বইয়ের নাম – তিথিডোর
লেখক – বুদ্ধদেব বসু
প্রকাশনী – আজকাল প্রকাশনী
পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৩০৩
মূল্য – ২২৫টাকা
বুদ্ধদেব বসু যে সময়ে লেখালেখি শুরু করেন, সে সময়টাতে প্রায় সবার লেখাতেই রবীন্দ্রনাথের ছায়া থাকতো। অনেকে তো প্রায় অনুকরণ করতেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের বলয় থেকে বের হয়ে সম্পুর্ন নিজস্ব স্বকীয়তায় লেখা শুরু করলেন বুদ্ধদেব। পাঠক পেলো একেবারে নতুন স্বাদের বই। এমনকি বুদ্ধদেব তার একটি নিজস্ব লেখার স্টাইলও তৈরী করলেন।
বুদ্ধদেব বসুর সব বইয়েই যেমন প্রকৃতির নিখুঁত বর্ননা পাওয়া যায়, তেমনি চরিত্র গুলো কেমন যেন নিবিড় নিঃসঙ্গতায় ভুগে। তিথিডোরও এর বাইরে নয়। বুদ্ধদেব বসুর জনপ্রিয় উপন্যাস তিথিডোর। আমার নিজেরও ভীষণ প্রিয়। এই উপন্যাসটি মূলত একটি মধ্যবিত্ত পরিবার কে ঘিরে। উপন্যাসটিতে এই পরিবারের সুখ দুঃখের গল্পের পাশাপাশি উঠে এসেছে চল্লিশের দশকের জীবন ব্যবস্থা, তাদের চিন্তা চেতনা , ও জীবন বোধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে প্রভাব সমাজে পড়েছিল তারও পরিচয় পাওয়া যায় এ উপন্যাসে।
উপন্যাসের শুরু রাজেনবাবু আর শিশিরকণাকে দিয়ে। ওরা দুজনেই সদ্য বিবাহিত। রাজেন বাবু মধ্যবিত্ত হলেও স্বভাবে সৌখিন। তবে সে সৌখিনতা যতখানি না বাহ্যিক, তারচে মানসিক দিক দিয়ে উনি বেশি সৌখিন। যার পরিচয় আমরা সমস্ত উপন্যাস জুড়েই পাই। শিশিরকণা সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহিণী। সংসারই যার ধ্যান জ্ঞান।
কিছুদিন পর রাজেন বাবু আর শিশিরকণার ঘর অালো করে এলো একটি ফুটফুটে ধবধবে সাদা মেয়ে। শৌখিন রাজেন বাবু মেয়ের নাম রাখলেন শ্বেতা। একে একে আরও তিন মেয়ে এলো – মহাশ্বেতা, সরস্বতী, শ্বাশতী। তারপর শিশিরকণার মনোবাসনা পূরণ করে এলো একটি ছেলে। রাজেনবাবু ছেলের সাদামাটা নাম দিলেন বিজন। এরও অনেকদিন পরে এলো আরেকটি মেয়ে – ছোট্ট ফুটফুটে, কোঁকড়ানো চুলের অভিমানী মেয়ে স্বাতী। যে এই উপন্যাসের নায়িকা।
স্বাতী জন্মের পরপরই শিশিরকণা বিছানায় পড়েন। এবং মাত্র দশ বছর বয়সে মাকে হারালো স্বাতী। ছোটবয়স থেকেই মাকে তেমন কাছে পায়নি, বোনেদের সাথে বয়সের ব্যবধান সব মিলিয়ে স্বাতী হয়ে উঠে একটু জেদি, অভিমানী। বাবার সাথেই যার ভাব সবচে বেশি।
সেই স্বাতীই মায়ের মৃত্যুর পর যেন একলাফেই অনেকটা বড়ো হয়ে যায়। সেই হয়ে উঠে বাবার একমাত্র অবলম্বন। তাই বড়ো বোন শাশ্বতী, ভাই বিজন যখন নাটক, থিয়েটার নিয়ে ব্যস্ত, স্বাতী বসে থাকে একলা বাড়িতে বাবার অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষায়। স্বাতীর এই নিঃসঙ্গময়তাই পাঠক কে বুঁদ করে রাখে। কারণ স্বাতী অসামাজিক নয়, দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন নয়, আবার কেমন জানি এক নিঃসঙ্গতা বিরাজ করে ওর চারপাশে। এমন নয় যে এতে ও অখুশি। ওর এই বাড়ি, খোলা মাঠ, জানালার ধারে বসে আকাশে মেঘেদের আনাগোনা দেখতেই ভালো লাগে। নীল মেঘ,ছাইরঙা মেঘ, কালো মেঘ কোথায় যায় ওরা! এসব ভেবে ভেবেই স্বাতীর মন আনমনা হয়ে যায়।
