– চল দূরে কোথাও হারিয়ে যাই!
– কি করে হারাবে? ঘরে তোমার হাজবেন্ড আর ছেলেমেয়েরা অপেক্ষায় আছে যে!
– তো কি হয়েছে তোমারও বউ বাচ্চা হয়তো অপেক্ষায়! মাঝেমাঝে অবশ্য এসব আটপৌরে জীবন বাদ দিয়ে জীবনকে উপভোগ করতে হয়!
– এটা সত্যি বলেছো! একঘেয়ে জীবন থেকে মাঝে মাঝে মুক্তি পেতে তোমার মত গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরে শতবার আমি হারিয়ে যেতে রাজী। চল, কোথায় যাবে নিয়ে যাই!
– অনেকদিন লং ড্রাইভে যাইনা। শরতের মাঝামাঝি চলছে। দারুন কাশ ফুল ফুটেছে এখন। কাশবনে ঘুরে আসি চল! কতদিন কাশবনে হাত ধরে তোমার পাশাপাশি হাঁটিনা।
– কিন্তু বাসায় কি বলবে? ওরা টের পেয়ে গেলে কি মনে করবে?
– যা মনে করে করুক না! ওরা এখন বড় হয়েছে। নিজেদের ওদের যদি ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে তবে আমাদের কেন নয়? শুধু ওদের পেছনেই কি জীবনটা কাটিয়ে দিবো? বাঁচবই বা কতদিন। নিজেদের জন্য একটু মাঝে মাঝে বাঁচতে হয়। নিজেদের ভালো লাগা না লাগার মূল্যায়ন করতে হয়। অনেক তো করেছি। একটু স্বাধীনতা কি আমাদের প্রয়োজন নেই? নতুবা একসময় দেখবো দীর্ঘশ্বাসের সাথে সব চাওয়াগুলি কোথায় মিলিয়ে গেছে!
– আজ তো ম্যাডামের পুরাই হট মুড! তাহলে চল! সেই আগের মত আজ কাশবনে হারিয়ে যাই দুজন! চলতে চলতে তোমার সুমধুর সুরে দু একটা রোমান্টিক গান কিন্তু শুনতে চাই! শোনাবে তো!
– অবশ্যই!
– তুমি তো বাকি সময়ের জন্য অফিসে ছুটি নিয়ে নিয়েছো তাইনা, সুমন! সেই আগের স্টাইলে বরাবরের মতই মিথ্যা অজুহাত দেখিয়েছো নিশ্চয়ই।
– হা হা! তাতো একটু দেখাতেই হয়! না হলে এতো এতো দায়িত্ব রেখে এভাবে কি হুট করে সরে পড়া যায়, বল! তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি! এটা কিন্তু তুমি ভালো করেই জানো!
– হুম। কি পারো আর কিনা পারো সে আমার জানা আছে। এ সমস্ত ঢং এর কথা বাদ দাও।
– কিন্তু ম্যাডাম, তুমি বাসা থেকে কি বলে বের হলে?
– বলেছি কিছু একটা। সবকিছু কি জানতে হবে?
– আমাকে তো জানতে হবে তুমি কি বলে বের হলে! কতটা স্মার্টনেস এখনো বেঁচে আছে তোমার মধ্যে সেটা তো জানা দরকার। ফিউচারে আবার যদি এভাবে তোমার সাথে লুকিয়ে ডেটে যেতে চাই তাহলে আমাকে তো বুঝতে হবে তুমি কতটা হ্যান্ডেল করে আসতে পারছো তোমার ফ্যামিলিকে! পরে আবার কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়!
– বলেছি অনেকদিন পরে সুইজারল্যান্ড থেকে আমার ফ্রেন্ড এসেছে। ওর বাসাতে আমাদের ফ্রেন্ডসদের গেট টুগেদার পার্টি আছে। সেজন্য যাচ্ছি। ব্যস, দ্যাটস ইট!
– কিন্তু বেণু, একবার কি ভেবেছো কত বড় অন্যায় করছি আমরা! এই বয়সে এভাবে লুকিয়ে প্রেম করাটা কি অন্যায় নয়! তাছাড়া কোনোভাবে যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে ছেলে মেয়েদের সামনে আর মুখ দেখানোর উপায় থাকবেনা।
– অন্যায় হলে হলো, আই ডোন্ট কেয়ার। লুকিয়ে প্রেম করা ছাড়া আর উপায় কি এখন বল। এই বয়সে এসে প্রেম করতে গেলে এমন একটু লুকিয়েই করতেই হয়।
– হুম। তা অবশ্য মন্দ বলনি।
রাস্তা ফাঁকা থাকায় ধীরে ধীরে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল সুমন। বাইরে হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। বেনু গাড়ির গ্লাস খুলে দিল। বাতাসে বেনুর এলোমেলো চুলগুলো বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে সুমনের মুখখানি।
– তোমার চুলের ঘ্রাণটা মদের নেশার থেকে কোনো অংশে কম নয়।
– মদ বুঝি খুব খাও আর নেশাও বুঝি খুব ধরে!
– আরে না! ও জিনিস ছোঁয়ার সাহস পেলাম কোথায়! যে না আমার বউ। মাঝে মাঝে কোনো পার্টি হলে আমার বিদেশি বন্ধুরা নিয়ে আসে ওইসব। আমি অবশ্য ছুঁয়ে দেখারও সাহস পাইনা। এজন্য বন্ধুরা সবাই মিলে আমাকে খ্যাত বলে ডাকে। আমি ছুঁয়েও দেখিনা কারণ শখের বশে একবার দুইবার খেলে দেখা যাবে এক সময় অভ্যাস হয়ে গেছে, তখন ছাড়তে সমস্যা হবে! তাছাড়া
বাপরে বাপ! কোনোভাবে যদি একদিন ওইসব জিনিস ছুঁয়ে দেখতাম আর নেশাগ্রস্ত হয়ে ওভাবে আমি বাসায় যেতাম, কি হত তুমি চিন্তা করেছো! একদম পুরা মহাভারতের কাহিনী হয়ে যেতো ! রক্তারক্তি ব্যাপারও ঘটে যেতে পারতো। তুমি তো আমার বউ কে চেনোনা, পুরাই একটা জল্লাদ! আমার এত বড় বড় বাচ্চাগুলোকে যখন শাসন করে তখন আমিই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকি, অবশ্য তাকে এটা বুঝতে দেইনা।
– হয়েছে হয়েছে! সুযোগ বুঝেই বউয়ের বদনাম করতে শুরু করেছো। তোমাদের পুরুষদের এই একটা স্বভাব! চান্স পেলেই কোথাও বউয়ের বদনাম করতে তোমরা একফোঁটাও ভুল করো না। তুমিও যে কত ভালো সে বুