সব কাগজপত্র ঠিকঠাক ভাবে করে নিয়ে পাসপোর্ট অফিসের লাইনে দাড়ালাম, তখন আমার সামনে আর মাত্র পাঁচজন।এবার আমার পালা।
ফর্ম টা হাতে নিতেই অফিসারের পাশের জন আস্তে করে বলল, ‘স্যার, রেফারেন্স ছাড়া’। ব্যস, ফর্মে লাল কালিতে কাটাকাটি, গোল চিহ্ন দিয়ে ভরিয়ে দিল আর ফর্মটা আমার হাতে এক ঝটকায় দিয়ে বলল, “ঠিক করে আনেন”।
আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম, বললাম, ভুলটা কোথায়?? আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, নেক্সট….
এবার বন্ধু জসিমের পালা। আগের মত সিগনাল। “স্যার, রেফারেন্স ছাড়া”। হয়ে গেল সবকিছু। জসিমের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলল, রিসেন্ট ছবি লাগবে বলেই ফর্মটা ওর হাতে দিয়ে দিল। ও বলল, আরে ছবি ত গতকাল রাতে তুলেছি। আরো জোরে চিৎকার দিয়ে বলল, নেক্সট…….
দুই ব্যাংকার বন্ধু বেকুব হয়ে মুখ চাওয়াচায়ি করলাম। ব্যাংকে গ্রাহকের ফর্ম আমরা পুরণ করি, আর আমরা এত………..
গেট দিয়ে বেরুতেই দালালদের খপ্পরে, যারা ঢুকার সময় বিরক্ত করেছিল এদের ২/১জন এগিয়ে এসে বলল, স্যার, এই বানানে, এই ফটোতেই আপনাদের গুলো করে দিব আধা ঘন্টা সময় দিন। নিজের বিবেক, পড়াশুনা, অভিজ্ঞতা সবকিছুকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে নিজেদেরকে দালালের হাতে ছেড়ে দিলাম।
এবার কত সহজে সবকিছু হয়ে গেল, তা আর ব্যাখ্যা না করি, শুধু বলতে চাই, এভাবেই শতকরা পঁচানব্বই ভাগ পাসপোর্ট বাঙালী হাতে পায়।
আমরাও একমাস পরে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছি। পনের সালের শেষের দিকে।
এরপর থেকেই দুজনের মাথা নষ্ট, কোন দেশে সবচেয়ে কম খরচে ঘুরতে যাওয়া যায়? একবার ইন্ডিয়া আবার নেপাল। ইন্ডিয়ার ভিসা পেতে অনেক ঝামেলা হয় বলেই “হিমালয়ের দেশ নেপাল” কে সিলেক্ট করা হল, যেখানে অন এরাইভাল ভিসা দেয়া হয়, অর্থাৎ গিয়ে পৌছতে পারলেই ভিসা প্রথমবারে ফ্রি। দ্বিতীয় বার গেলে দুই হাজার পাচঁশত নেপালি রুপি। সেখানে যাওয়ার সিদ্বান্ত নিতে নিতে আরো এক বছর কেটে গেল।
সতেরো সালের শুরুতে টান টান উত্তেজনায় নেপাল সম্পর্কে অনেক তথ্য নেয়া শুরু করলাম। এক বন্ধুর ট্রাভেল কোম্পানির মাধ্যমে ঢাকা-কাঠমুন্ডু-ঢাকা এয়ার টিকেট কেটে ফেললাম উনিশ হাজার পাচঁশত করে।মার্চের তেইশ তারিখ বিকেল তিনটায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট।
চব্বিশ পচিশ ছাব্বিশ বন্ধ, সাথে দুইদিনের ছুটি খুব কষ্ট করে ম্যানেজ করলেও নতুন বিমানে ওঠার উত্তেজনায়, দেশের বাহিরে প্রথম পা রাখার আনন্দ সকল কষ্টকে ম্লান করে দিচ্ছে। টিকেট কাটার পর থেকেই বন্ধু বান্ধব আত্নীয় স্বজন সবাইকে ফোন করে জানাচ্ছি। মনে হয় বিশাল কিছু করে ফেলতেছি যদিও এরকম কোন কিছুই না।
আব্বাকে একদিন রাতে খেতে বসে বললাম, ‘আব্বা আমি পাঁচ দিনের জন্য নেপাল যাচ্ছি’। শুনেই এমন ভাবে তাকালেন যে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। উনি বুঝতে পেরে জানতে চাইলো,
‘কোন ট্রেনিং এ যাচ্ছ’?
‘না আব্বা, এমনি ঘুরতে যাচ্ছি’।
‘সাথে কে যাবে’?
‘জসিম যাবে’।
‘ফ্লাইট কবে’?
‘এই মাসের তেইশ তারিখ বিকেলে’।
“ও, সবকিছু কনফার্ম করে জানাতে আসছ? যেতেই হবে? এতদিন দেশে ঘুরাঘুরি করেছ কিছুই বলিনি। এখন বিদেশ যাওয়া শুরু করেছ”?
শুনশান নীরবতা বাবা আর ছেলের।
‘ঠিক আছে, যাও। সাবধানে থেকো’।
আমার বউ আর বড় মেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাচলো।
তারপরে একটু ঢোল পিটানোর জন্য শ্বশুড় বাড়ীতে ও জানালাম। সবার একি প্রশ্ন, ব্যাংক থেকে পাঠাচ্ছে?
