যখন খুব ছোট ছিলাম তখন কাকদের দলবেঁধে কা-কা ডাক শুনলেই আম্মাকে দেখতাম মুসিবতের দোয়া পড়তেন। বলতেন, ” আল্লাহই জানেন কে মারা গেল।”
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটতোও তাই। কাক কুলক্ষণে নয় কিন্তু মৃতের সাথে তার একটা যোগসাজশ আছে। সে বিষয়ে পরে আসছি। আগে মজার কয়েকটা তথ্য জানা দরকার। আপনার প্রিয় রঙ কি? নিশ্চয় কালো নয়। কালো মানুষকেও আমরা কাওয়া বলে ডাকি। শুধু কি কাকের রঙ কালো বলেই, কেউ কালো রঙ পছন্দ করেনা! হতে পারে। তবে কাবা শরীফের গেলাফও তো কালো, কাবা শরীফে যে পাথরে চুমু খেতে এত প্রাণপণ চেষ্টা সেটারও তো বর্তমান রঙ কালো। সে যাহোক, অধিকাংশ মানুষেরই প্রিয় রঙ কালো নয়।
কাক কিন্তু খুব চালাক আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পাখি। এদের রয়েছে খুব শক্ত বিচারিক ব্যবস্থা। ধরুণ, একটা কাক অন্যের বাসার খাবার চুরি করেছে, চুরি করতে গিয়ে বাসা তছনছ করেছে। তার শাস্তি হলো, তাকে নষ্ট করে ফেলা বাসার পরিবর্তে একটা নতুন বাসা তৈরী করে দিতে হবে। তাকে ঘিরে চারিদিক থেকে কাকেরা ভর্ৎসনা(অপমান) করবে আর তাকে নীরবে সহ্য করতে হবে। আবার যদি কোন কাক অন্যের স্ত্রীর সাথে গোপণ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাহলে কাক আইনানুযায়ী তার শরীরের সব পালক ঠুকরে তুলে দিয়ে বাচ্চা কাকের মত ন্যাড়া করে দেওয়া হবে। তাদের আইনে মৃত্যুদন্ডও আছে। অপরাধী কাককে চারিদিক থেকে ঘিরে অন্য কাকরা ঠোকর দিয়ে দিয়ে মুত্যুদন্ড কার্যকর করে। তবে তারা মনে করে, অপরাধ কাকের, মৃতদেহের নয়। তাই তারা মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা কাকটাকে স্বসম্মানে কবরস্থ করে।
লোকে বলে গাছে বেল পাকিলে/ তাতে কাকের কি! কাকের অনেক কিছু। কারণ, পাকা বেল গাছ থেকে পড়ে ফেটে গেলে তা কাকের প্রিয় খাদ্য। কাক আপনার সাবান চুরি করে বটে কিন্তু কখনোই সেটা মাখেনা। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, আপনার বয়স বাড়লে চুল-দাঁড়ি পাকে কিন্তু কাকের বয়স বাড়লেও তার পালক কালোই থাকে, পাকেনা।
মুরগীর বাচ্চা ধরার সময় দুটো কাক একসাথে যায়। বাচ্চার দু’পাশে দু’জন বসে। একজনকে ঠোকর দিতে মা মুরগীটা তেড়ে গেলে দ্বিতীয় কাকটি একটা বাচ্চা তুলে নেয়। যখন বাচ্চার চিৎকারে মা মুরগীটি এই কাককে তেড়ে আসে তখন প্রথম কাকটি অন্য বাচ্চা তুলে নেয়। এভাবে দুটো কাকই বাচ্চা নিয়ে উড়ে যায়। কোকিল কাকের দেখানো পদ্ধতিতেই তাকে ঠকায়। পুরুষ কোকিল কাকের বাসার কাছে আসে। তখন নিজের ডিম অরক্ষিত রেখে দুটো কাকই পুরুষ কোকিলকে তাড়তে তাড়তে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। এই সুযোগে মা কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। যে কয়টি ডিম পাড়ে, কাকের সে কয়টি ডিম বাসা থেকে ফেলে দেয়। অতি চালাক কাক, কিছুই না বুঝে, ডিমে তা দেয়, বাচ্চা ফোটায়। বাচ্চা হলেও কোকিলের বাচ্চা চিনতে পারেনা।
যাহোক, কাক কিন্তু মানুষের শিক্ষক। আদম(আঃ) এবং বিবি হাওয়ার জোড়া জোড়া সন্তান হতো। প্রথম জোড়ায় হলো কাবিল এবং আকলিমা। দ্বিতীয় জোড়ায় হাবিল এবং লিথোয়ার। শরিয়তের বিধানানুযায়ী আকলিমার সাথে হাবিলের বিবাহ দিতে চান আদম(আঃ)। ইবলিশ ভুল বোঝায় কাবিলকে। বলে, আকলিমা সুন্দরী তুমি তার ব্যাপারে বেশী হকদার। কাবিল বাবাকে সেটা জানালে তিনি দু’জনকেই আল্লাহর রাহে কুরবানী করতে বলেন। হাবিল একটি ভেড়া কুরবানী দেন আর কাবিল দেন গমের কিছু দানা। নিয়ম ছিল, যার কুরবানি কবুল হবে, তারটা আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে। এভাবে হাবিলের ভেড়া ভস্ম হলে কাবিল হিংসায় ফেটে পড়লো। আকলিমা-হাবিলের বিবাহিত জীবনে আকলিমা গর্ভবতী হলে একদিন কাবিল তার ভাইকে হত্যা করে বসলো। হত্যার পর কাবিল অনুতপ্ত হলো। ভাইয়ের মৃতদেহ কাঁধে করে নিয়ে ঘুরতে থাকলো। কি করবে বুঝতে পারছিলনা। পাছে শকুন বা অন্য পশু তার মৃৃতদেহ খেয়ে ফেলবে, সেই ভয় পাচ্ছিল সে। তখন আল্লাহ কাককে নিদর্শণ দিয়ে পাঠালেন।
একটি কাক, অন্য একটি মৃত কাককে মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে কবর দিয়ে কাবিলকে শিক্ষা দিলো, কিভাবে মৃতদেহকে কবর দিতে হয়। একই পদ্ধতিতে এখনও কবর দেওয়া হয়। ঘটনাটি সূরা আল-মায়েদার ৩১ নম্বর আয়াতে বর্ননা করা হয়েছে,
” অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন, যেটা মাটি খুঁড়ছিল, যাতে তাকে দেখাতে পারে, কীভাবে সে ভাইয়ের লাশ গোপণ করবে। সে বলল, ‘হায়! আমি এই কাকটির থেকেও অক্ষম হয়েছি, যে আমার ভাইয়ের লাশ গোপণ করবো। অতঃপর সে লজ্জিত ও অনুতপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো।”
পৃথিবীর প্রথম মৃত মানুষটির সাথে কাকের সম্পর্ক ছিল বলেই কি আজো তাকে মৃতের বার্তাবাহক মনে করা হয়!
ছবি- পাতিকাক
House crow
Views: 128