বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি একা থাকায় সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমার সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।
–কিন্তু আন্টি, এই একাকিত্ব আপনার ভাল লাগে? বয়স হয়েছে…হঠাত যদি কিছু হয়ে যায়?
–যা হবার হবে। অত ভেবে কি হবে ? সাহস নিয়ে শির উঁচু করে বেঁচে আছি।
কথা হচ্ছিল হঠাত পরিচিত হওয়া এক আন্টির সাথে। কাজ থেকে ফেরার পথে এই দূরত্বটা চোখ বন্ধ করে চলে যাই। বাসের শেষ স্টপেজ নামব বলে নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুজে থাকা যায়। মাত্র মিনিট পনের পরেই এক যাত্রী পাশে বসেছেন টের পেয়ে চোখ খুলে দেখলাম।
হুম, আমাদের ওদিককার অর্থাৎ দেশি, ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানী হতে পারে। বয়স্কা ভদ্রমহিলা ভারী শীতের কোট পরেছেন, টুপি, গ্লাভস সবই বেশ দামী বোঝা যাচ্ছে। আমি একনজর চোখ বুলিয়েই আবার তন্দ্রায় নিমগ্ন হলাম।
কয়েক মিনিট পরেই সহযাত্রীর ফোন বেজে উঠল। ফোনে কথা বলা শুরু করতেই বুঝে গেলাম ইনি আমার দেশেরই লোক। এত বছর ধরে এদেশে আছি তারপরও দেশী কাউকে হঠাত রাস্তাঘাটে দেখলে উদ্গ্রীব হয়ে যাই কুশল বিনিময়ের জন্য। পাশের বয়স্কা তাঁর ছেলের সাথে কথা বলছেন বুঝলাম। বউমা, নাতিদের খোঁজ নিচ্ছেন। ফোন রাখার পর নিজেই পরিচিত হতে উদ্যত হলাম।
—আন্টি, আপনি বাংলায় কথা বলছেন শুনে খুব ভালো লাগছে। আমিও বাংলাদেশ থেকে।
ভদ্রমহিলা মিষ্টি হাসি হাসলেন। চামড়ায় ভাঁজ পরা ছোট মুখখানিতে বিগত যৌবনের সৌন্দর্যের আভাস। কানে হীরের দুটি বিন্দু জ্বলজ্বল করছে। সামান্য লিপস্টিক ছোঁয়ানো ঠোঁট। হালকা মাশকারা লাগিয়েছেন। আঙ্গুলে চারটি হোয়াইট গোল্ডের আংটি। পরিস্কার ফাইল করা নখ রংবিহীন ম্যানিকিউর করা। নিজের বেশ যত্ন নেন বোঝা যায়। দেশী আন্টিরা এরকম বয়সে অনেকেই জীবনের উপর বিতৃষ্ণায়, ক্লান্তিতে বা জরা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বয়স নিশ্চয়ই সত্তরের কাছাকাছি হবে। কী সুন্দর ফিটফাট রেখেছেন নিজেকে।
—হ্যাঁ, দেশী কাউকে দেখলে আর বাংলায় কথা শুনলে খুব খুশী হই। আপনি কোথায় থাকেন ?
—আমি কুইন স্ট্রিটে থাকি। আন্টি, আমাকে তুমি করেই বলুন, প্লিজ।
–আচ্ছা। অনেক ছোটোই হবে বয়সে। কুইন স্ট্রিটে রেশমারা থাকে। চেনো নাকি?
–জি আন্টি। চিনি ওদের। আগে খুব যাতায়াত ছিল, বাচ্চারা ছোটো ছিল। ইদানিং যোগাযোগ কমে গেছে। রেশমা’ পা বেশিরভাগ ছেলের কাছেই থাকেন। শুনেছিলাম, বাড়ি বিক্রি করে দেবেন।
—হুম, ঠিকই শুনেছ। ওরা ছেলের কাছেই চলে যাবেন ঠিক করেছেন।
—আপনি কোন্ এলাকায় থাকেন ?
