গোয়েন্ডি’স বাটন বক্স
স্টিফেন কিং, রিচার্ড চিযমার
অনুবাদ: সুমিত শুভ্র
প্রচ্ছদ: আবরার আবীর
আফসার ব্রাদার্স
পৃষ্টা: ১০২
মুদ্রিত মুল্য: ১৭৫ টাকা
I recognise terror as the finest emotion and so I will try to terrorize the reader. But if I find that cannot terrify, I will try to horrify, and if I find that I cannot horrify, I’II go for the gross-out. I’m not proud.
—- Stephen king
মেইনের ছোট শহর ক্যাসেল রক। পৃথিবীর আর দশটা শহরের মত এ শহরেরও একি যাপিত জীবন। প্রতিদিনকার নিয়মমাফিক রুটিনে শহরের মানুষের দিন কেটে যায়। গোয়েন্ডি পিটারসন এই শহরে বাস করা বার বছর বয়সী এক টিনেএজ। তার বাবা বীমা অফিসে কাজ করে আর মা ক্যাসেল রক ফোর্ডে সেক্রেটারি পদে রয়েছে। যথেষ্ট সচ্ছল আর আদরে বড় হওয়া গোয়েন্ডি বেশ পরিমাণে স্থুলকায়। কিন্তু পারিবারিক জীবনে বাবা-মা এর দাম্পত্য-কলহ গোয়েন্ডির মানসিক সুখ যেন ক্রমশই কেড়ে নিচ্ছে। অথচ কিছু বছর আগেও এমন ছিল না। গোয়েন্ডি যখন মাত্র তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ত তখনো বাবা-মা দু’জন ভালবাসার হ্রদে ডুবে থাকত। দিনকে দিন যাপনের তিক্ততা সে ভালবাসাকে বিলিণের মত করে দিল। ইদানীং দু’জনের সহ্য ক্ষমতা জিরো লেভেলে এসেছে। প্রায় রাতেই প্রচুর পরিনামে মদ পান করে কলহের এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করে ঘরজুড়ে।
সময়টা ছিল ২২ আগস্ট, সাল ১৯৭৪। গোয়েন্ডির জীবনে এক অদ্ভুত ঘটনা আসলো যেটা বদলে দিতে পারে তার পুরো জীবনের রূপরেখা। প্রতিদিনকার মত সেদিনও গোয়েন্ডি ক্যাসেল ভিউ রিক্রিয়েশোনাল পার্কে যাওয়ার পথে। ক্যাসেল ভিউতে যেতে হলে তিনটি পথ রুট ১১৭, প্লেজেন্ট রোড আর সুইসাইড সিঁড়ি। গোয়েন্ডি রোজ প্রাচীন লোহায় বানানো এবং উপরের দিকে খাঁড়া ও আঁকাবাঁকা সুইসাইড সিঁড়ির তিনশতের উপরে ধাপ অতিক্রম করে পার্কে খেলার জন্য যায়। এতে করে যাতে তার শরীরটাও কমে সত্যি বলতে বন্ধুদের বিশেষ করে ফ্র্যাঙ্কি স্টোনের তার স্থুলতা নিয়ে টিটকারিতে গোয়েন্ডি চরম অতিষ্ঠ। ফ্র্যাঙ্কির সাথে মিলে কয়েকজন মেয়েও এখন গোয়েন্ডিকে গুডইয়ার বলে ডাকে। গুডইয়ার বিম্প বিশাল বড় বেলুনের মত বাতাসে ভাসে!
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার পর সে মনে মনে ভাবে তার স্থুলকায় শরীর কিছুটা হলেও চিকন হয়েছে। উপরে উঠে সে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে পার্কের দিকে। হঠাৎ পিছন থেকে একজন লোক তাকে ডাক দেয়। গোয়েন্ডি অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেল লোকটার কাছে, সত্যি বলতে এক সম্মোহনী শক্তির মতই লোকটি তাকে টেনে নিয়ে গেল। লোকটার পরনে কালো জিন্স, একটি কালো কোটের ভিতরে সাদা শার্ট, যেটির বাটন খোলা এবং মাথায় গাঢ় কালো টুপি। গোয়েন্ডি সাধারণত অপরিচিতদের সাথে কথা বলেনা। কিন্তু এ লোকটি এক অদ্ভুত ক্ষমতা বলে তাকে যেন বশ করছে ক্রমশ। নাম তার রিচার্ড ফ্যারিস। লোকটার কোনো বদ মতলব নেই তো?
