বাংলার এক অধ্যাপক এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যান ম্যাডাম আমার ভীষণ প্রিয় ছিলেন। তার থেকে সাহিত্যের কত কিছু যে জেনেছি!
তিনি একদিন ক্লাস ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলেন, তারা কবিতা পড়ে কি না। সবাই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লে ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, কবিতা মুখস্থ করে কিনা। এবারও অনেকে হাত তুললো।
ম্যাডাম একজনকে একটি কবিতা শোনাতে বললেন, সে শুরু করলো,
” তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে………”
পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে উঠলো।
ম্যাডাম বললেন, “দ্যাখো তোমরা হাসছো কিন্তু একটু ভেবেছো কি, এত এত কবিতা থাকতে সে এই ছড়াটি আবৃত্তি করলো কেন? এটা তো সে কত বছর আগে পড়েছে, তবু ভোলেনি। এটার কারণ হলো, ছড়া বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে মজার অংশ। সহজবোধ্যও বটে।”
ম্যাডামের উৎসাহ পেয়ে আরেকজন বলরেন, ” ম্যাডাম
আমিও একটি ছড়া শোনাতে চাই।”
ম্যাডাম অনুমতি দিলে সে শুরু করলো,
“আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।…..”
আমি তখন ম্যাডামের কাছে থেকে ঘটনাটি শুনে ছড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে ছিলাম। প্রায় দেড় যুগ পরে এসে, ছড়া দুটো আমাকে ভিন্ন কিছু ভাবতে সাহায্য করছে। ভাবনাটি হলো ঐ দুটো ছড়াই রবীন্দ্রনাথের লেখা। তার চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ছড়াগুলো লেখা হয়েছে পতিসরে বসে। নওগাঁ জেলার পতিসর একটা খুবই অখ্যাত গ্রাম কিন্তু সে গ্রামের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, পতিসর যাবো। দিনটি ছিল শনিবার। মটর সাইকেলযোগে সহযাত্রী আব্দুল মতিন ভাইকে সাথে নিয়ে চললাম পতিসরের পথে।
চমৎকার আবহাওয়ায় আমি বাইক চালাচ্ছি খুবই ধীরে ধীরে। আব্দুল মতিন ভাই শিল্পী মানুষ। বাইকে বসেই তিনি গান ধরেছেন,
“আমি কান পেতে রই,
ও আমার আপন হৃদয়
গহন দ্বারে বারে বারে
কান পেতে রই…….”
গান শেষ হতেই আব্দুল মতিন ভাইকে যখন বললাম যে, এই গানটি রবীন্দ্রনাথ পতিসরে বসে লিখেছেন তখন তিনি আনন্দ এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন।
আমি পতিসরের ভক্ত বহু আগে থেকে। রবীন্দ্রনাথের “ছিন্নপত্র” আমার প্রিয় পাঠ্য। প্রায় প্রতিদিন ছিন্নপত্র পড়ি। এই ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথের যে চিঠিগুলো ঠাঁই পেয়েছে তার অধিকাংশই পতিসরে বসে লেখা।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পতিসর পৌঁছুলাম। রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব আজো যেন জ্বল জ্বল করছে। আমার মধ্যে এক ধরণের অদ্ভূত অনুভূতি কাজ করতে লাগলো। রবীন্দ্রনাথের একেকটি ঘটনা মনে পড়ছে আর চোখে পানি ঝরছে। সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মত নই।
যে নদীটিকে দেখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে….” সেটাতে শান বাঁধানো ঘাট আছে। আমি পানিতে পা চুবিয়ে জোরে জোরে ছড়াটি আবৃত্তি করা শুরু করলাম।
যে তাল গাছটিকে দেখে তিনি “তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে” লিখেছিলেন, সেটা এখন আর নেই। তবে যেখানটায় গাছটি ছিলো সেখানে দারুণ এক স্মৃতিফলকে সে কবিতাটি লেখা আছে।
রবীন্দ্রনাথ যে ঘরে থাকতেন সেখানে গেলাম। এটা এখন রবীন্দ্র মিউজিয়ামের মত। পতিসরের এ বাসার সংগ্রহশালাতে আছে তার বেশ কিছু পারিবারিক ছবি, ব্যবহার্য জিনিসপত্র। আছে ছিন্নপত্রে বার বার উল্লেখ হওয়া “পদ্মা বোট” এর ছবি। পদ্মা বোটের বিশাল নোঙর আমাকে আবারও মুগ্ধ করলো। রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখাতে বহু মূল্যবান কাগজপত্রও সংরক্ষিত আছে।
রবীন্দ্রনাথ নোবেলের যে প্রাইজমানি পেয়েছিলেন তার একাংশ দিয়ে করেছিল “শান্তি নিকেতন” আর অন্য অংশ দিয়ে কৃষকদের উন্নয়নে গড়েছিলেন পতিসরে “কৃষি ব্যাংক”। কৃষি ব্যাংকে তিনি সফল হননি। বরাদ্দকৃত ঋণ ফেরত আসেনি। ব্যাংক নেই তবে সিন্দুকটি আছে পতিসরের সংগ্রহ শালায়।
পতিসর কুঠিবাড়ির পাশেই রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা বিস্তারের জন্যে তৈরি করেন, “কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশান”। এখনও সেটি দারুণ এক স্কুল এবং রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি হয়ে জাজ্বল্যমান। মূল ভবন এখনও সেই টালি দিয়েই তৈরি করা, যদিও বা নতুন ভবনও উঠেছে।
পতিসরের রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল সাহিত্যানুরাগী কয়েকজনের সাথে। সেখানেই জানতে পারলাম, “দুই বিঘা জমি” কবিতাটি এখানে বসে লেখা। কবিতাটি যে আমার কত প্রিয় তা বোঝাতে পারবো না।
“মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবেনা মোহ গর্তে,
তাই লিখি দিলো বিশ্ব নিখিল দু’বিঘার পরিবর্তে।”
পুরো পতিসর জুড়ে রবীন্দ্রনাথের গন্ধ যেন ছড়িয়ে আছে। ছিন্নপত্রে পতিসরের যে বর্ণনা পড়েছি, আমার কাছে এত বছর পরেও পতিসরকে ঠিক সেরকমই মনে হয়েছে।
পতিসরে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি প্রত্নতত্ত্ববিভাগের তত্ত্বাবধানে আছে। কুঠিবাড়ির সামনের মাঠটিতে পণ্য বোঝাই করার জন্যে শত শত ট্রাক জমা হয়ে এটার সৌন্দর্য্য এবং গাম্ভীর্য নষ্ট করছে। শুনেছি সেটা সংরক্ষণের জন্যে দেয়াল নির্মাণ করে কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড হাতে নিয়েছে প্রত্নতত্ত্ববিভাগ। সেটা বাস্তবায়ন হলে দারুণ হবে।
মনের প্রসারতার জন্যে পতিসর ভ্রমণে আসা যায়। বাচ্চাদের মধ্যে বাংলাকে বিস্তৃতভাবে বসিয়ে দিতেও এ ভ্রমণ খুব কাজে লাগবে বলে মনে হয়।
Views: 153