ভোরের আলো সবে ফুটেছে। প্রতিদিনের মত বাইকে চেপে বেরিয়েছি। উদ্দেশ্য বীরকুৎসা স্টেশনে গিয়ে এক কাপ চা পান করা আর যাত্রীদের ট্রেনে ওঠা-নামা দেখা।
স্টেশনের খুব কাছে পৌঁছুতেই একটা স্কুলের সাইনবোর্ডের দিকে নজর গেল। নাম “বীরকুৎসা অবিনাশ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়”।
স্কুলটির পুরাতন নির্মাণশৈলী আর নামের সাথে “অবিনাশ” শব্দ দেখেই বুঝতে পারলাম অবিনাশ লোকটি বর্তমানে বিনাশ হলেও এক সময় তার দোর্দান্ত প্রতাপ ছিল। মনে মনে তার সন্মন্ধে জানার এক অদম্য কৌতুহল কাজ করলো।
একটু খোঁজ করতেই জানা গেল পাশেই একটি রাজবাড়ি আছে। সেটাই ছিল রাজা অবিনাশের প্রাসাদ। যে প্রাসাদকে এলাকার লোকেরা “হাজার দুয়ারী প্রাসাদ” বলে।
প্রাসাদটি ঘুরে ঘুরে দেখার সময় কৌতুহল বাড়তে লাগলো রাজা অবিনাশের সম্পর্কে। হাজারটি দুয়ার আছে কিনা, গোনার চেয়ে রাজা অবিনাশের শেকড় খুঁজতেই বেশি ইচ্ছে করলো।
কিছু কিছু তথ্য পেলাম। জানলাম অবিনাশ দত্তের ছেলে বীরেন্দ্রনাথ যখন এ অঞ্চলের জমিদার তখন তিনি তার বাবার নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।
রাজা অবিনাশের পাশাপাশি জমিদার বীরেন্দ্রনাথের অন্দর মহল সম্পর্কে আমার আগ্রহ বাড়তে লাগলো। বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, বীরেন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রজন্ম এখন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বীরেন্দ্রনাথ তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
আমার কৌতুহল নিবৃত্ত হলো না। রাজপ্রাসাদের সামনে এক শতবর্ষী বৃদ্ধের কাছে জানলাম, হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদের ইতিহাস জানতে হলে ধীরেনের কাছে যেতে হবে।
রাজা অবিনাশ থেকে জমিদার বীরেন্দ্রনাথ পর্যন্ত জানার আগ্রহ ছিলো, এবার সেটা পৌঁছে গেল ধীরেন নামক ব্যক্তির কাছে। বৃদ্ধের কাছে জানতে পারলাম, ধীরেন ছিলেন জমিদার বীরেন্দ্রনাথের অন্দরমহলের পাচক (বাবুর্চী)।
এবার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলো। বাবুর্চী ধীরেনকে পাওয়া গেলে জমিদার বাড়ির হাড়ির খবর পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আশংকা কাজ করলো। ধীরেনও কলকাতা চলে যায় নি তো?
