বিপদ আমার পিছনে ধাওয়া করে না-কি আমিই বিপদের পিছনে ছুটে বেড়াই সেটা নিয়ে নিজেরই সন্দেহ আছে। হেডস্যার নিজের রুমে একাকী ডেকে নিয়ে বললেন, ‘চাকরি করতে এসে এমন ছটফট করলে হয়? ধীর-স্থির হতে হয়। ধৈর্য কাকে বলে মোবারক সাহেবকে দেখে শেখার চেষ্টা করো।’
অন্য কোনো স্যার-ম্যাডামের কথা বললে চুপ করে শুনে যেতাম কিন্তু মোবারক স্যারের উদাহরণ দেওয়ায় ভিতরটা তেঁতে গেল। এমনিতেই নিজের ক্লাসের চাপ বেশি তার উপর কোনো পিরিয়ডে ফ্রি আছি দেখলেই মোবারক স্যার ব্যস্ততার উছিলা দেখিয়ে নিজের ক্লাসে আমাকে পাঠান। দুদিন আগে ক্লাসে যাওয়ার ব্যাপারে মোবারক স্যারের কথা রাখি নি। কে ভেংচি দিয়েছেন তা বুঝতে অসুবিধা হল না। হেডস্যারের বাড়ি আমার নানা বাড়ির লাগোয়া। ছোটোবেলায় মামা ডাকতাম। মোবারক স্যারের উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ল না। হেডস্যারের সামনে রাগে মুখ ফসকে এক কথার মধ্যে আরেক কথা ঢুকিয়ে দিয়ে মোবারক স্যারকে চিমটি কেটে ফেললাম, ‘জ্বী, স্যার, আমি জানি, মোবারক স্যারের অনেক ধৈর্য। স্যার দশ বছর ধরে ঘরজামাই আছেন।’
বলেই বুঝতে পারলাম, বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছি। হেডস্যার অতীতের মামা ডাকের মূল্য দিলেন না। ভুল স্বীকার করেও লাভ হল না। আমার এই চিমটি কাটার কথা হেডস্যারের নিকট থেকে গল্পে গল্পে একজন দুজন করে সব স্যার-ম্যাডামের কানে পৌঁছে গেল। মুখের লাগাম না থাকার জন্য আমি মোবারক স্যারের চক্ষুশূল হয়ে গেলাম।
গুরুজন সম্পর্কে গুরুতর মন্তব্য করে ফেলেছি। শাস্তি হিসাবে আমার খণ্ডকালীন মাস্টারি যেতে দেরি হল না। নেপথ্যে মোবারক স্যার বুঝতে বাকি থাকল না। মাস শেষ হবার দুদিন আগে হেডস্যার ডেকে বললেন, ‘তোমাকে বলতে খারাপ লাগছে কিন্তু স্কুল ফান্ড থেকে খণ্ডকালীন শিক্ষক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত। সব শিক্ষক মিলে তোমার ক্লাসগুলি ভাগ করে নিব। আগামী মাস থেকে তোমার আর আসার দরকার পড়বে না।’
আমার ডান পা মায়ের পেট থেকেই বাম পায়ের চেয়ে দেড়-দুই ইঞ্চির মতো ছোটো। গোড়ালিটাও সরু। লোকে আগে অসাক্ষাতে ল্যাংড়া রফিক ডাকত। মাস্টারিতে ঢুকবার পর থেকে ল্যাংড়া মাস্টার ডাকে। নামের বদলে ল্যাংড়ার পূর্বে মাস্টার বিশেষণ থাকায় আগের চেয়ে কিছুটা স্বস্তি পাই। লোকের মুখে ল্যাংড়া মাস্টার থেকে যাতে আবার ল্যাংড়া রফিক না হয়ে যাই সেই কারণে আমাকে অন্যপথ ধরতে হল। মাস্টার সম্বোধনে লোককে জীবনের তরে অভ্যস্ত করার কৌশল হিসাবে আপাতত এক প্রকার ঢোল পিটিয়ে প্রাইভেট পড়ানোটাকে পেশা হিসাবে বেছে নিলাম। মাস্টারি না থাকলেও লোকের কাছে ল্যাংড়া মাস্টার পরিচয়টাই বহাল থাকল কিন্তু কয়েকমাস না যেতেই প্রাইভেট পড়ানোর উৎসাহে ভাটা পড়ল। স্কুলের টান অনুভব করি। ক্লাসে ফিরতে ইচ্ছে করে।
আমি দোষে-গুণে মানুষ। তাপ-অনুতাপ বোধ আছে। হেডস্যারের সামনে রাগের মাথায় মোবারক স্যার সম্পর্কে সেই মন্তব্যটির জন্য মনের মধ্যে খুঁত খুঁত করে। ভুল স্বীকার করে মোবারক স্যারের কাছে ক্ষমা চাইলে চাকরিটা যদি ফেরত পেতাম!
দেখা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, স্যার অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের ঘরজামাই। হেডস্যার হয়তবা এজন্যই স্যারকে তোয়াজ করে চলেন। কলিং বেল চাপতেই বাজখাই মহিলা কণ্ঠস্বর, ‘কে?’
মিসেস বাজখাই দরজা খুলতেই আমার ভিমড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। স্যারের মরহুম শ্বশুরকে চোখে দেখার ভাগ্য হয় নি। তবে মেয়েকে দেখে আমার মনে হল, নিশ্চিত কুস্তিগীর ছিলেন। মোবারক স্যারকে চিমটি কাটার কথা শুনে থাকলে স্যারের স্ত্রী আমার দফারফা বের করলেও করতে পারেন। আমাকে বাস্কেট বলের মতো করে ছুঁড়ে ফেলা নস্যি ব্যাপার।
স্যারের স্কুল থেকে এসেছি শুনে ভিতরে ঢুকতে ইশারা করলে সোফায় গিয়ে বসলাম। আমি যেন তাড়াতাড়ি বিদায় হই সেটা স্যারের স্ত্রী ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কৌশলে জানিয়ে দিলেন, ‘আপনাকে এর আগে বোধহয় আমি দেখি নি, তাই না? ফোন করে এসেছেন? আজকে আবার আমাদের পরিবারের সবাইকে কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে বের হতে হবে। জরুরী তাড়া আছে।’
স্যারের স্ত্রীর কথা শুনে বুকের ধুকধুকি বেড়ে গেল। স্যার এমনিতেই রেগে আছেন, তার উপর ব্যস্ত। ইনিয়ে-বিনিয়ে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা লাভের অনুপযুক্ত সময়ে চলে এসেছি। ব্যস্ত সময়ে আসায় স্যার যদি আরও রেগে যান! হেডস্যার কথা দিয়েছেন, মোবারক স্যারের কাছে থেকে মৌখিক অনাপত্তিনামা নিতে পারলেই আমার চিমটি কাটার শাস্তির অবসান ঘটাতে বাকি যা করার করবেন।
ড্রয়িংরুমের বাইরের দরজায় আবারও চোখে চোখ পড়ল। এখানে আসার কিছুক্ষণ আগে যখন দেখা হয় সেভাবে খেয়াল করি নি। বয়স পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্বো। পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবিতে দীর্ঘ দিন ইস্ত্রির চাপ-তাপ পড়ে নি। সাদা-কাপড়ে কিছুটা ময়লাও ধরেছে। দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি?’
আমাকে অভয় দিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। কাউকে কিছু বলব না। তোমারও ব্যাপারটা তোলার দরকার নেই। আমিই তোমাদের মোবারক স্যারের বাবা।’
আবারও প্রমাণিত হল, বিপদ নিজের থেকে আমার কাছে আসে না বরং আমিই নেমন্তন্ন করে ডেকে নিয়ে আসতে বিপদের দরজায় গিয়ে ধর্না দিই। ছেলেকে চিমটি কাটার অপরাধে ক্ষমা চাইতে আসার সময় রাস্তায় বাবাকে কামড় দিয়ে এসেছি।
সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হওয়ায় তাড়াহুড়া করে প্রাইভেটে দৌড়াতে হয়েছিল। বিকেল অবধি অন্য কাজে বাইরে ব্যস্ত ছিলাম। আমার বাড়ি শহরের পূর্ব দিকে। বাড়ি হয়ে ঘুরে যেতে হলে দ্বিগুণ পথ। স্যারের শ্বশুর বাড়ি সঠিক চিনি না। শুধু জানি, কড়ইতলা শিব মন্দিরের পাশে। চেহারাটা উসকোখুসকো হয়ে আছে। কড়ইতলার কাছাকাছি আসতেই সেলুন দেখে রিকসা থেকে নেমে পড়লাম। কয়েক দিন সেভ করা হয় নি।
সেলুনে দুজন ছেলে কাজ করছিল। একজনকে দেখে স্বস্তি পেলাম। আমার মহল্লার ছেলে। সিরিয়াল এগিয়ে নেয়ার ধান্দায় আন্তরিকতা দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘জিল্লুর, কেমন আছো? অনেক দিন দেখা হয় না। তুমি এখানে কাজ কর? আমার ভীষণ তাড়া ছিল। শুধু সেভ করব, একটু তাড়াতাড়ি করা যায় না?’
জিল্লুর অপেক্ষায় থাকা একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘চাচাজান, আমার এলাকার বড়ভাই। পাঁচ মিনিট লাগবে। তারপর আপনারটা ধরি?’
হাতের লোকটির কাজ শেষ হলে সম্মতি পাওয়ায় আমাকে বসালো। সেভিং ক্রিম মাখাতে মাখাতে জিল্লুর প্রশ্ন করল, ‘ভাইয়া, এদিকে কোথায়?’
আমি মোবারক স্যারের নাম বলতেই জিল্লুর বলল, ‘মার্কেটের এই লাইনের চারটি দোকান উনার শ্বশুরের। তার মধ্যে আমাদেরটির ভাড়া তোলেন মোবারক স্যার। ভাড়া দিতে কয়েকদিন দেরি হলে খুব রাগারাগি করেন। হাবভাব দেখে মনে হয়, উনার বাপের দোকান। কথাবার্তার ধরনই অন্যরকম। ভাইয়া, আপনার স্যারের বাবা কী করেন?’
মোবারক স্যারের নাম শুনলেই আমার জিভ আপনাআপনি চুলকাতে শুরু করে। ক্লাস চাপানো ছাড়াও আমার অসাক্ষাতে প্রায় আমার নামের আগে ল্যাংড়া বিশেষণ ব্যবহার করতেন। জিভের চুলকানি থামাতে পেঁচিয়ে জিল্লুরের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘এক সাথে এক-দেড় বছর চাকরি করেছি। কখনও বাপ-চাচার নাম মুখে নিতে শুনি নি। নিজের শেকড়ের স্মৃতিচারণ নেই, শুধু বৌয়ের চৌদ্দ গোষ্ঠি আর ভায়রা ভাইদের গল্প। বাপ-চাচা সব পটল তুলেছে মনে হয়!’
অজান্তে বিরাট পাপ। আমার কথা শেষ না হতেই আয়নার মাধ্যমে অপেক্ষা করা বয়স্ক ব্যক্তিটির চোখে চোখ পড়লে তিনি মুখ নিচু করলেন।
কাকতালীয়ভাবে এত মানুষ থাকতে সেই ব্যক্তিটিই কি-না মোবারক স্যারের বাবা! পরিচয় না জানায় সেলুনে জিল্লুরের নিকট একজন জীবিত মানুষকে তাঁরই সামনে পটলের ভুঁইয়ে পাঠানোর জন্য তেমনভাবে হাত ধরে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেলাম না। বাইরে যাওয়ার পোশাক পরে স্যার ড্রয়িং রুমে ঢুকে বাবাকে দেখে মন্তব্য করলেন, ‘এত দেরি করে? আমরা চলে গেলে তুমি বাসায় ঢুকতে পারবে না বলে অপেক্ষা করছি।’
কাকুতি-মিনতির ঘাটতি রাখলাম না কিন্তু স্যার ক্ষমা করলেন কি-না স্পষ্টভাবে কিছুই বুঝতে পারছি না। স্যারের মুখের আশ্বাসবাণী শুনার জন্য অপেক্ষা করছি এমন সময় স্যারের বাবা ঘাড়ে একটি সাইড ব্যাগ নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে স্যারের কাছাকাছি এসে বললেন, ‘মোবারক, আজ বাড়ি যাব এই সিদ্ধান্ত কিছুক্ষণ আগেও ছিল না। হঠাৎ নিয়ে ফেললাম। আসি রে। তোরা সবাই ভালো থাকিস।’
স্যার বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘অসময়ে এটা তোমার কেমন সিদ্ধান্ত? শেষ গাড়িতে গিয়ে না হয় রংপুরে নামলে কিন্তু তারপর বদরগঞ্জে কীভাবে যাবে? তাছাড়া, তোমাকে টর্মিনালে তুলে দিতে গেলে আমার এদিকে দেরি হয়ে যাবে। তুমি বরং আজ থেকে যাও। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে চলে?’
স্যারের কথাকে গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না। স্যারের বাবা গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘আমার যাওয়া নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আসার সময় কি একা আসি নি? রংপুর পর্যন্ত গেলে বদরগঞ্জে যাওয়ার কোনো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
আমাকে অপেক্ষা করতে বলে স্যার বাবাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। পাঁচ-সাত মিনিট পর ফিরে এসে আমার বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘আপনি আমার হয়ে টার্মিনালে গিয়ে বাবাকে যদি কষ্ট করে রংপুরের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসতেন? আমার একটা জরুরি প্রোগ্রাম আছে।’
ঘাড় কাত করে গদগদ কণ্ঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মতি জানিয়ে মনে মনে নিজেকে বললাম, ‘বলে কী! চাকরিটা ফেরত পাবার জন্য প্রয়োজনে আমি ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে রাজশাহী থেকে ঘাড়ে করে বাবাকে বদরগঞ্জ পর্যন্ত রেখে আসতে রাজি আছি।’
আমার জন্য ভালো হল। গাড়িতে তুলে দিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় কৃত অপরাধের জন্য হাত ধরে মাফ চাওয়ার সুযোগ মিলবে। বাইপাস রোডে নতুন টার্মিনাল হওয়ায় শহর থেকে অনেকটা দূর হয়। পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল। রংপুরের শেষ গাড়ি ছেড়ে গেছে।
স্যারের বাবাকে ইতিমধ্যেই আমি কাকু ডাকা শুরু করে দিয়েছি। হতাশ হয়ে বললাম, ‘কাকু, কি আর করা! তাহলে চলুন, ফিরে যাই?’
