‘যার যা ইচ্ছা তাই বলে বুঝি না আসল-নকল
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল
জন্ম আমার সিলেট জেলায়, সুনামগঞ্জ মহকুমায়
বসত করি দিরাই থানায়, গাঁয়ের নাম হয় উজানধল
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল
কালনী নদীর উত্তরপাড়ে, আছি এক কুঁড়েঘরে
পোস্ট-অফিস হয় ধল-বাজারে, ইউনিয়ন তাড়ল
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল
পিতার নাম ইব্রাহিম আলী, সোজা-সরল আল্লার অলি
পীর-মুর্শিদের চরণ-ধুলি করিমের সম্বল
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল’।
তিনি নিজেই তার পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন গানে গানে। আমাদের এ পৃথিবীতে একদিকে নৃশংসতা তান্ডব নৃত্যে মাতাল হলে অন্যদিকে একজন হেসে বলে উঠে, “একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।”
যে সমাজ গান গাওয়ার অপরাধে ফতোয়া দিয়েছে তার বিরুদ্ধে , উগ্র ধর্মান্ধরা তার বিরুদ্ধে সারাজীবন বিষোদগার করে গেছে। এমনকি শুধু গান গাওয়ার অপরাধে তাকে একবার গ্রাম থেকে বের করেও দেয়া হয়েছিলো! তথাকথিত এই সমাজব্যবস্থায় তার স্ত্রী সরলা (আফতাবুন্নেসা) ও শিষ্য আকবরের মৃত্যুর পর জানাজা পড়াতে চাননি তৎকালীন মসজিদের ইমাম! তবু গণমানুষের এ গায়ক থেমে থাকেননি।
নির্ভীক এ মানুষের একটি জনপ্রিয় সাক্ষাতকারের অংশ বলছি, ভারতের প্রয়াত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না?”
শাহ আবদুল করিম বললেন, “কথা বোঝা গেলেই হইল। আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।”
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য অবাক হয়ে বললেন, “আপনার সৃষ্টি, আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না। এটা কোনো কথা, এটার কোনো অর্থ আছে!”
জবাবে শাহ আবদুল করিম বললেন, “তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। ধরো, তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে, কিন্তু গান শুনতে কোনো মানুষ আসেনি। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে। গাইতে পারবে?” কালিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন, “না, পারব না।”
শাহ আবদুল করিম হেসে বললেন, “আমি পারব। কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই, সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক, সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই৷ সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি।”
আমাদের এই উর্বর ভুমি চিরকাল দু’হাত ঢেলে দিয়ে গিয়েছে আমাদের এক একটি রত্ন। আমাদের ব্যর্থতা আমরা পারিনি সম্মান দিতে, আমাদের ব্যর্থতা!
আজ ওস্তাদ শাহ আব্দুল করিমের ১১তম মৃত্যু বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। প্রখ্যাত গীতিকবি, বাউলসম্রাট ওস্তাদ শাহ আবদুল করিমের আদর্শ বেড়ে উঠুক প্রতিটি মানুষের মাঝে।
শাহ আবদুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ – ১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯)
Views: 96