বৃদ্ধ লোকটি জানালেন যে, ধীরেন রাজপ্রাসাদের খুব নিকটেই একটি দীঘির পাড়ে থাকেন। সেখানেই তার বাড়ি।
খুঁজে খুঁজে ধীরেনকে পাওয়া গেল। আশি বছরের বৃদ্ধ। তার কাছেই পাওয়া গেল “হাজারদুয়ারী প্রাসাদের ইতিহাস”।
এ অঞ্চলে তখন নাটোরের পাগলা রাজার শাসন। যাকে ৫২ লক্ষের রাজা বলা হতো। এটা বলার কারণ হলো পাগলা রাজা তৎকালীন সময়ে ৫২ লক্ষ ৫৩ হাজার টাকা বার্ষিক খাজনা আদায় করতেন। তাকে নিয়ে অন্যদিন লেখা যাবে। ব্রিটিশ শাসনের সময় সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন ছিলেন এই রাজা।
রাজার কাছে থেকে জমিদারী কিনতে হতো। তারই ধারাবাহিকতায় পাগলা রাজার কাছে থেকে অবিনাশ দত্ত জমিদারী শর্ত কিনেন। হয়ে উঠেন বাগমারার আশেপাশের জমিদার।
রাজার কাছে থেকে জমিদারী কিনতো জমিদাররা। তাদের ক্রয়কৃত অঞ্চল তারা বিক্রি করতো বাবুদের কাছে। বাবুরা বার্ষিক খাজনা দিতো জমিদারকে। জমিদার খাজনা দিতো রাজাকে। রাজা বার্ষিক খাজনা পরিশোধ করতো ব্রিটিশ সরকারকে।
ফিরে আসি অবিনাশে। জমিদার অবিনাশ বাগমারায় তার জীবনভর জমিদারী করেন। প্রচুর সম্পদের মালিক এই মানুষটির মৃত্যুর পর জমিদার হন বীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাবুর্চি হিসেবে তখনই নিয়োগ পায় ধীরেন।
ব্রিটিশ সূর্য অস্তমিত হওয়ার প্লট তৈরী হলে এবং দেশভাগের টালমাটাল পরিস্থিতিতে জমিদার অবিনাশের বংশধররা দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। একরাতে খাবার শেষে সবাই যখন ঘুমাতে চলে যান তখনও হাজারদুয়ারী প্রাসাদের আলো টিম টিম করে জ্বলে। জমিদার বীরেন্দ্রনাথ ডেকে পাঠান বাবুর্চি ধীরেনকে। বাবুর্চি প্রকম্পিত হৃদয়ে জমিদার বাবুর সামনে হাজির হন। রান্নার স্বাদ নিয়ে তার আশংকা। খাবার কী তবে খারাপ হয়েছে আজ! হাত জোড় করে ধীরেন জমিদার বাবুর সামনে দাঁড়ায়।
জমিদার বাবু বলেন, “ধীরেন তুমি অনেক কাল আমাদের খাইয়েছো। একটা গোপণ কথা শুধু তোমাকেই বলতে চাই। আজ শেষ রাতে আমরা স্বপরিবারে দেশ ত্যাগ করছি। তুমি ইচ্ছে করলে আমাদের সাথে যেতে পারো।”
বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যায় ধীরেন। এক মুহূর্ত আগেও সে এটা কল্পণা করেনি। এই দেশ ছেড়ে, জমিদারী ছেড়ে, এই হাজার দুয়ারী প্রাসাদ ছেড়ে কোথায় যাবেন তারা! কেন যাবেন!
কেঁদে উঠে ধীরেন। জমিদারের পায়ে পড়েন। অনুরোধ করে বলেন, “যাবেন না হুজুর। থাকুন নিজের দেশে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জমিদার। তিনি জানেন, এদেশ এখন আর তার দেশ নয়। এ জমিদারবাড়ি এখন তার জেলখানা।
জমিদারবাবু সব লিখে দিতে চেয়েছিলেন তাকে। ধীরেন নেয়নি। বলেছে, “আপনাদেরই যখন সেবা করতে পারবো না তখন আর এ জমিদারবাড়ী দিয়ে কি হবে।”
জমিদার বীরেন্দ্রনাথ দত্ত এক ব্যাগ কাঁচা টাকা ধীরেনকে জোর করে নিতে বাধ্য করেন। বাড়ির দীঘিটাও জোর করেই তার নামে ঐ রাতেই চেক কেটে লিখে দেন। সে দীঘিপাড়েই এখন বাড়ি করে আছেন ধীরেন, একজন ইতিহাসের ধারক।
“হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদ” এখন প্রত্নতত্ত্ববিভাগের আওতায় মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে বসেছে কালের সাক্ষী এই প্রাসাদ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগুলো।
Views: 260