আমার ফেরত যাওয়ার প্রস্তাবে কাকু শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, ‘না, বাবা, আমি আর পিছনে ফিরে যাব না। তুমি যাও। আমি কাটা গাড়িতে করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। রংপুর অবধি তো পৌঁছাতে পারব।’
কাকুর কথায় সায় দিতে পারলাম না। রংপুরের গাড়ি না পেয়ে অন্য গাড়িতে তুলে দিয়েছি জানলে মোবারক স্যার বিগড়ে যেতে পারেন। আমি মুখটা করুণ করে বললাম, ‘কাকু, স্যার সুপারিশ করলে এই ল্যংড়া রফিকের পেট চালানোর সাময়িক একটা গতি হবে কিন্তু রংপুরের গাড়ি না পেয়ে আপনাকে এভাবে ছেড়ে দেওয়ায় রেগে গেলে আমার সেই আশা চিরতরে নিভে যাবে।’
কাকু আমার কথার উত্তর না দিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছেলেকে সংবাদ দিলেন, ‘মোবারক, আমি টার্মিনালে পৌঁছে গেছি।’
নিজের শুধু টার্মিনালে পৌঁছানোর কথা বলে সাথে সাথে ফোন কেটে দেওয়ায় খটকা লাগল। মনে হল, বাবা-ছেলের সম্পর্কটা কোথায় যেন বেসুরে বাজছে। খুব সম্ভবত কিছু একটা হয়েছে।
কাকুর দুহাত আমার হাতে তুলে নিয়ে আবারও ক্ষমা চাইলাম, ‘কাকু, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি সেলুনে অমন কথা বলে বড্ড অপরাধ করে ফেলেছি।’
সস্নেহে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘ধুর বোকা! তুমি অপরাধ করবে কেন? মোবারকের সাথে আমার বাবা-ছেলের সম্পর্ক থাকতে পারে তখন সেলুনে তোমার পক্ষে স্বপ্নেও কল্পনা করা সম্ভব ছিল না, এটা আমি বুঝি না? কালেভদ্রে দেশে গেলে সেখানেও মোবারকের শুধু শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের গল্প। লোকে যে মনে মনে ওর ওসব গল্প অপছন্দ করে সেটাও বোঝার চেষ্টা করে না।’
কাশি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে কাকু প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এত চিন্তা করছো কেন? রংপুরের গাড়ি না পাওয়ার কথা মোবারককে না জানালে আমি কীভাবে বদরগঞ্জ গেলাম সেটা সে কোনোদিনই জানবে না। এবারে তোমার আপত্তি আছে?’
আমি কাকুর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আকুতি জানিয়ে উত্তর দিলাম, ‘আপত্তি আছে, কাকু। রংপুরে পৌঁছাতেই অনেক রাত হয়ে যাবে। তারপর আবার বদরগঞ্জ। রাস্তায় বিপদ-আপদ হতে পারে। আমি বাবাকে হারিয়েছি অনেক আগে। তিন বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড়ভাই পরিবার নিয়ে সিরাজগঞ্জ থাকেন। যমুনা ব্রীজের সহকারি টোল আদায়কারী হিসাবে চাকরি করেন। সংসারে আমি আর মা। দুদিন আগে মা মেজো বোনের বাসায় গেছেন। কাকু, আপনি আজকের রাতটা আমার বাসায় থেকে আগামীকাল ভোরে রংপুরের গাড়িতে তুলে দিলে আপনার আপত্তি আছে? আমার বাসায় থাকার ব্যাপারটাও মোবারক স্যার কোনোদিন জানবেন না। দুপুরের মধ্যে বদরগঞ্জ পৌঁছে গেলেন।’
শেষ পর্যন্ত কাকু আমার কথায় সম্মত হলেন। টার্মিনাল থেকে বাড়ি অবধি আমাদের দুজনের কথাবার্তার মধ্যে মোবারক স্যারকে নিয়ে আর কোনো প্রসঙ্গই উঠল না।
রাতের বেলা খাওয়ার শেষের দিকে বিদ্যুত চলে গেল। উপরে টিনের ছাউনি। গুমোট গরম। এক চিলতে উঠোন। খাওয়া শেষে দুটো চেয়ার উঠোনে নামিয়ে মুখোমুখি বসতেই কাকু প্রশ্ন করে বসলেন, ‘সংসারের কাজ কি মাকেই করতে হয়? চাকরির আশায় বিয়ে করতে দেরি করছো বুঝি?’
