করত—যেমন ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগাতে কাঁচা আলু দিত, বাতরোগ যাতে না হয় তার জন্য আলু সাথে রাখতো আর বদহজম এড়ানোর জন্য অন্যান্য খাবারের সাথে আলু খেত। এত গুণসম্পন্ন আলু কিন্তু তখনো বাকি দুনিয়ার কাছে অচেনাই ছিল।
১৫৩২ সালে স্প্যানিশরা পেরুতে আসে সোনার খোঁজে। সোনা তো পেলনা, তবে অনেক নতুন জিনিসের সন্ধান পেল, তার মধ্যে একটা হচ্ছে আলু।
—ফিরতি যাত্রায় জাহাজ বোঝাই করে আলু নিয়ে আসা হয়, নাবিকদের খাবার হিসেবে। কারণ ইতিমধ্যে লক্ষ করা গেছে যে, যে সমস্ত নাবিকেরা আলু খেয়েছে, তাদের স্কার্ভি রোগ হয়নি (আলুতে ভিটামিন সি আছে)।
নাবিকেরা সব আলু খেয়ে শেষ করতে পারেনি। তাই কিছু আলু স্পেইন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেখান থেকে অল্পসল্প চাষবাস শুরু হয়। তবে বেশিরভাগ পশুখাদ্য হিসেবে।
স্পেইন থেকে আলু ধীরে ধীরে ইটালী ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬০০ এর মধ্যে আলু স্পেইন, ইটালী, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইটজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, জার্মানি, পর্তুগাল ও আয়ারল্যান্ডে ঢুকে গেছে। কিন্তু কোনোখানেই সমাদৃত হয়নি। বরং তাকে মানুষের মনে দখল নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
এর প্রধান কারণ সেসময়ের আলু এখনকার আলুর মতো সুন্দর, মসৃণ, গোলাকার আর মনভোলানো স্বাদের ছিল না। আদিতে আলুর চেহারা যাচ্ছেতাই ছিল, অনেকটা গাঁটযুক্ত আঙ্গুলের মতো, স্বাদেও তিতা— ভর্তা, ভাজি, বেকড যেভাবেই তৈরি করা হোক না কেন, খেতে ভালো না।
পুরো ইউরোপেই আলুকে ভয় ও সন্দেহের চোখে দেখা হত। দেখতে কী বিশ্রী, স্বাদেও তিতা— নিশ্চয় এটা বিষ!
অশুভ! শয়তানের চ্যালা!
দেখতে হবেনা, এসেছে তো বর্বর, আনকালচারড জাতির কাছ থেকে।
জনগণ তাই আলুর কাছ থেকে ১০০ হাত দূরে থাকত। বেশীরভাগ মানুষ মনে করত এটা খাবার যোগ্যই না, ঘোড়া শুয়োর এদেরকে খাওয়ানোর যোগ্য। যারা একেবারেই গরীব, তারা এটা বাধ্য হয়ে খেত।
আলুর কপালে আরো অপবাদ বাকী ছিল। বহুবছর আলুকে লেপ্রসি, সিফিলিস, অকালমৃত্যু আর স্টেরিলিটির জন্য দায়ী করা হয়।
শেক্সপিয়ার মনে করত আলু খেলে কামনা বাসনা খুব বেড়ে যায়!
আলুর অবশ্য অন্য একটা ব্যবহার ছিল ফুলগাছ হিসেবে! অনেকে বিদেশী ফুল হিসাবে শখ করে লাগাত। বোটানিক্যাল গার্ডেনেও শোভা পেতে থাকল।
১৫৮৯ সালে স্যার ওয়ালটার র্যালেই আলু আয়ারল্যান্ডে আনে ও তার এসটেটে চাষ করে। কুইন এলিজাবেথকে কিছু আলু উপহারও দেয়। রানীর পাচক সাতজন্মেও আলু চোখে দেখেনি। তাই আলু ফেলে দিয়ে আলুশাক রান্না করে টেবিলে পরিবেশন করে। রাণী আবার নতুন খাবার খাবে বলে একগাদা মেহমান দাওয়াত দিয়েছে। বিষাক্ত আলুশাক খেয়ে সবারই মরমর অবস্থা হল।
ব্যাস, ব্যান করো আলুকে! আমার কোর্টের আশেপাশে যেন আলু না দেখি— বললেন রাণী।
এভাবেই আলু প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে এর গুণাগু্ণ কিছু মানুষের চোখে ধরা পড়তে থাকে। প্রথমত, একে চাষ করা খুবই সহজ। যে কোনো জায়গায় এরা দিব্যি জন্মায়। সমতলভূমিতে, পাহাড়ে, মরুভুমিতে। তাছাড়া মাটির উর্বরতা নিয়েও এদের কোনো নখরা নাই। নিতান্ত অনুর্বর জমিতেও এরা দিব্যি ফলে, ঠাণ্ডাও এদের কাবু করতে পারেনা।
দ্বিতীয়ত, আলুর পুষ্টিগুণ। মানুষের পেট ভরাতে আর এনার্জি দিতে এর জুড়ি নাই। অন্যান্য শস্যের থেকে বেশি তো বটেই, এর চাষ করার ঝামেলাও কম। সেসময়ের চাষি সম্প্রদায় আর সৈনিক সম্প্রদায়ের জন্য একেবারে আদর্শ খাদ্য। একটাই মুশকিল— তারা এটা দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে!