—ভিক্টোরিয়া এভিনিউতে।
আলাপচারিতায় জমে গেলাম। আন্টির নাম জাহিদা আক্তার। স্বামী মারা গেছেন কুড়ি বছর আগে। কানাডায় বসবাস করছেন পঁয়ত্রিশ বছর। দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বামীর সঙ্গে কাটিয়েছেন।
তাঁর প্রথম সন্তানকে নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন পঁচিশ বছর বয়সে। ইরাক, সৌদি আরব, লিবিয়া, উগান্ডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, রুমানিয়া, মিশর, আমেরিকা ঘুরে শেষ পর্যন্ত কানাডায় বসতি। স্বামী ছিলেন ডাক্তার। ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর বিভিন্ন দেশে সংসার পাতা আন্টির জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। তাই কানাডায় স্থায়ী বসতি।
বাস থেকে নামবার আগে আন্টি আমার ফোন নম্বর চেয়ে নিলেন। এরই মাঝে আমার নাম্বারে মিস কল এবং মেসেজ ফ্রম জাহিদা আক্তার চলে এলো।
কেতাদুরস্ত, রুচিশীলা ভদ্রমহিলা আধুনিকতায় অভ্যস্ত দেখে ভালো লাগল। অনেক বয়স্করাই স্মার্ট ফোন ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত নন। এই রমণী ব্যতিক্রম নিঃসন্দেহে।
ফোন নম্বর বিনিময় হলেও আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় আমরা ভুলে যাই হঠাত পরিচয় হওয়া পথচারীকে। কোনো সময় মনের অজান্তে স্মৃতির মণিকোঠায় ভেসে এলেও ভাবি, ফোন করবো ? কি দরকার ?
যদি উনি ব্যস্ত থাকেন ? কীই-বা মনে করবেন?
আচ্ছা, দেখি উনি কল দেন কিনা !
এইসব সাতপাঁচ ভেবেই সময় নষ্ট করি। আগের জেনারেশন হয়তো এর চাইতে সহজ ছিলেন। অন্যের প্রাইভেসির কথা এতোটা তাঁরা ভাবতেন না।
মেঘে মেঘে বেলা কম যায়নি। আমারও বয়সটা থেমে নেই, মধ্যবয়সের দ্বারপ্রান্তে এসে আমিও আজকাল নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই। একাকিত্ব আমাকেও যন্ত্রণা দেয়। মায়ের বয়সী এক স্বাবলম্বী বয়স্কার কথা মনে পড়ে মাঝে মাঝে।
বিষণ্ণ, মেঘলা, তুষারশোভিত এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে জম্পেশ করে আদা, দারুচিনি, এলাচ ছেঁচে কড়া দুধ চা আর নিমকি সামনে নিয়ে ফোনটা করেই ফেললাম। কয়েকবার রিং হতেই উত্তর দিলেন জাহিদা। একবার বলতেই চিনতে পারলেন।
—প্রীতি, তোমার কথা ক’ দিন যাবত মনে পড়ছিল। ভালো হয়েছে ফোন করেছ। একদিন চলে এসো। অনেক গল্প করব।
—আসব, আন্টি। নাকি আপনিই আসবেন আমার এখানে ?
