আইনপাড়ার আইনজীবীদের সম্পর্কে আমরা সাধারণ মানুষ কিছু ধারণা পোষণ করি- উকিলরা মিথ্যা বলে, দু’পক্ষের রেষারেষির জেরে সুযোগ পেলেই মক্কেলকে শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। এমন নানান অভিযোগ! এর সব যে মিথ্যাে তা নয়। তবে এটাও ঠিক আইন অঙ্গনে এমন অনেক মানুষ ছিলেন, আছেন সততাই যাঁদের জীবনের একমাত্র মূলধন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তবে কি অপরাধী মক্কেলদের পক্ষে লড়াই করা আইনজীবীরা অন্যায় কাজ করেননি?
এমন প্রশ্নের উত্তরে কলকাতার সর্বশেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিখ বারওয়েল বলেছিলেন-
“সর্বযুগের খ্যাতি সম্পন্ন ফৌজদারি ব্যারিস্টার মার্শাল হল বলতেন- All my geese are swans (আমার সব কানা ছেলেই পদ্মলোচন)। আসামীদের পক্ষে সমর্থন করতেন তিনি। ব্রীফ হাতে করলেই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাতো, মক্কেল নিরপরাধ।”
এমন আইনজ্ঞদের ইতিহাস জানবার অভিপ্রায়ে পড়তে বসেছিলাম বাংলার দাপুটে লেখক মনিশংকর মুখোপাধ্যায় এর কালজয়ী ক্লাসিক সাহিত্য
“কত অজানারে”।
সে কোন আদ্যিকালে- লর্ড নর্থের রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে সূচিত হয় কলকাতার সুপ্রীম কোর্টের কর্মযজ্ঞ। এরই সূত্রে বিলেত থেকে আসতে থাকেন জজসাহেবরা। তাদের পিছুপিছু আসেন এটর্নি, ব্যারিস্টাররা। বিলেতের আইনব্যবস্থাকে এদেশে চালু কিংবা অর্থের আকর্ষন সে যে কারণেই তারা এসে থাকুক না কেন তাদের মাধ্যমেই কলকাতা বারের গৌরবময় ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
সেই সুদূর অতীতে যখন আইনের শাসন ছিলো না তখন মানুষের মনোভাব এমন ছিল যে, ‘লাঠি থাকতে আদালত কি?’ এই উদ্ভট পরিস্থিতির উত্তোরণে ইংরেজ আইনজ্ঞরা এগিয়ে এলেন। তৈরি হলো বুদ্ধিজীবী লেঠেল সম্প্রদায়, যাঁরা আইনের লাঠি চালিয়ে জীবন ধারণ করেন। ইতিহাসের রথচক্রে আবর্তিত হতে হতে উড্রফ, গ্রিফিথ ইভান্স, উইলিয়াম জ্যাক্সনের মতো বিজ্ঞ আইনজ্ঞদের শেষ আলোকবর্তিকাবাহী ছিলেন নোয়েল ফ্রেডরিখ বারওয়েল।
কলকাতার শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার। বারওয়েল সাহেবের পূর্ব পুরুষেরাও ভারতবর্ষে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তাই পেশাগত সম্পর্ক ছাড়াও ভারতবর্ষের প্রতি তিনি আন্তরিক টান অনুভব করতেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পরিবর্তী সময়ে মিলিটারি ডিউটিতে এসে একসময় কলকাতা কোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে কর্মপরিধি বিস্তৃত করেন তিনি।
সে সময়ে ডুয়াল সিস্টেম (খুব সম্ভবত) এ বিচারকার্য পরিচালিত হতো। পদ্ধতিটি এমন ছিল যে, হাইকোর্টে মামলা করতে এলে মক্কেলকে প্রথমে এটর্নির কাছে যেতে হবে। এটর্নি কেসটা ঠিকঠাক করে ফাইল তৈরি করবেন। এরপর ব্যারিস্টারকে ব্রীফ পাঠাবেন জজের সামনে মামলা করবার জন্য। অর্থাৎ ব্যারিস্টার মক্কেলের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখতে পারবেন না। সব কাজ এটর্নির মাধ্যমে করতে হবে।
আদালত চত্বরে ব্যারিস্টারের সহকারী ক্লার্ক পরিচিত ছিল বাবু নামে। কার্তিকের যেমন ময়ূর, তেমনি সিপাহীর ঘোড়া, হাতির দাঁত, গণেশের ইঁদুর, মহাদেবের ষাঁড়, উকিলের মুহুরী আর ব্যারিস্টারের বাবু।
জীবন ও জীবিকার তাগিদে ব্যারিস্টার বারওয়েল সাহেবের ক্লার্ক বিভূতি বাবুর হাত ধরে কলকাতা হাইকোর্ট চত্বরে পা রেখেছিলেন সুলেখেক শংকর। মনিশংকর থেকে শংকর নামকরণ বারওয়েল সাহেবই করেছিলেন। সেদিন অচেনাকে চেনা আর আজানাকে জানাই ছিল শংকরের জীবিকার অপরিহার্য অঙ্গ। সেই সন্ধান পেতে গিয়ে আইনের কলেবরের পাশাপাশি তিনি জীবনের এক মহা ঐশ্বর্যময় দিকের সন্ধান পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চিত হয়েছিল অসংখ্য জীবনের হৃদয়গ্রাহী ও হৃদয়বিদারক আখ্যান।
ব্যারিস্টার সাহেবের আন্তরিক সাহচর্যে কাজ করতে গিয়ে কোর্ট চত্বর এবং এর বাইরের পরিবেশ থেকে অজানা, অচেনা অনেক মানুষের অন্তহীন শোভাযাত্রা বিস্মিত ও অভিভূত চিত্তে লেখক প্রত্যক্ষ করেছেন। শংকর তাঁর আটপৌরে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে স্মৃতির সমৃদ্ধ এলবাম থেকে পরম যত্নে একে একে আমাদের শুনিয়েছেন সেইসব গল্প।
লেবাননে জন্ম নেয়া খ্রীস্টান পরিবারের মেয়ে মেরিয়ন স্টুয়ার্ড ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ডকে বিয়ে করে প্রতারিত হয়েছিলেন। নানান উপায়ে ভারতবর্ষে পা রাখা মেরিয়ন পূর্বাঞ্চলের এক দেশীয় নবাবের তরুণ এ.ডি.সি মহীউদ্দিনের প্রণয়গ্রাহী হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গুপ্তচরবৃত্তির অহেতুক সন্দেহে নবাবের প্ররোচনায় সে সংসারও টেকেনি। জীবনে প্রয়োজনে এরপর আবারও অন্য এক যুবরাজের সাথে বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতার অবসান ঘটাতে মেরিয়ন দ্বারস্থ হন ব্যারিস্টার সাহেবের। শংকর জানিয়েছিলেন মেরিয়ন অবশেষে সেই যুবরাজের সাথে সংসার পেতেছিলেন রাণী মীরা আদিত্যনারায়ণ নামে।
হাইকোর্টেের বিস্তৃত জগতে চলতে গিয়ে শংকর বাবু পরিচিত হন ব্যারিস্টার সেন’র বাবু ছোকাদার সাথে। যার সাহচর্যে এই কোর্ট পাড়ার অনেক প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা ব্যারিস্টারদের জীবন কাহিনী জানতে পারেন লেখক।
অর্থ সম্পদ, প্রেমময়ী স্ত্রী, সন্তান সব থাকা সত্ত্বেও কালো গাউনের মায়ায় পরে সংসারের বাঁধন থেকে আলগা থাকেন ব্যারিস্টার সুব্রত রায়। সব থেকেও তাঁর জীবনে শূণ্যতার হাহাকার পাঠক মনকেও দগ্ধ করে।
সুব্রত রায়ের এই হাহাকারকে দারুনভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন ব্যারিস্টার রেম্পিনি। তিনি বলেছিলেন, “এ লাইনে সংসার পাতাও ঠিক নয়। তাতে হয় সংসার, না হয় তোমার প্রফেশন অবহেলিত হবে।”
সে আশংকায় সংসার না পাতা দোর্দন্ড ব্যারিস্টার মিস্টার উইলমট ড্যানিয়েল রেম্পিনির জীবনও কি কম চড়াই উৎরাই এর! চোদ্দ বছরের ছেলে রেম্পিনি বেয়ারার কাজ করতেন লন্ডনের প্রখ্যাতনামা ব্যারিস্টার স্যার হেনরী লং এর চেম্বারে। নিজের বুদ্ধি বৃত্তিক চৌকসতায় দিনে দিনে হয়ে উঠেন দাপুটে ব্যারিস্টার। কিন্তু আইনের মোহের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে গিয়ে সংসারের মায়া পাওয়া হলো না তাঁর।
নিবেদিতপ্রাণ ব্যারিস্টারদের সম্পর্কে ছোকাদা ঠিকই বলেছিলেন, “ওই কালো গাউনের মোহ বহু ব্যারিস্টারকে সংসার থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছে।”
ছাত্র জীবনে প্রচন্ড তূখোড় ও প্রতিভাবান বীরেন বোস ছিলেন বারওয়েল সাহেবের বন্ধু। সাংসারিক অশান্তিতে পারিবারিক ও পেশাগত জীবন ধ্বংস হয়ে যায় ব্যারিস্টার বোস’র। বারওয়েল সাহেব বলেছিলেন, “বাইরে জীবনদেবতার সঙ্গে যুদ্ধের অনুপ্রেরণা ও উদ্যম অন্দরমহল থেকে আসা চাই, নচেৎ বীরেন বোসের মতো অবস্থা।”
লেখকের লেখনীতে সেই করুণ কাহিনী জেনে পাঠক মাত্রই আপ্লুত হবেন।
প্রতারক প্রেমিককে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে লেডী টাইপিস্ট হেলেন গ্রুবার্টের কর্মকান্ড জেনে অবাক না হয়ে উপায়ান্তর নেই যেন! এই ঘটনার শেষটুকু জেনে আমি নিশ্চিত পাঠক মাত্রই পুলকিত হবেন।