বোঝা যাচ্ছে যে ওপরতলা থেকে চাপ না এলে জনগণ আলু খাবেনা। জার্মানির রাজা ফ্রেডেরিক পাইক পেয়াদা পাঠিয়ে প্রজাদের আদেশ দিল—
” তোমরা আলু চাষ করবে
তোমরা আলু খাবে
নাহলে তোমাদের নাক কেটে নেয়া হবে!”
আলুর পক্ষ নিয়ে সবচেয়ে বেশী কাজ করেছিল সম্ভবত পারমেন্টিয়ের নামের এক ফ্রেঞ্চ ( ১৭৩৭- ১৮১৩)। সে একাধারে কেমিস্ট ও বোটানিস্ট ছিল। যুদ্ধে বহুবছর প্রিজনার অফ ওয়ার হয়ে জেলে কাটিয়েছিল। সেখানে আলু ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। সে থেকে সে আলুপ্রেমী। ছাড়া পাওয়ার পর ফ্রান্সে ফিরে আলু নিয়ে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে থাকে। আলুর গুণাগুণ বর্ণনা করে সাধারণ মানুষকে আলু খেতে উৎসাহ দিতে থাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! জনগণ তার কথা পাত্তাই দেয়না, এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়।
এবারে সে ষোড়শ লুই এর কানে অবিরত আলুর গুনগাণ করতে থাকে। উদ্বুদ্ধ হয়ে লুই তার কোটের বাটনহোলে আলুর ফুল গুঁজে আলুকে প্রোমোট করতে থাকে। তার রাণী মেরী আন্তোয়ানেত খোঁপায় আলুর ফুল গুঁজে কেশবিন্যাসের নতুন ধরণ পত্তন করে। রাজারাণী যা করে, অভিজাতরাও তারই অনুসরণ করে। ফলে ফ্রেঞ্চ কোর্টে আলুর ফুল ফ্যাশন ট্রেন্ড হয়ে গেল। পারমেনটিয়ের এ সুযোগে কিছু রাজকীয় ভোজের ব্যবস্থা করে ফেলল। মেনু আলুময় অর্থাৎ প্রতিটি ডিশ আলু দিয়ে তৈরি, যেমন আলুর সুপ, ফ্রাইড আলু, আলুর তরকারি— ইউ গেট দা পিকচার।
অভিজাতদের মাঝে আলু খাওয়া ফ্যাশনেবল হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু জনসাধারণ তখনো বেঁকে বসে আছে। এবার পারমেনটিয়ের রিভার্স সাইকোলজির আশ্রয় নিল। সোজা আঙুলে যদি ঘি না উঠে তো আঙুল বাঁকা করতেই হবে। পারমেনটিয়ের প্যারিস শহরের একপ্রান্তে ৫০ একরের মতো জমিতে আলু চাষ করল। সে জমি একেবারেই পোড়ো, অনুর্বর, কিছু সেখানে ফলত না। হাইপ বাড়াবার জন্য পারমেনটিয়ের দিনেরবেলায় সেখানে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করল। তাতে আশেপাশের লোকের খুব কৌতূহল হল— কী এমন চাষ হচ্ছে যে এত কড়া পাহারার প্রয়োজন? নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সবসময় বেশি। রাতে গার্ডরা বিদায় নিলে লোকজন গাছ চুরি করে নিজেদের জমিতে লাগাতে থাকে। এভাবেই আলু ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের টেবিলে দেখা যেতে থাকে।
১৬০০ এর পরে আলু চায়নাতে যায়। মিং ডায়নাস্টির রাজারা আলুকে সাদরে গ্রহণ করে।
ভারত উপমহাদেশে আলু প্রবেশ করে ১৬৭৫ এর দিকে পর্তুগীজদের হাত ধরে। তারা আলুকে বলে বাটাটা। সে নাম এখনও চালু আছে।
বাংলায় আলু চালু করে ইংরেজ বণিকেরা।