—তুমিই এসো। আমি একা থাকি। গল্প করা যাবে। সময় নিয়ে এসো।
এই তো মুশকিল। সংসারী মানুষের জন্য সময় বের করা প্রায় অসম্ভব। শুধুমাত্র নিজের জন্য। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজের পরে পুরো সময়টাই পরিবারের জন্য দিতে হয়। স্বনির্ভর, স্বাবলম্বী যাই বলে দাবী করি না কেন, পরিবারের শেকল যে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা।
আমার স্বামী পরাগ ভালোমানুষ হলেও অল্প কিছু মানুষকে ঘিরে তাঁর পৃথিবী। কাজের পরে পরিবার, ছেলেমেয়ে, বাবা-মায়ের যত্ন ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমাদের নিজস্ব কোন সময় কখনোই ছিল না। এখনো নেই। তাঁর কাছে এসবের কোন মূল্যই নেই।
কাজের পর ঘরে ফিরে রান্না, ছেলেমেয়ের পড়া দেখা, শ্বশুর শাশুড়ির যত্ন করা। ছুটির দিনে দেশী বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত, পাল্টা দাওয়াত ছাড়া আর যেন কিছুই করবার নেই। শুধু দায়িত্ব পালন আর কর্তব্য করেই জীবন শেষ। আজকাল আমার নিভৃতে একটু অবসর পেতে ইচ্ছে করে। পছন্দের কারো সাথে দু’ দন্ড জিরিয়ে গল্প করতে মন চায়। সামান্যই চাওয়া, তাও মেলে না।
এ সংসারে নিজস্ব বলতে আমার কিছু নেই। বাড়িটা কেনা হয়েছে দুজনের নামে মর্টগেজ পেতে সুবিধে ছিল বলে। বেতনের টাকা যৌথ একাউন্টে চলে যায়। আমার খুব সামান্যই খরচ।
সবকিছু পরাগের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি আমার একাউন্টের পিন কোডও তার জানা। ক্রেডিট কার্ড আমার আছে নামমাত্রেই। পরাগই কেনাকাটায় ব্যবহার করে। আমার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস সে-ই কিনে দেয়। শ্বশুর শাশুড়ি খারাপ মানুষ নন, তবে তাঁরা তাঁদের ছেলেকে চোখে হারান।
কোন কিছু নিয়েই প্রতিবাদ করি না, সহজে মেনে নিই…নিজস্ব কোন চাহিদার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি সংসারের যাঁতাকলে পড়ে। কিভাবে যে এতগুলি বছর কেটে গেল বুঝতেই পারিনি।
এমনকি আমার নিজের কোনো বন্ধুও নেই। সবাই পরাগের বন্ধু আর তাঁদের বউয়েরা। সকলের সাথেই আমার ভালো সম্পর্ক। কিন্তু প্রচুর পরশ্রীকাতরতা আর লেগ পুলিং চলে এদের মাঝে। কে কার চেয়ে ভালো চাকরি করে, কে কতো বড়ো বাড়ি কিনেছে বা কিনবে, কার কয়টা গাড়ি, কার ছেলেমেয়ে কত ভালো ইউনিভার্সিটিতে কত স্কলারশিপ পায়…আর আছে শাড়ি কেনার ফিরিস্তি মহিলাদের।
আমার ক্লান্তি লাগে চিরকাল এসব গল্পে। কিছুতেই স্রোতে গা ভাসাতে পারলাম না। স্রোতের উল্টোদিকে গিয়ে নিজস্ব জগত তৈরী করাও আর সম্ভব নয়, সংসারে ঝামেলা হবে।
আমি যে ছাপাখানায় কাজ করি সেটাই আমার নিজস্ব জগত। মিশেল, আন্দ্রেয়া, লিয়া, রায়ান আর আমি… খুব সখ্যতা আমাদের। বহুবছর ধরে আছি বলে সামান্য কর্মী থেকে আজ সুপারভাইজার হয়েছি। মিশেল আর আমি বিবাহিত। বাকিরা ডিভোর্সি।