কি করে বুঝাই, বিদেশে ট্রেনিং করার মত এত বড় ব্যাংক কর্মকর্তা এখনো হই নাই।
বাইশে মার্চ রাতে লাগেজ গোছানোর মধ্য দিয়ে আদার বেপারী জাহাজের খবরের মত প্রথম বিদেশ ট্যুরের স্বাদটা অনুভব করতে লাগলাম।
তেইশ তারিখে অানঅফিশিয়াল ছুটি মানে সাইন করে বেরিয়ে পড়ি ঢাকার উদ্দেশ্যে। রয়েল কোচে কুমিল্লা থেকে ঢাকা, ওখান থেকে ট্রেনে বিমান বন্দর।
এয়ারপোর্টে এই প্রথম ঢুকতে যাচ্ছি, যা দেখি তাতেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে। বোডিং পাস শেষ করে ইমিগ্রেশন। ওমা সেকি! এখানে প্রতি ডেস্কে পুলিশ। তখনো জানতাম না যে, এরাই ইমিগ্রেশন পুলিশ।
পুলিশের সামনে বিভিন্ন জেরা শেষ হওয়ার পর বোকার মত প্রশ্ন করলাম, ভাই আপনারা এখানে কেন?
পুলিশ বলল, নেপালে বেড়াতে যাচ্ছেন, আর এখানে আমরা কেন জিজ্ঞেস করছেন?
লজ্জা পেয়ে বললাম, নতুন তো, এজন্য।
এবার বসে বসে ফ্লাইট ঘোষনার অপেক্ষায়। অন্য সব বিমান নির্দিষ্ট সময়ে ফ্লাইট ঘোষনা করলেও বাংলাদেশ বিমান নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় দুই ঘন্টা পরে ঘোষনা করলো।
বাকি ফর্মালিটি সেরে জীবনের প্রথম বিমানে পা রাখলাম। বিমানবালা কাছ থেকে দেখলাম। বিমানের ইকোনমি সিটগুলো যে লোকাল বাসের মত হয়, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না কখনো।
সতকর্তামুলক ঘোষনাগুলো খুব মনোযোগী ছাত্রের মত শুনছিলাম। যখনি বলল, “পানিতে পড়ে গেলে কি করতে হবে”, ঠিক তখন থেকে কলিজা শুকিয়ে বিমানে চড়ার আনন্দ মাটি হয়ে গেল।
বউকে শেষবারের মত কল দিলাম, বললাম, রাতের আগে আর কথা হচ্ছেনা। শুধু দোয়া কর যেন সহি সালামতে পৌছতে পারি।
বিমানের রানওয়ে ছুটা শুরু হল আর আমার বুকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হতে লাগলো। জানালার পাশে সীট পড়ায় সবকিছু ক্লিয়ার দেখতে পাচ্ছি। বিমান ওড়াল দিল আকাশে, ঢাকা শহরটা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হতে চলল।
ভয়টা তখনো কাটেনি আর যখন মাঝেমধ্যে বিমান ঝাকুনি দেয়, তখন আবার “পানিতে পড়লে কি করতে হবে”, মনে পড়ে যায়।
এবার খাবারের পালা। খাবার দেখে ভয় কিছুটা কমে গেল। বার্গার, কোক, সালাদ আর ছোট পানির বোতল। খুব আয়েশ করে খেলাম।
বিমান চলছে প্রায় সাড়ে আট হাজার কি নয় হাজার ফিট উপরে দিয়ে। নীচে তাকিয়ে দেখি সাদা পার্পেল কালারের তুলার মত, আহ কত সুন্দর যে লাগছিল। মনে মনে হুমায়ন আহমেদের ডায়লগটা মনে পড়ল, বড়ই সৌন্দর্য।
ঠিক চল্লিশ মিনিট শেষ হতেই হিমালয়ের বরফাচ্ছাদিত শৃংগ অন্নপূর্ণা দেখে সত্যিই বিমোহিত হলাম। বিকেলের সূর্যের আলোকচ্ছটায় অসাধারন এক মায়াময় রুপ দেখতে পেলাম। মনে হল, বিমানে চড়া স্বার্থক হয়েছে।
দৃশ্য দেখতে দেখতেই ঘোষনা এল, দশ মিনিটের মধ্যে আমরা “হিমালয়ের দেশ” নেপালের ‘ত্রিভুবন বিমান বন্দরে’ অবতরন করতে যাচ্ছি। বলতে বলতেই নীচে তাকিয়ে দেখি পাহাড় আর টুকরো টুকরো বিল্ডিং এর এক দেশ, যা বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে ৪৯ তম আর বড় দেশ হিসেবে ৯৩ তম, যার জনসংখ্যা মাত্র ২৮.০৯ মিলিয়ন।
যেখানে আমরা এখন বিদেশি পর্যটক। প্রায় পন্চান্ন মিনিটের ধুরু ধুরু ভয় মাখা চেহেরার আবেগঘন জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমন করে মৃদু ঝাকুনির সাথে অবতরন করেছি দুইদিকে পাহাড়ে ঘেরা ত্রিভুবন বিমানবন্দরে।
লেখক, যমুনা ব্যাংকের কর্মকর্তা।
চলমান….
Views: 146