রামায়নের কবি বাল্মীকি ডাকাত ছিলেন বটে তবে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণের ছেলে। সে কারণে তার দোষ অনেকটা মাফ পাওয়ার মতো কিন্তু তাই বলে একটা ডোম বংশজাত সন্তানের তো কবি হওয়া চলে না। বিধাতার এ কেমন নিয়ম!
তবু বিধাতার নিয়ম অনুযায়ী ডোমের ছেলে নিতাই কবি হয়ে উঠলো। তবে শহর অঞ্চলে ডোম বলতে যাদেরকে বোঝায়, নিতাইয়ের জন্ম সে ডোম বংশে নয়। এ ডোমেরা বাংলার বিখ্যাত লাঠিয়াল। প্রাচীণকাল হতে বাহুবলের জন্যে এরা ইতিহাসবিখ্যাত। নবাবী পল্টনে তারা বীরত্বে বিখ্যাত থাকলেও কোম্পানী আমলে চাকুরীচ্যুত হয়ে এরা পেশাদার ডাকাত হয়ে উঠে।
নিতাইয়ের নানা ও মামা ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে জেলে যায়। নানা জেলেই মারা গেলেও পাঁচ বছর পরে মামা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গ্রামে ফিরে এসে আবার ডাকাত সর্দার হয়। মামাতো খালাতো ভাইয়েরা ডাকাত। সুতরাং অনিবার্যভাবেই নিতাইয়েরও ডাকাত হওয়ার কথা যদি মায়ের দিকে যায়। বাবার দিকে গেলে পেশাটা আরো নীচে নেমে যেত। মুখ দেখানো যেতো না কারণ তার বাবা ছিলেন বিখ্যাত চোর আর দাদা ঠাঙারে।
নিতাই তবু চোর বা ডাকাত কোনটাই হলো না, হলো কবি। তার তিন বছরের স্কুলের পাঠের উপর ভর করে সে শিশুবোধ রামায়ণ পড়েছিল। তা তার কাজে লাগলো।
গ্রামে গ্রামে তখন মেলা বসে। অন্যান্য অনেক কাজের মাঝে বাধ্যতামূলক অংশ হতো কবি গানের লড়াই। পূরানের দুটো চরিত্র দু’জনকে দেওয়া হতো। সে চরিত্রের কার জয় হয়, সেটা দেখার জন্যে মেলায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ দর্শক সারা রাত্রি কবিদের লড়াই দেখতে বসে যেতো।
অট্টহাস নামে একটি গ্রামে একবার মেলা বসলো। সেখানে উপস্থিত থাকার কথা কবিয়াল নোটনদাস আর মহাদেব পাল। গতবছরেরসহ এবছরের পাওনা মেলার আগেই পরিশোধ করার কথা থাকলেও, সেটা বুঝে না পেয়ে নোটনদাস রাতে অন্যত্র পলায়ন করলে কবি লড়াই ভন্ডুল হওয়ার পথে। এরকম সময় উদ্ভব হন আমাদের নায়ক নিতাই। সে ডাকাত হতে অস্বীকার করায় তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং রেল স্টেশনে বন্ধু রাজলালের কৃপায় একটা ঘর জোটে। কুলির একটা স্বাধীন পেশাও সে পায়।
অট্টহাসের সে মেলায় নোটনদাসের অনুপস্থিতিতে সে তার জায়গায় লড়াই করে। মহাদেব সাহার সাথে সে পেরে উঠে না বটে কিন্তু চমৎকার লড়াইয়ের কারণে তাকে লোকজন “নিতে”, “নিতো”, ”নেতাই” থেকে একেবারে “নিতাইচরণ” বলে ডাকা শুরু করে। শহর থেকে আসা বাবু পর্যন্ত তাকে বলে, “ You are Poet”. নিতাই সে শব্দের মানে বোঝেনা । মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন বাবু বলেন, ”তুই বেটা কবি। খবরদার আপন গোষ্ঠীর মত চুরি-ডাকাতি করবি না।”
প্রথম কবি লড়াইয়ে তার যে বংশপরিচয় নিয়ে তাকে আঘাত করে মহাদেব পাল, তা পাঠকের উদ্দেশ্যে দেওয়া যায় তাহলে তাকে চেনা সহজ হবেঃ
”সুবুদ্ধি ডোমের পোয়ের কুবুদ্ধি ধরিল।
ডোম কাটারি ফেলে দিয়ে কবি করতে আইল।।
ও বেটার বাবা ছিল সিঁদেল চোর, কর্তা-বাবা ঠ্যাঙারে।
মাতামহ ডাকাত বেটার-দ্বীপান্তিরে মরে।।
সেই বংশের ছেলে বেটা কবি করবি তুই।
ডোমের ছাওয়াল রত্নাকর, চিংড়ির পোনা রুই।।
বাংলার সমগ্র অশিক্ষিত সম্প্রদায়ই কবিগানের ভক্ত ছিল। কিন্তু সে ভক্তি তাদের অশ্লীল রসিকতার প্রতি আসক্তি। নিতাইয়ের আসক্তি অন্যরূপ। পুরান-কাহিনী, কবিতার ছন্দমিল এবং উপস্থিত বুদ্ধির চমক দেওয়া কৌতুকও তার ভাল লাগে।
তার আশ্রয়দাতা রাজলাল, যাকে রাজা বলেই জানে সবাই, তাকে সে একান্ত ভক্ত হিসেবে পেল। রাজার ঠাকুরঝি গাঁয়ের ষোল-সতের বছরের বধূ। মাথার উপরে সোনার রঙের রূপোর কলস বসিয়ে সে এ গ্রাম সে গ্রাম দুধ বেঁচে বেড়ায়। এক হাতে মাপের গেলাস নিয়ে আর অন্য হাত দুলিয়ে সে হাঁটে। মাথার কলস ধরা লাগেনা। এই শৈল্পিক হাঁটা আর কালো বর্ণের ঠাকুরঝিকে দেখে তার মন কেমন করে। আবার সে এটাও জানে পরস্ত্রীর দিকে তাকানো ভীষণ অন্যায়। ঠাকুরঝিকে সবাই কালো বলে দুঃখ দেয় বলে নিতাই তাকে বাঁচাতে কবিতা গায়ঃ
”কালো যদি মন্দ হবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?
কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছো কি নয়নে?”
নেতাই থেকে নিতাইচরণ হওয়ায় তার আয় বাড়লো না তবে কুলির কাজও আর করতে পারলো না সে। হাজার হোক সে একজন Poet. আস্তে আস্তে তার জমানো পুঁজি কমতে থাকলো আর ভালবাসা বাড়তে থাকলো ঠাকুরঝির প্রতি। এরই মাঝে কখনো কখনো তার কবি লড়াইয়ের দাওয়াত আসে। বেঁচে থাকার জন্যে সে সিদ্ধান্ত নেয় পান বিড়ি আর সিগারেটের দোকান দেওয়ার কিন্তু কিছুতেই সে আর মাথায় করে কুলির মত মোটে টানবে না। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে, সে ডোম বংশজাত। অত্যন্ত নিঁচু জাতের। তার হাতের স্পর্শে কেউ সেগুলো কিনবে না। তার জাত দিয়েই তৎকালীন সমাজের শ্রেণী বৈষম্য, জাত-পাত দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।
এরই মাঝে একদিন ট্রেন থেকে রাজা নামিয়ে আনে ঝুমুর দলের শিল্পীদের। তাদের নিয়ে রাতে স্টেশনে গানের আসর বসে। নিতাইয়ের গানে সবাই মুগ্ধ হয়। ঝুমুর দলের মালিক এক প্রৌঢ়া। তিনি তাকে তাদের দলে নিতে চান। দালটি পূর্বকালে অন্য জিনিস ছিল কিন্তু এখন নিম্ন শ্রেণীর বেশ্যা গায়িকা এবং কয়েকজন যন্ত্রীই তার সম্বল। মাঝরাতে ঝুমুর দলের গানের সময়ই দলের অন্যতম সদস্য বসন্ত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সে গিয়ে আশ্রয় নেয় নিতাইয়ের ঘরে। বাইরে খদ্দেররা জটলা পাকায়। নিতাই ঘরে গিয়ে অসুস্থ বসন্তের মাথায় পানি দেয়। জানালা দিয়ে সেটা দেখে ভুল বোঝে ঠাকুরঝি। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যায় সে।
ঠাকুরঝির বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে স্টেশন থেকে চলে যায় নিতাই। ঝুমুর দলের সাথে যোগ দেয়। সেখানেই সে বসন্তকে বিয়ে করে। যতক্ষন বসন্ত খদ্দের নিয়ে থাকে সে গাছতলায় গান রচনা করে, খদ্দের বিদেয় হলে সে আশ্রয় নেয় বসন্তের সাথে। ঝুমুর দলের সাথে গান করে বেশ নাম ডাক হয় নিতাইয়ের।
ঝুমুর দলকে দিয়েই ফুটে উঠে পতিতা শ্রেণীর জীবন, যারা দেহ বিক্রয় করে বেঁচে থাকে সারাটি জীবন। এই পতিতা বৌয়ের প্রতি নিতাইয়ের ভালবাসা পাঠকের কাছে তাকে শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলে। তাদের কোন ঠিকানা না থাকায় তারা সারাটি বছর এ মেলা, সে মেলা ঘুরে বেড়ায়। পুজা অর্চনা করে । মদ খায়। খদ্দের নিয়ে পড়ে থাকে। হঠাৎ করেই নিতাই জানতে পারে বসন্ত আর বেশি দিন বাঁচবে না। তার যক্ষা রোগটিকে আড়াল করার জন্যে আগে পান খেতো খুব বসন্ত। কাশির সাথের রক্ত পানের লাল রঙের সাথে মিশে যেত। হাজারো সেবায় অসুস্থ বসন্তকে বাঁচাতে পারেনা নিতাই ।
বসন্তকে হারিয়ে সে একটি বার ঠাকুরঝিকে দেখতে চায়। গ্রামে ফিরে সেখানে ঠাকুরঝির মৃত্যু সংবাদ পায়। বদলে যাওয়া গ্রামের চিত্র দেখতে পায়।
”কবি” একটি উপন্যাস। এটা পড়ে পাঠকের উপন্যাস মনে হবে না। মনে হবে আমরা যেন সমাজেরই বাস্তব ইতিহাসের পথ ধরে চলেছি। প্রাচীণ বাংলার এতিহ্য, বাঙালীর সমাজ জীবন দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই উপন্যাসের প্রধান সাফল্য হলো পাঠককে বেঁধে রাখা। গল্প বলার ঢং আর একের পর এক চরিত্র সৃষ্টি করে লেখক একটা মোহনীয় পরিবেশ তৈরি করেন। এক নিঃশ্বাসে পড়ে উঠতে মন চায়। পাঠক আবশ্যিকভাবে চরিত্রগুলোকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। উপন্যাস শেষের দিকে যেতে থাকলে মন খারাপ হতে থাকে । মনে হয়, কেন আর একটু দীর্ঘায়িত হলো না।
বইয়ের নাম- কবি
বইয়ের ধরণ-উপন্যাস
লেখক- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ- সৌরভ মাহমুদ
মূল্য- দুই শত টাকা মাত্র
Views: 456