ওদের মধ্যে রায়ানই কয়েক জেনারেশন আগে আসা কানাডিয়ান। লিয়া চাইনিজ, আন্দ্রেয়া রুমানিয়ান আর মিশেল ঘানা থেকে আসা আমার মতোই অভিবাসী। দুপুরের খাবারটা একসঙ্গেই খাই …বিভিন্ন দেশী খাবারের স্বাদ নেয়া এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। প্রাণখোলা হাসি আর গল্পে প্রতিদিন সতেজ হই, ঘরে ফিরে অপেক্ষা করি কখন ভোর হবে।
একেবারে আচমকাই সুযোগ মিলে গেল লটারী পাওয়ার মতোইল। যেন পরাগ আমাকে একা বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে এমনই খুশি হলাম। ননদের কাছে বাবা মাকে মিশিগানে পৌঁছে দিতে গেল পরাগ এক শুক্রবার। আমাকে জিজ্ঞেসও করেনি যাব কিনা ! লোকটা নিজের মত করেই ভাবে চিরকাল। আগে মন খারাপ হত… এখন আর ভাবি না। বরং খুশী হই। দু’ দিনের জন্য ঘরটা ফাঁকা পাওয়া যাবে। নিজের পছন্দের কয়েকটা মুভি দেখব।
শুক্রবার কাজ থেকেই ফোন করেছিলাম জাহিদা আন্টিকে। বললেন, শনিবার সকালেই যেন পৌঁছে যাই।
আন্টির জন্য কিছু খাবার রাতেই তৈরী করে রেখেছি। সকাল সকাল ফারের কোট, বুট জুতা, টুপি, দস্তানা নিয়ে বেরিয়েছি। বাস আর ট্রেন যাত্রার পর বিশ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম আন্টির বাড়ির দোরগোড়ায়।
ছিমছাম একতলা বাংলো বাড়ি। গতরাতের তুষারশোভিত শুভ্র সাদা ড্রাইভওয়ে পার হয়ে সাদা দরজায় বেল বাজালাম। জাহিদা একগাল হাসি দিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। শীতবস্ত্র থেকে নিজেকে মুক্ত করে আন্টির পিছু পিছু রান্নাঘরে হাজির হলাম। শুরু হলো আমাদের গল্প।
এতো খোলামেলা গল্প কারো সাথেই করিনি কখনো। আমার অতি সাধারণ জীবনের মূল্যহীন গল্প করলাম।
আন্টি চোখ বড়ো করে বললেন, ‘দেখোমেয়ে, জানি না তোমার কি সমস্যা ! তবে যাই করো নিজের জন্য সামান্য সময় বের করে নিজের পছন্দগুলো পুরণ করাটা তেমন কঠিন কিছু না।
—আন্টি, আমার নিজের যে কী পছন্দ তাই ভুলে গিয়েছি। ছেলের, মেয়ের, পরাগের, বাবা মায়ের পছন্দের খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজস্ব শখ, ইচ্ছেগুলো হারিয়ে গেছে। ওদের পছন্দই আমার পছন্দ। নিজস্ব শখ, ইচ্ছের ডালপালা ছেঁটে ফেলেছি বহু আগেই। নতুবা সমস্যা হয়, অশান্তি বাড়ে। আর ঝগড়া অশান্তি থেকে আমি দূরে থাকতে চাই।
—বুঝেছি! তুমি আত্মত্যাগ করার দলে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছ কেন একা থাকি? আমিও শান্তি চাই বলেই একা থাকি।
আমার চার ছেলেমেয়ের সবার নিজের সংসার, নিজেদের জীবন নিয়ে ওরা ব্যস্ত। এতগুলো বছর বিদেশে থেকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। স্বামী মারা গেছেন বলেই নিজেকে অবলা ভাবি না। সংসারের চাপে আর স্বামীর বিভিন্ন জায়গায় চাকরির সুবাদে আমার নিজস্ব কেরিয়ার তৈরী হয়নি। টুকটাক এটা সেটা করেছি সময় কাটানোর জন্য। বড় ছেলে চায় তার বাসায় গিয়ে থাকি, মেয়েরা ভাবে মায়ের উপর তাদের অধিকার বেশি, ছোটো পুত্র কোলপোছা বলে তার দাবী সবার চেয়ে বেশি। আমি কী চাই কেউ জানতে চায় না। ওরা চাইলেই তো হলো না…ওদের প্রত্যেকের জীবনসঙ্গীদের ইচ্ছাকেও তো প্রাধান্য দিতে হবে।
