একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন পন্ডিত ব্যক্তি এলেন। তাকে বাংলা বিভাগে নিয়ে গিয়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললেন, “He himself is a university. You can ask him any question.”
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যদি কাউকে বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, তাহলে তার জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে ধারণাটা বেশ পরিষ্কারই হয়ে যায় বৈকি।
ছাত্রদের মধ্যে থেকে একজন হাত তুললেন। তার একটি প্রশ্ন আছে। অনুমতি পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “সাহিত্যের দৃষ্টিতে তাজমহল কি এক শব্দে বলুন।”
সেই জ্ঞান ভান্ডার প্রশ্নকর্তার জ্ঞানের পরিমাণ বুঝতে পারলেন। তিনি এক শব্দে উত্তর দিলেন, “নীর”।
প্রশ্নকারী ছিলেন পরবর্তীকালের সাহিত্যাঙ্গনের অতিপরিচিত মুখ সিকান্দার আবু জাফর। তিনি বুঝেছিলেন, তাজমহলকে কেন চোখের জল বলা হলো। তাই আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়নি।
যুগে যুগে এরকম বিশ্ববিদ্যালয় মার্কা জ্ঞানী মানুষ জন্মায়। তাদের সংখ্যা খুব কম। জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন সেরকম একজন মানুষ। তার জ্ঞানের সীমা পরিসীমা মাপার মত লোক তার সময়ে কমই ছিলেন। তাকে নিয়ে অনেক গ্রন্থ লেখা হলেও তিনি নিজে একটি বইও লিখেননি। কথিত আছে, বঙ্গবন্ধু যে “ ঐতিহাসিক ছয় দফা” দিয়েছিলেন, তার রূপকারদের মধ্যে প্রফেসর রাজ্জাক ছিলেন অন্যতম।
সব সময় পুরান ঢাকার ভাষায় কথা বলতেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তার ছিল ঈর্ষনীয় বিচরণ। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ছিলেন তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কবি জসীমুদ্দীনও। জয়নুলের আর্ট মিউজিয়ামের মত নড়াইলের শিল্পী সুলতানের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়েও তার ভূমিকা অসামান্য।
লেখক আর পাঠকের পড়া এক নয়। প্রফেসর রাজ্জাক বলতেন,
”লেখার ব্যাপারটি অইল পুকুরে ঢিল ছোড়ার মত ব্যাপার। যতো বড় ঢিল যতো জোরে ছুড়বেন পাঠকের মনে তরঙ্গটাও তত জোরে উঠব এবং অধিক্ষণ থাকব। আর পড়ার কাজটি অইল অন্য রকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে-বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইর ্যা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।”
আমরা কত জায়গায় ঘুরতে যাই। দু’একদিন থাকি তার পর চলে আসি। দু’একদিনের ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার মানুষ সম্পর্কে, তাদের কালচার সম্পর্কে জানা অসম্ভব। প্রফেসর রাজ্জাক বলেন,
”একটা কথা খেয়াল রাখা খুব দরকার। যখন কোনো নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজর যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা।”
দীর্ঘ সাতাশটি বছর একজন তুখোড় মেধাবী মানুষ, খুব কাছে থেকে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাককে পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর তার উপর বই লিখেন। মেধাবী মানুষটি হলেন আহমদ ছফা।
গোটা বইয়ের আনাচে কানাচে মনি-মুক্তোর মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমকালীন বিশ্বের নানা দিকের আলোচনা। আছে গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদকে দাবা ট্রেনিং দেওয়ার আলোচনা, অমর্ত্য সেনের সাথে অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা শেক্সপীয়রের লেখার সমালোচনাও।
লেলিন-মার্কস নিয়ে যেমন আলোচনা আছে, তেমনি আছে ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে। চীন-রাশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে যেমন আলোচনা আছে, তেমনি আছে ভারত ভাঙার আলোচনাও। সাহিত্যের আলোচনা করতে গিয়ে যখন তিনি বলেন, “চাঁদ সওদাগরের মত শক্তিশালী চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বিরল,” তখন মনসামঙ্গল পড়ার ইচ্ছে জাগবে পাঠকের মনে। আবার মার্চেন্ট অব ভেনিসের সমালোচনা শুনে, শাইলকের ডায়ালগের ব্যাখ্যা শুনে আপনাকে আবার শেক্সপীয়র রিভাইস দিতে ইচ্ছে করবে।
ভ্যান গগের ছবি সম্পর্কেও আলোচনা এসেছে প্রাসঙ্গিক ভাবেই। এখান থেকে জানা যায়, ভ্যান গগ-এর একটি ছবি বিক্রি হয় আমাদের টাকায় আটান্ন কোটি টাকায়। অথচ ভ্যান গগকে আত্নহত্যা করতে হয়েছিল না খেতে পেয়ে।
”যদ্যপি আমার গুরু” বইটি মাত্র ১১০ পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ কিন্তু বইয়ের বিষয়বস্তু আর উপাদানের বিস্তৃতি দেখলে অভিভূত হতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের এমন কোন দিক নেই যা এই বইয়ের আড্ডায় উঠে আসেনি। এই বই পড়ার পর আরো শতাধিক বই পড়ার ইচ্ছে জেগে উঠবে এটাই হয়তো এই বইয়ের বড় সার্থকতা।
তৎকালিন রাজনীতিবিদ, লেখক-সাহিত্যিক-কবিদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো চিত্রায়নেও বইটি ডকুমেন্টারির ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
বইয়ের নাম- যদ্যপি আমার গুরু
লেখক- অহমদ ছফা
প্রকাশক- মাওলা ব্রাদার্স
প্রচ্ছদ- কাইয়ুম চৌধুরী
মূল্য-একশত পঁচাত্তর টাকা মাত্র
রিভিউ লেখক-
আসাদুজ্জামান জুয়েল
Views: 140