সামাজিক কষাঘাতে অবহেলিত, নিগৃত, ঘরকুনো মেয়েদের পাশাপাশি আমাদের সমাজে এমনও মেয়ে আছে যারা বারবার আঘাত পেয়েও হতোদ্যম হয় না। বার বার তারা ঝড়ের মাঝেও জীবনপদ্মের পাপড়িগুলো মেলে ধরতে চায়। স্বাদ পেতে চায় রূপ-রস-গন্ধ-গানে ভরা জীবনের।
সুনন্দা তেমনই এক নারী। যার জীবন প্রবাহ বারওয়েল সাহেবের বর্ণনায় লেখক দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ব্যারিস্টার সাহেবের অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ ঝুলি থেকে গল্প শুনিয়ে তাঁর নিত্য সহচর শংকরকে তিনি দিনে দিনে ঋদ্ধ করে তুলেছিলেন। সে গল্প থেকে উঠে আসা সাহেবের ড্রাইভার প্রভাত মন্ডলের সাহসী ছেলে নরেনের গল্প নিঃসন্দেহে সাহসীকতার আখ্যান বটে। রাণীক্ষেতের মিস্ ট্রাইটানের একাকীত্বের গল্পও পাঠক মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলবে।
ছদ্মনামে আরতি রায়ের গল্প তৎকালীন হিন্দু বিবাহ আইনের নিষ্ঠুরতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে।
সমাজে একটি ধারণা প্রচলিত আছে, অভিশপ্ত সম্পদ নাকি বংশ পরম্পরায় টিকে না। হয়তো তাই ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকা সত্ত্বেও মিস্টার গোল্ড ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন নির্বাহ করেন।
এমনসব গল্পও উঠে এসেছে লেখকের চমৎকার বর্ণনায়।
বারওয়েল সাহেব একবার ক্রিমিন্যাল কেস করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। সেখানেই আরেক মামলা পান বৃদ্ধ খগেন বাবুর বড় ছেলে রবীন্দ্র কলিতার। ফাঁসির দন্ডাদেশ থেকে রবীন্দ্রকে বাঁচাতে না পারার সেই নিদারুন বর্ণনা উঠে এসেছে শংকরের সমৃদ্ধ লেখনশৈলীতে।
একদিকে জন্মসূত্রে তৈরি রক্তের সম্পর্ক আর অন্যদিকে লালনসূত্রে তৈরি মমত্বের বন্ধনের নিগূঢ় টানের এক অসামান্য গল্প নিজের স্মৃতি থেকে নিপূণভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক। জাহাজ কোম্পানির প্রতারণার স্বীকার হওয়া নিকোলাস ড্রলাসের মর্মস্পর্শী কাহিনী পড়ে পাঠক মন বেদনাপ্লুত করতে বাধ্য।
শংকরের সুনিপুণ লেখনকৌশলে এমন আরো অনেক গল্পের মায়াজালে আটকে পড়ে পাঠক মন।
সময়ের হাত ধরে নশ্বর জীবন একদিন থমকে দাঁড়ায়। চিরসত্য বাস্তবতা নির্মম সূরে ঘোষণা করে, “বেলা যে পড়ে এল জলকে চল!”
জীবন আয়ু ফুরিয়ে যায় অনন্যসাধারণ ব্যাক্তিত্ব, দয়ার পরাকাষ্ঠা, মহৎ হৃদয়ের অধিকারী কলকাতার সর্বশেষ ইংরেজ বিজ্ঞ ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিখ বারওয়েল সাহেবের।
নিবেদিতপ্রাণ সহচরী শংকর লিখেছেন, বেদনার আতিশয্যে ব্যারিস্টার সাহেবের মৃত্যুর সংবাদে তিনি কাঁদতে পারেন নি। বজ্রাঘাতে জল যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নগণ্য পাঠক আমি! আমার চোখ জলে ভরে উঠেছে। আইনের ইতিহাসের এমন অসাধারন ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই অন্তরের সবটুকু আরাধনা দিয়ে।
অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং অসাধারন লেখনীশক্তির সাহায্য লেখক শংকর অনুভূতির তন্ত্রীতে আলোড়ন তুলে লিখেছেন কালজয়ী ক্লাসিক সাহিত্য “কত অজানারে”।
বইটি পড়া শেষ করে দীর্ঘক্ষণের একটি ঘোর কাটিয়ে প্রতিটি পাঠকহৃদয় নিজের অজান্তেই ভাবতে বাধ্য হবে- কত অজানারে………
বইয়ের নাম : কত অজানারে
লেখক : শংকর
প্রকাশক : নিউ এজ পাবলিশার্স,
৮/১ চিন্তামণি দাস লেন।
প্রচ্ছদ : সৌম্যেন দাস
Views: 329