ছোটোবোনের বান্ধবী নুপুর স্বেচ্ছায় আমার জীবনে এসে কয়েক মাস নিক্কণের ছন্দে আবিষ্ট করে হঠাৎ নিজেই চলে গেছে। সরকারি চাকরিজীবী স্বামীর সংসারে ভালো আছে জেনে সান্ত্বনা খুঁজি। গত দুবছরে ভিতরের ক্ষতটা শুকিয়ে গেছে কিন্তু দাগটা আছে। এই দাগের কথা আমি ছাড়া কেউ কখনও জানবে না।
কাকুর মনটা শুরু থেকেই ভারি দেখছি। হালকা করার জন্য সরস কণ্ঠে বললাম, ‘আয়-উপার্জনের স্থায়ী গতি হলেও ওটা করা কি ঠিক হবে, কাকু? লোকে আমাকে ল্যাংড়া ডাকে। বিয়ে করলে সবাই ও’কে ল্যাংড়ার বউ ডাকবে। লোকের মুখে ল্যাংড়ার বউ সম্বোধন শুনতে কি কারও ভালো লাগবে? শুধু শুধু একটা মেয়ের দুঃখ বাড়বে।’
কাকু আমার যুক্তিকে রসিকতা হিসাবে নিলেন বলে মনে হল না। সস্নেহে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা, তোমার ডান পা নিয়ে মনে অনেক দুঃখ, তাই না?’
প্রশ্ন শুনে মুখে আসা হাসির রেখাটা মিলিয়ে যেতে সময় লাগল না। নাভিমূল থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাসের কুণ্ডলীটা বুকে আটকে দিয়ে উত্তর দিলাম, ‘না, কাকু, অন্যরা বলার আগে নিজেই নিজেকে সহস্রবার ল্যাংড়া বলি তখন আর লোকের কথা গায়ে বাঁধে না।’
কাকুর সেই মুহূর্তের প্রকৃত মানসিক কষ্টের কথা আমি আন্দাজই করতে পারি নি। আমার কষ্টের সান্ত্বনা হিসাবে কাকু নিজের দুঃখের কথা বলা শুরু করবেন তা কল্পনা করি নি। হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন, ‘পোড়ানোর আগে ষোলটি ইটের ওজন কত জানা আছে, বাবা?’
আমার চেয়ারের পিছনে চার্জার ল্যাম্পের আলোর দিকের মুখটা অন্য দিকে ঘোরানো আছে। আকস্মিক এমন অদ্ভুত প্রশ্নে উৎসুক হয়ে কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আবছা আলোতেও মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, কাকুর মনটা খারাপ। কাকু নিজের কথা বলতে লাগলেন, ‘এসব কষ্টের কথা সামান্য কয়েকঘণ্টার পরিচিত ব্যক্তির সামনে বলা যায় না কিন্তু সেলুনে মোবারক সম্পর্কে তোমার আক্ষেপ শুনে আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের বাবা-ছেলের সম্পর্ক তুমি কিছুটা হলেও অনুমান করতে পার। এখানে আমার তেমন আসা হয় না। মোবারক পরিবার নিয়ে অনেক দিন বদরগঞ্জ যায় নি। নাতনিকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে থাকতে পারলাম না। তাছাড়া মাস দুয়েক ধরে মোরারক আর বৌমা খুব করে আসতে বলছিল। চার বছর পর রাজশাহী এলাম। মেয়েরাও কেন জানি, ভাইয়ের বাসাতে বেড়াতে আসতে চায় না। ক্ষেতমজুরি করে সংসারটা চালানো যায় কিন্তু সেই আয়ে ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো যায় না। সন্তান মানুষের মতো মানুষ হবে, আমি সন্তানের মাঝে বেঁচে থাকব এই আশা নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। শীতকালে অন্যের ক্ষেতে কাজ করে বাড়ি এসে দুটো খেয়ে আবার ছুটতাম ইটভাটায়। হাজার চুক্তিতে ইটভাটায় ইট তুলতাম। একটি কাঁচা ইটের ওজন চার কেজির কম হবে না। এমনও বছর গেছে রোযা থেকেও মাথায় ষোলটি করে ইট বয়েছি কিন্তু কি হলো?’