বড়ো ছেলের বাসায় তার শাশুড়ি থাকে সারা বছর। আমি গেলে ওঁর সঙ্গে একই ঘরে থাকতে হয়। দু’ চারদিন থাকি…কিন্তু দীর্ঘদিন ওভাবে থাকা যায় না।
দুই মেয়ের বাসায় মাঝে মাঝেই যাই। নাতি নাতনিরা পথ চেয়ে থাকে। জামাইরাও খারাপ মানুষ নয়। কিন্তু আমি গেলে ওদের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটে।
ছোটো ছেলে মা মা করে অস্থির। কিন্তু তার বউ বিদেশি কন্যা। খুবই লক্ষ্মী মেয়ে আলিনা। সেই একই কারণে ওখানেও গিয়ে দু’ দিন বেড়িয়ে চলে আসি নিজস্ব আস্তানায়।
এবাড়িটা চার ছেলেমেয়ে কিনেছে আমার নামে। আমার মৃত্যুর পর বিক্রি করে চারভাগ করে নিবে। সেভাবেই দলিল করা আছে।
আমি নিজের মতো ঘুরে বেড়াই। বয়স্ক বন্ধু বান্ধব আছে। গাড়ি আর চালাই না। বাসে, ট্রেনে এদিক সেদিক যাই। বুড়োদের ব্যস্ত রাখার নানারকম ছল-বাহানা আছে। স্বেচ্ছাসেবী কাজের ব্যবস্থা আছে। নিয়মিত ওদের সাথে কাজও করি।
—তারপরও তো ঘরে ফিরলে আপনি একা! দেশে যান না?
–একা কোথায় আমি? বেশিক্ষণ একা থাকার সুযোগই কম। বাসায় যে সময়টা থাকি, নিজের মত নিভৃতে কাটাই, এবাদত করি, গাছপালার পরিচর্যা, সামান্য টিভি দেখা…পুরনো বন্ধুদের সাথে গল্প করে সময় কেটে যায়।
দেশে তেমন কেউ নেই আপনজন। অধিকাংশই মারা গেছেন। জ্ঞাতি-গোষ্ঠী যারা আছে তাঁদের কাছে গিয়ে বড় জোর সপ্তাহখানেক থাকা যায়। এর বেশি নয়।
— সম্পূর্ণ একা একটা বাড়ি নিয়ে থাকার কী দরকার আপনার? বাড়িঘর পরিস্কার রাখাও তো বিরাট কাজ।
—তা ঠিক। যা পারি নিজে করি। বড়ো ছেলে এসে কিছু সাহায্য করে। সে কাছেই থাকে। মাসে একদিন একটি মেয়ে এসে ঘরদোর সাফ সুতরো করে যায়। রূপম মানে আমার বড়ো ছেলে চায় আমি ওর কাছেই থাকি। রূপমের বিয়ের পর পর কিছুদিন ছিলাম ওদের সাথে। সব ছেলেমেয়েরাই মায়ের রান্নার ভক্ত থাকে, রূপমও তার ব্যতিক্রম নয়। আমার হাতের লুচি, আলুর দম খেয়ে রূপম এতো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছিল যে ওর বউয়ের মুখ ভার হয়ে গেল। রূপম লক্ষ্য না করলেও আমি দেখেছিলাম। এরপর থেকে রাইমা আমাকে এড়িয়ে চলা শুরু করল। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সন্তানদের সাথে সদ্ভাব রাখতে হলে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে যত কম অনুপ্রবেশ করা যায় ততই মঙ্গল। এখন যাই, দু’চারদিন থাকি…রাইমা আগে থেকেই ঠিক করে রাখে রূপমের জন্য আমি কী রাঁধব। সে কটা দিন রান্না থেকে ওদের ছুটি।
আন্টি থামলেন। আমার কাপের দিকে চেয়ে বলেন, ‘চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বস, আরেক কাপ চা নিয়ে আসি। ‘
টুকটুক করে হেঁটে এই একাত্তর বছরের বৃদ্ধা কিচেনে গেলেন। ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি গরম করে ধুমায়িত চা নিয়ে ফিরে এলেন। তাঁর প্রতিটি কাজ মার্জিত, রুচিসম্মত।
অন্যমনস্ক আমি ভাবছিলাম, এভাবে আর কতোদিন ? আন্টির আরও বয়স হবে…তখন !