আলুকে সবশেষে সমাদর করে আমেরিকা। ১৬২১ সালে আলু নর্থ অ্যামেরিকায় প্রবেশ করে। তারপর বহুবছর ধরে আলুকে ঘোড়ার খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে আসা হয়েছে। এরপর লুথার বারবাঙ্ক আলুকে জাতে উঠানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। এই হরটিকালচারিস্ট এক আলুর হাইব্রিড উৎপাদন করে। তারপরে সেটা ঘরে ঘরে খাবার টেবিলে দেখা যেতে থাকে।
যত দিন যেতে থাকে আলু তত জনপ্রিয় হতে থাকে। একসময় পৃথিবীর অন্যতম খাদ্য হিসেবে গণ্য হয়।
এরমাঝেও আবার বিপত্তি দেখা দেয়। যেমন ১৮৪০ এর পটেটো ব্লাইট। এ ফাঙ্গাস আলু উৎপাদনের বারোটা বাজিয়ে পটেটো ফেমাইনের সৃষ্টি করেছিল। শুধুমাত্র আয়ারল্যান্ডেই ১ মিলিওন লোক মারা যায় তাতে।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উদ্ভাবনের গল্পটা বেশ মজার। ফিরে যাই লুই ফিলিপের কোর্টে (১৮৩০- ১৮৪৮)। রাজপাচকের নাম কলিনেট। একরাতে কলিনেট রাজার খাবার তৈরি করে বসে আছে। রাজা খেতে আসতে দেরী করে, ততক্ষণে খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কলিনেট গনগনে গরম তেলে আগের ভাজা আলুগুলি ছেড়ে দিতেই সেগুলি ছোট ছোট বেলুনের মত ফুলে উঠে। খেয়ে তো রাজা মহাখুশি। এভাবেই পাফড পটেটো বা পটেটো সুফলের জন্ম হয়। থমাস জেফারসন পরে হোয়াইট হাউসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাবার প্রচলন করে।
পটেটো চিপসের গল্পটাও কম মজার না। ভ্যানডারবিল্ট সাহেব বিরাট ধনী, রেলওয়ে ম্যাগনেট। একবার সে এক নামকরা রিসোর্টে উঠে। কিন্তু সকালে ব্রেকফাস্ট এ বসে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কী মোটা মোটা করে আলু কেটেছে দেখ না, ভিতরে স্বাদ মোটেই ঢোকেনি। বিরক্ত হয়ে সে কিচেনে খাবার ফেরত পাঠায়। খাবার ফেরত আসা মানে শেফের অপমান। তারও মেজাজ গনগনে হয়ে উঠল। ‘আচ্ছা দেখে নেব’ মনোভাব নিয়ে শেফ একদম পাতলা করে আলু কাটলো। সেগুলি গরম গরম তেলে ভাজলো, লবন ছিটিয়ে দিল, তারপরে ভ্যানডারবিল্টের সামনে ধরল। খেয়ে ভ্যানডারবিল্টের মুখে হাসি ফুটে উঠল। এদিকে শেফ তার নতুন ডিশ পেয়ে গেল— সারাটোগা ক্রাঞ্চ চিপস। সে থেকে পটাটো চিপসের জনপ্রিয়তা বাড়তেই আছে।
আলুর আরো খবর
— আলুর ইংরেজি নাম পটাটো এসেছে স্প্যানিশ নাম পাটাটা থেকে।
— আলুর ৮০% পানি।
— আলুতে কার্বোহাইড্রেট ছাড়াও প্রোটিন, ভিটামিন বি, সি ও অনেক মিনেরালস আছে।
— পৃথিবীতে চাল, গম ও ভুট্টার পরেই আলুর চাহিদা।
— আলুর জাতভাইরা হচ্ছে টোমেটো, ক্যাপসিকাম আর বেগুন।
— আলুর সবচেয়ে বেশি ওজন হয়েছিল ৮ পাউন্ড— একটা নবজাতকের সমান।
— আলু সবচেয়ে বেশি উতপাদন হয় চায়নাতে। চায়না আর ইন্ডিয়া মিলে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ আলুর চাহিদা মেটায়।
— আলুর রঙ সাদা, হলুদ, লাল, বাদামি এমনকি বেগুনীও হতে পারে।
— পৃথিবীতে ১০০০ এর বেশি ধরণের আলু পাওয়া যায়।
ছবি- ইন্টার্নেট থেকে
Views: 344