বাবা-ছেলের মান-অভিমান এক সময় কেটে যাবে। এমনিতেই ফেঁসে আছি। আমি কোনো মন্তব্য করছি না। কাকু এক গ্লাস পানি চেয়ে খেয়ে আবার নিজের কথায় ফিরলেন, ‘আচ্ছা, বয়স হয়ে গেলে কি আত্মীয়-স্বজনের পারিবারিক অনুষ্ঠান-উৎসবে কিংবা ঈদ-পূজা-পার্বণে সন্তানদের সাথে বাজারে যাওয়ার শখ থাকতে নেই! নাতনির মুখে সকালে শুনলাম, ওর ছোটোখালু নিজের কেনা ফ্লাটে উঠবেন। সেই উপলক্ষে মাগরিবের ওয়াক্তে দোয়া-মোনাজাত শেষে রাতে খাওয়া-দাওয়া। বাড়ির সবার দাওয়াত। যেতে হবে ভেবে আসরের নামায আদায় করে পোশাক পরলাম। আমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে, কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেদের বাইরে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে আমি আবার অসময়ে কোথায় বের হচ্ছি বৌমা সে কথা জিজ্ঞাসা করল। কত বড় বোকা আমি! ছেলের পরিবারের সদস্যের তালিকায় আমার যে নামই নেই সেটাই ধরতে পারি নি! নিজের কাছে নিজেই লজ্জায় মুচড়ে গেলাম। সেই লজ্জা ঢাকতে পোশাক পরার কারণ হিসাবে সেলুনে যাবার কথা বললাম।’
কেন জানি মনে হচ্ছে, কাকু নিজের থেকে বলছেন না। ভিতরে নিতে পারছেন না বলে অবচেতন মন কাকুকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে। যেখানে ছেড়েছিলেন সেখান থেকে আবার খেই ধরলেন, ‘আজকের দিনটা বোধহয় আমার ছিল না। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করে যে বাবা সন্তানকে পড়ালেখা শিখিয়েছি সেই বাবার গল্প করতে পারলে সন্তানের বুক গর্বে ভরে যাওয়ার কথা। সেলুন থেকে ফেরার পথে নিচে নাতনির সাথে দেখা। হঠাৎ আমার নাম জিজ্ঞাসা করল। স্কুলে নিজের দাদার নাম বলতে পারে নি বলে ক্লাসে না-কি আজ এক ম্যাডামের বকা খেয়েছে। ছেলের মাঝে বেঁচে থাকব বলে চৌষট্টি কেজি মাথায় নিয়ে জীবনে উঠানামা করলাম অথচ সেই ছেলের মনে স্থান নেই বলেই তার কাছে থেকে আমার নামটা দশ বছরের নাতনির কান অবধি পৌঁছে নি! অনেকের কাছে এটা সামান্য ব্যাপার মনে হতে পারে কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছিল। পড়ালেখা শেষ করে চাকরির তাগিদে শহরে অনেকেই থাকে। তাই বলে একেবারে শেকড় কেটে? দাওয়াতে যাওয়ার জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবি পরলাম কিন্তু বৌমার প্রশ্ন প্রমাণ করে দিল, আমি ছেলের সংসারে বাতিলের খাতায়। সহকর্মীদের কাছেও মোবারকের গল্পে সবাই আছে, শুধু আমিই নেই। ছেলের কাছে বাহ্যিকভাবে বেঁচে থাকলেও বাস্তবে তার মনের ভিতরে অনেক আগেই মরে গেছি। জীবন্মৃত বাবা। নিজের ভিতরে প্রশ্ন জাগল, ছেলের মনেই যখন আমার জায়গা নেই তখন সেই ছেলের কাছে এক রাতের জন্যও থাকব কোন অধিকারে? বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আজ মনে হচ্ছে, তোমার চাচি মরে গিয়ে মোবারকের এভাবে মন থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার যন্ত্রণার কবল হতে বেঁচে গিয়েছেন।’
ঘরে কাকুর মোবাইল বেজে উঠলে আমি নিয়ে এসে হাতে দিলাম। চশমা চোখে দিয়ে মোবারক স্যারের নম্বর দেখে আমার বাবার নাম জেনে নিয়ে ফোন রিসিভ করলেন। কাকু কৌশলে সত্য-মিথ্যা উভয়ের পাশ কেটে গিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘বলেছিলাম না, আমার কোনো অসুবিধা হবে না? আজ আর বদরগঞ্জ না গিয়ে আমিরুদ্দীনের ছেলের বাসায় থেকে কাল যাব।’
ফোন কেটে দিলে মৃদু হেসে বললাম, ‘আমার আব্বার নাম স্যার জানেন না ঠিকই কিন্তু যদি জানতেন?’