কিন্তু মি. ফ্যারিস একটি মেহগনি কাঠের বাদামি উজ্জ্বল আভার বক্স গোয়েন্ডির হাতে দিয়ে কিছু কথা বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেন মুহুর্তে মিলিয়ে গেল। সিঁড়ির প্রায় একশ পঞ্চাশ ধাপের উপর রয়েছে পড়ে ছোট কালো টুপিটা।
গোয়েন্ডির জীবনে এই মেহগনি কাঠের বাদামি বাক্স কি রুপোর কাঁঠির মত ছোঁয়া নিয়ে আসবে নাকি ওই গাঢ় কালো টুপি এক অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়াবে গোয়েন্ডি পিটারসনের জীবনে?
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ
স্টিফেন কিং আর রিচার্ড চিযমারের নভেলা গোয়েন্ডি’স বাটন বক্স। নভেলার প্রেক্ষাপটে অনুবাদকের সাইনোপসিসে পাওয়া যায় যেখানে উল্লেখ রয়েছে প্রায় এক মাসের কিং আর চিযমারের হাতবদলের এক পর্যায়ে একটি গল্পের পুর্ণাঙ্গ নভেলা গোয়েন্ডি’স বাটন বক্স। এটা কোনো ভয়ংকর হরর নয় কিংবা থ্রিলারের টুইস্টে ভরা চেটেপুটে মন ভরানো বইও নয়। একদম সরলীকরণ করে বলা যায় এটি মানবিকতার বই। আমরা বিশ্বযুদ্ধগুলো নিয়ে দেখলে বুঝতে পারি পৃথিবীতে ক্ষমতার প্রায়োগিক ব্যবহারগুলো। একটু ইতিহাসে যাচ্ছি, ১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্ডিন্যান্ড বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে হানিমুনে গেলে সার্বিয়ার জাতীয়তাবাদী কর্মী গ্যাভরিলো প্রিন্সিপ যুবরাজকে স্ত্রীসহ হত্যা করে। এর এক মাসের মাথায় অস্ট্র-হাংগেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী নীতি আর ফ্যাসিস্টবাদীদের কর্মকাণ্ড যুদ্ধকে তরান্বিত করেছিল। প্রত্যেক অবস্থাতে ক্ষমতা অন্যতম উপাদান হিসেবে এসেছে মানবিক বিপর্যয়ের সময়গুলোতে।
গোয়েন্ড’স বাটন বক্স হল ক্ষমতার মোড়কে মানবিকতার উপাখ্যান। কিং সাহেব সুনিপুণ ভাবে দেখিয়েছে মানবিকতার গল্পগুলো কিভাবে বেড়ে উঠতে পারে। আমাদের এই ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি বছরের পৃথিবী যেন এক গোয়েন্ডি পিটারসন। যার হাতে রয়েছে মি. ফ্র্যারিসের দেওয়া বাদামী রঙের বাটন বক্স। যার ভালবাসা রয়েছে হালকা সবুজে আবৃত এশিয়ার জন্য অথবা গাঢ় সবুজ আফ্রিকা, কমলা ইউরোপ, হলুদ অস্ট্রেলিয়া, নীল উত্তর আমেরিকা অথবা বেগুনি দক্ষিন আমেরিকার মত। যে মায়ের মমতার মত তার প্রতি কোণা অক্ষত রাখতে চায়, যত্নে রাখতে চায় সবাইকে। কিন্তু তবুও আমরা বিশ্বযুদ্ধ পায়, আমরা ফ্র্যাঙ্কি স্টোনের মত ফ্যাসিস্টদের পাই। এভাবেই গোয়েন্ডি পৃথিবী হয়ে উঠে যেখানে ফ্র্যাঙ্কির মত ফ্যাসিস্টরূপী হিটলারদের থেকে মানুষকে বাঁচাতে সে বদ্ধপরিকর। এ জন্যই কিং সাহেব আরাধ্য আমার কাছে যিনি গল্পে গল্পে সমাজ থেকে শুরু করে হৃদয় এনে দিতে পারে গল্পের হাত ধরে।