আমার মনের কথা বুঝি টের পেলেন। নড়েচড়ে বসলেন,
— আমি চাই কোনো ঝামেলা ছাড়াই যেন আমার মৃত্যু হয়। সারা জীবন কাউকে কখনো নিজের জন্য ডাকিনি…অসুস্থ হলে ছেলেমেয়েরা নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দেবে। ইচ্ছে করে না ওখানে যেতে…অন্যের সেবা নেয়া …পরনির্ভরশীল হয়ে যাওয়া। বড্ড অপমানকর জীবন।
—কিন্তু আন্টি, আপনি তো সন্তানদের কাছেও যেতে চান না।
—আরও অথর্ব হয়ে গেলে ওদের কাছেই বা কী করে থাকব ? ওদের কী সময় আছে ? এদেশে বুড়োদের জন্য সিনিয়রস হোম তো রয়েছেই। তোমার শ্বশুর শাশুড়ির স্বাস্থ্য কেমন ?
—ভালো, বেশ ভালো।
আন্টির কথায় মনে হলো পরাগ মাঝে মাঝে বিষণ্ণ হয়ে ভাবে, বাবা মাকে যদি সিনিয়রস হোমে রাখতে হয় কিভাবে খরচ চালাবে !
আর এই, কোলাহলবিরোধী, শান্তিপ্রিয় আমি মনে মনে ভাবি কবে তারা যাবেন হোমে …খুব স্বার্থপর ভাবনা কি?
ওঁরা নেই বলেই তো আজকের দিনটাতে আমি খোলা বাতাসে শ্বাস নিতে পারছি…নতুবা প্রতিদিন দমবন্ধ হয়ে ইটের নীচে চাপা পড়া ঘাসের মতো মলিন থেকে মলিনতর হচ্ছি। এক ফোঁটা সূর্যালোকের জন্য প্রতিদিন কাজে ছুটে যাই…ঘরে ফেরার পর প্রতিটি পল যেন আবার বেঁচে থাকতে পারি সেই প্রত্যাশায়।
জাহিদা আন্টির মতো সময় তো আমারও আসবে। সাহস না হারিয়ে এমনি করে দৃপ্ত পদে কি হেঁটে যেতে পারব সামনের পথটুকু ?
আমাদের দেশে কেন মেয়েদের স্বনির্ভর হতে শেখান হয় না? স্বনির্ভর হবার পরেও আমরা কেন আশা করি সন্তান আমাকে দেখবে? এই পৃথিবীতে আমরা সবাই এসেছি একা…ফিরে যেতেও হবে একা…মধ্যকার জীবনটা শুধুই ছলনা আর মায়া !
বৈরী পথ মাড়িয়ে জীবন সায়াহ্নে এসে এই প্রবাসের শেকড়বিহীন জীবনে যতটা প্রফুল্ল থাকা যায়, নিজেকে ব্যস্ত রেখে সেই চেষ্টাই করছেন সামনে বসা এই বৃদ্ধা।
তাঁর কোনো আফসোস নেই, অনুযোগ নেই, অভিশাপ নেই, হাহাকার নেই, বিমর্ষতা নেই।
স্বপ্নও নেই।
যদি সব ছেড়ে চলে যেতেই হয় তবে আর অত মায়া করেই বা কি হবে !
বিচিত্র এ জীবন, বিচিত্র মানুষের মন।
আন্টি তখনও বলে চলেছেন,” আমার কোনো আফসোস নেই জানো ! প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুখ, ভালবাসা আমি পেয়েছি। স্বামীর স্বচ্ছলতা আমাকে সাহস যুগিয়েছে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার। যতদিন সুস্থভাবে বাঁচি ততদিন মানুষের জন্য কিছু করে যেতে চাই। একাকীত্ব, নিসঃঙ্গতা আমাকে আর স্পর্শ করে না।
বেঁচে তো আছি। বেঁচে থাকাটাই আশীর্বাদ।”
Hits: 269