কাকু উত্তর দিলেন, ‘তাই তো! তখন দেখা যেত। রংপুরে আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আছে। ধরেই নিয়েছে আমি তাদের কোনো একজনের নাম বলেছি।’
বিদ্যুত এসে গেছে। কাকুকে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ার কথা বললাম। সাড়া দিলেন না। কাকু যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। পিঠটা চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে ঘাড়টা সামান্য উপরে তুলে কিছুটা দূরের এক বাড়ির ছাদের উপর বসানো মোবাইল টাওয়ারের লাল বাতির দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি মনে মনে কাকুকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হাতড়াচ্ছি । আমার বাড়িতে সম্প্রতি আশ্রিত সামান্য তফাতে বসা অতি গরমে ধুকতে থাকা বেওয়ারিশ কুকুরটির মাঝে মাঝে জোরে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ছাড়া শুনশান নিরবতা।
আমি ভাষা খুঁজে পাওয়ার আগেই লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাকু পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নিরবতা ভাঙলেন, ‘সন্তান যখন বাবা হয়ে বাবার হাত ধরে তখন সেই বাবার কাছে স্বর্গ-সুখও তুচ্ছ হয়ে যায় কিন্তু কিছু সন্তান কেন তা বোঝে না!’
আকাশে মেঘ জমেছে। ভাদ্র মাসের গরম। আমাদের দিকে মুখ করে বারান্দায় রাখা টেবিল ফ্যানের বাতাস সামান্যই গায়ে লাগছে। কাকু কথার শেষের দিকে গেলেন, ‘বসত ভিটার বাইরে সব মিলিয়ে মাত্র আটাশ শতক আবাদি জমি। তার মধ্যে একদাগেই পনেরো শতক। ফসলের মাঠের মধ্য দিয়ে যাওয়া ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা পাশে। আমার দুটি মেয়েই মোবারকের বড়। তেমন পড়ালেখা শেখাতে পারি নি। তখন বিয়ের বয়স নিয়ে অতটা কড়াকড়ি ছিল না। স্কুলের গণ্ডি পার না হতেই বিয়ে দিয়ে দিই। আবাদি জমির নিজের ভাগ হিসাবে বোনদের কাছে মোবারকের সেই পনেরো শতকের দাবী ছিল। বাকিটা দুবোনের। ছোটোভাইয়ের আবদারে বোনেরাও আপত্তি করে নি। মোবারক বলাতে আমিও কাগজে-কলমে ওর নামে দিয়ে দিয়েছি। ভেবেছিলাম, ছেলের নামে থাকা মানে আমারই থাকা। বাপ-দাদার আমলের জমি, আইলে না বসলে পেটের ভাত হজম হয় না। বের হওয়ার সময় মোবারক তখন তোমার সামনে থেকে কেন আমাকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল, জানো? তার নামে দেয়া জমিটি বিক্রির ব্যাপারে আমি যেন অমত না করি সেটা বলতে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই পনেরো শতক জমি বিক্রি করে নিজের হাতের টাকার সাথে যোগ করে বৌমার ভাই যে বিল্ডিংয়ে ফ্লাট কিনেছে সেখানে কিস্তিতে ফ্লাট কিনবে। এতে যদি ওর সংসারের মঙ্গল হয় তাহলে হবে! আমি অমত করি নি। চাষ করার সময় যে জমির মাটি গায়ে ঠেকলে সারাজীবন সোনা মনে হয়েছে সেই জমি বিক্রি করা আর আমার বুকের পাঁজর ভাগ করে বিক্রি করার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই, বাবা। আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না! উপার্জন অক্ষম হয়ে গেলে সন্তানরা মতামত নেওয়ার ধার ধারে না, তাই না?’