গোয়েন্ডি’স বাটন বক্সে সুক্ষ্ম রসালো ভাবে তাই প্রেসিডেন্টের যৌন জীবনের স্কেন্ডেল থেকে রেসিজমের মত অনেক বিষয়ই দারুণ ভাবে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্যি বলতে এ জন্যেই এ গল্প মনে ধরেছে আমার। থিউরি বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে বের হয়ে যবে থেকে মানুষের কর্মে প্রায়োগিক ব্যবহার পেয়েছে তখনি তার উপযুক্ত স্বার্থকতা এসেছে। ঠিক ওট গাছের নিচে গুপ্ত স্থানে রাখা বাটন বক্সের কর্মের মত, গোয়েন্ডি’জ বাটন বক্স।
বন্ধু অলিভ আর গোয়েন্ডির বন্ধুত্বের যে টারনিং ছিল বেশ হৃদয়বিদারক। এখানে অলিভ যেন এক নিপীড়ত হাহাকার। আমাদের পৃথিবী যেন প্রতিনিয়ত গুমরে কেঁদে যাচ্ছে এক একটি অলিভকে হারানোর ব্যাথাতে। গোয়েন্ডি অলিভের সবচেয়ে কাছে থেকেও যেন চির অধরা হয়ে রয়ে গেল। যদি গোয়েন্ডি বাটন বক্স চেপে ওজ্, নারীনা অথবা হবিটিয়ানে যেত অলিভ তার সঙ্গী হয়ে হয়তো পেত নতুন রূপকথা।
কিং সাহেবকে নিয়ে আমি কি আর বলব। তার প্রত্যেকটি বই আমার কাছে মেহগনি কাঠের বাদামি উজ্জ্বল আভার বাটন বক্স। যার মাধ্যমে আমি যেতে পারি তার রচিত কাল্পনিক শহর মেইনে আর দেখতে পারি এক একটা অলৌকিকতার কাহিনী। স্টিফেন কিং আমার কাছে তাই আজীবন রিচার্ড ফ্যারিস। মহারাজার প্রথম উপন্যাস কেরি, যার মাধ্যমে তিনি জাদুর কাঁঠি মানুষের মনজগতে হানা দিয়েছিল। এই জাদুর কাঁঠি একসময় রূপোর কাঁঠি হয়ে আলোড়ন জাগিয়েছে সিনেপটের জগতেও। গোয়েন্ডি’স বাটন বক্সে আমাদের ভৌতিক উপন্যাসের মহারাজার সাথে যোগ দিয়েছেন আমেরিকান লেখক, প্রকাশক ও সম্পাদক রিচার্ড চিযমার। সেরা গল্পসমগ্রের জন্য যার থলিতে রয়েছে লুকাস এওয়ার্ড।
ভালবাসায় ভালবাসা বাড়ে ঠিক যেমন তর্কের ভিত্তিতে যুক্তি গড়ে উঠে। ভালবাসার এ উপাখ্যানে শামিল হয়ে কিংয়ের এ বাটন বক্স আমাদের হাতে এনে দিয়েছে অনুবাদক সুমিত শুভ্র। তার অনূদিত প্রথম একক বই গোয়েন্ডি’স বাটন বক্স। পড়তে যথেষ্ট প্রাণবন্ত লেগেছে। আমার সংলাপগুলোর প্রেজেন্টেশন ভাল লেগেছে। একটা সুন্দর ফ্লো ছিল। বানান ভুল তেমন চোখে পড়েনি। বইয়ের কারুকাজ গুলো দারুণ ছিল বিশেষ করে শুরুতে নয় পৃষ্ঠার কাজটি। সুমিত শুভ্র নিজের লিখা নিয়ে অসন্তুষ্টিতে বলেন, ‘যাহা রচনা করি, তাহা সকলই ছাইপাঁশ’। তবে অনুবাদকের কাছে অনুরোধ এমন ছাইপাঁশ দিয়েই ভরিয়ে রাখুন ধরাকে, না হলে মাধবীলতা কান্না হয়েই ঝরবে।
ব্যক্তিগত রেটিং-৪/৫
Views: 46