বুদ্ধদেব বসু যে স্বভাবে কবি, তা এই বইয়েও প্রকাশ পায়। প্রকৃতির এতো নিখুঁত বর্ননা বুদ্ধদেবের বইয়েই পাওয়া সম্ভব। একলা স্বাতী, আনমনা স্বাতী, এলোমেলো, কোঁকড়ানো চুলের কয়েকগাছি কপালে পড়ে থাকা স্বাতীর জীবনে এলো সত্যেন রায়। পেশায় প্রফেসর, ভীষণ পড়ুয়া, দেখতে সুদর্শন,কিন্তু গোবেচারা স্বভাবের সত্যেন। কোন পিছুটান নেই, অথচ চোখের দিকে তাকালে কেমন মায়া কাজ করে, বই আর যেখানে সেখানে বেড়িয়ে পড়াই যার নেশা। সেই সত্যেন ভীষণভাবে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত এবং উনার তিরোধানের দিনই স্বাতী আর সত্যেনের পথ এক হয়েছে।
হঠাৎ হঠাৎ হাওয়া হয়ে যায় যে সত্যেন, সেই সত্যেন স্বাতীর এক চিঠিতেই এতো দূর থেকে চলে আসে। কেমন জানি ওদের সম্পর্ক টা। যেখানে কোন ঘোষণা দিয়ে বলতে হয় না ভালোবাসি, অথচ অদৃশ্য সুতোয় দুজনেই বাঁধা। তাই তো শেষবার যখন সত্যেন বেরিয়ে পড়তে চাইছিলো অজানার উদ্দেশ্যে, পারেনি তো! ঠিক তেমনি স্বাতী একটি মাত্র কথা উচ্চারণ করেই তার সমস্ত অব্যক্ত ভালোবাসা প্রকাশ করতে পেরেছে – ” না। যেয়ো না।”
স্বাতী আর সত্যেন ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রগুলোর কথা না বললেই নয়। স্বাতীর সব বোনদের কথা বিস্তারিত না এলেও, শ্বেতার মাঝে ফুটে উঠেছে মাতৃরূপ। আর তাই সত্যেনের মতো পিছুটান হীন লোকেরও লোভ হয় একটি পরিবারের। শ্বেতারা জানে কিভাবে নিজের দুঃখ কে লুকিয়ে অন্যকে সুখী করতে হয়। তাই সদ্য বিধবা শ্বেতা সবার সামনে স্বাভাবিক থেকে নিরবে অশ্রু মুছে।
শাশ্বতী আর হারীতের মাঝে তখনকার বদলে যাওয়া সমাজের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফ্যাসিবাদ বিরোধী বুদ্ধদেব এসবের পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবোধ বিচ্যুতি ও তুলে ধরেছেন। বিজনের হঠাৎ ব্যাবসায় এতো লাভ, মজুমদারের ফুলে ফেঁপে উঠা এসবই খুব সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসটি শেষ হয়েছে স্বাতী আর সত্যেনের বিয়ের অনুষ্ঠান দিয়ে। যদিও শেষের দিকে বর্ণনা একটু দীর্ঘ মনে হয়, তবুও ভালো লাগায় মন ছেঁয়ে যায়। একটি বিয়ে নিয়ে কতোগুলো মানুষের পরিকল্পনা, অংশগ্রহন, হৈচৈ, কতো পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়.. সবকিছুর টুকরো টুকরো বর্ণনা মনকে ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করে রাখে। শেষটাতে বিজনকেও ভালো লেগে যায়। আর রাজেন বাবু আর শ্বেতা যেন একজন আরেকজনের অবলম্বন।
“তিথিডোর ” উপন্যাস টি একাধারে একটি পরিবারের কথা বলে, একটি মিষ্টি প্রেমের সমাপ্তি ঘটায়, আবার তৎকালীন সমাজের চিত্রও ফুটিয়ে তুলে । সম্পুর্ন উপন্যাসটি যেন কাব্যময়তা আর নিঃসঙ্গতায় ঘেরা।
Views: 35