খেয়াল করলাম, শেষের কথাগুলি বলতে কাকুর নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। নিজের ঘুম পাওয়ার কথা বলে কাকুকে আমার ঘরে নিয়ে এলাম। শুয়ে পড়লে চারিদিকে মশারি গুঁজে দিয়ে মায়ের ঘরে এসে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম।
এক ঘণ্টার মতো হতে চলেছে শুধু এপাশ-ওপাশ করছি। চোখে ঘুম ঘুম ভাব আছে কিন্তু কাকুর কথাগুলি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ায় ঘুমটা আঁটছে না। ঝড় শুরু হতে না হতেই বিদ্যুত চলে গেল। জানালা বন্ধ করতে হবে। চার্জার ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে আমার ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠলাম। টিনের চালার জন্য ফ্যান চললে শব্দ হয়। পাশের ঘর থেকে বুঝতে পারি নি। কাকু হয়তবা উঠে আমাকে ডাকার চেষ্টা করেছিলেন। পারেন নি। মেঝেতে পড়ে আছেন। হাতের ল্যাম্পটা রেখে তাড়াতাড়ি কাকুকে বিছানায় তুললাম। সম্পূর্ণ অচেতন। পরনের লুঙ্গি-গেঞ্জি ঘামে ভিজে গেছে। হাত-পায়ের তালুতে হাত দিয়ে দেখি ঠাণ্ডা। আমি ঝড়ের মধ্যে দরজা খুলে দৌড়ে গিয়ে আমার দুই চাচাতো ভাইকে ডেকে নিয়ে এলাম। ডাকাডাকির শব্দ শুনে কয়েকজন প্রতিবেশীও এলো।
আ্যম্বুলেন্সের জন্য ফোন করা হয়েছে কিন্তু বাইরে ঝড়ের মাতম কমলেও একেবারে থামে নি। সবাই মিলে হাত-পায়ের তালুতে সরিষার তেল মালিশ করছে। জ্ঞান ফেরার কোনো লক্ষণ নেই। মোবারক স্যারের ভয়ে আমার মাথা কাজ করছে না। কাকুর কিছু হয়ে গেলে আমাকে তিনি ছেড়ে দেওয়ার বান্দা না। আ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায় একেকটি মিনিটকে ঘণ্টা মনে হচ্ছে। আবার ফোন করতেই জানাল, আমার বাড়ির উদ্দেশে আ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে পড়েছে।
চাচাতো ভাইদের একজনকে সাথে নিলাম। আ্যাম্বুলেন্স ছাড়লে আমি মোবারক স্যারকে মোবাইল করে বললাম, ‘স্যার, আমি আপনার আব্বাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি আসুন। কাকুর অবস্থা খুব খারাপ। ভীষণ অসুস্থ।’
স্যার প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমি ফোন কেটে দিয়ে স্কুলের জগলুল স্যারকে ফোন দিলাম। কাকুকে কেন আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম তা সংক্ষেপে জানিয়ে স্যারকে হাসপাতালে আসার অনুরোধ করলাম। আপন-পর ভেদ নেই। মুখের উপর উচিত কথা বলতে ছাড়েন না। জগলুল স্যারকে সব খুলে বললে আমাকে মোবারক স্যারের রোষানল থেকে হয়তবা বাঁচাতে পারবেন।
ডাক্তাররা বললেন, ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক। কাকুকে ইমার্জেন্সি থেকে ওয়ার্ড হয়ে সোজা আই.সি.ইউতে নেয়া হয়েছে। জগলুল স্যারের বাসা কাছে হওয়ায় আগে এসেছেন। মোবারক স্যার যখন এসে পৌঁছালেন তখন কাকু আই.সি.ইউতে। কিছুক্ষণের মধ্যে স্কুলের একজন পিয়নকে সাথে নিয়ে হেড স্যারও এলেন। জগলুল স্যার ফোন করেছিলেন।
কথায় বলে, মায়ে চিনে বাপ, মনে জানে পাপ। আমি মোবারক স্যারকে নিয়ে যেমনটা ভয় করছিলাম তেমন কিছুই করলেন না। জগলুল স্যারের মুখে সব শুনে একেবারে চুপ মেরে গেলেন।
ভোর চারটের দিকে কাকু মারা গেলেন। বাবা বেঁচে থাকতে উপলব্ধি হয় নি কিন্তু মৃত্যুর সংবাদ শুনে মোবারক স্যার কেঁদে উঠে বললেন, ‘সব কিছুর জন্য আমার অবহেলা দায়ী। নিজের বাবাকে কখনও বোঝার চেষ্টা করি নি।’
একই শহরে থাকলেও সেই দিনের পর আর কখনও মোবারক স্যারের সাথে আমার দেখা হয় নি। স্কুলের খণ্ডকালীন চাকরিটার দরকার পড়ে নি। ইউনিসেফের সাহায্যপুষ্ট পথশিশুদের একটি স্কুলে স্থায়ী চাকরি পেয়ে যাই। মাস-বছর কেটে গেছে কিন্তু কাকুকে ভুলতে পারি নি। চোখের সামনে সন্তান কর্তৃক কোনও অবহেলিত বাবাকে দেখলেই কানের কাছে কাকুর সেই কণ্ঠস্বর বাজতে থাকে, ‘সন্তান যখন বাবা হয়ে বাবার হাত ধরে তখন সেই বাবার কাছে স্বর্গ-সুখও তুচ্ছ হয়ে যায় কিন্তু কিছু সন্তান কেন তা বোঝে না!’
Views: 201
One Comment
shahadottipu
পুরো লেখাই শব্দের মূর্চ্ছনা মাতিয়ে রেখেছে। গল্পের ক্যানভাসও খুব চমৎকার, আবেগী হৃদয় তার ভাষা প্রকাশ করেছে চোখের জলে।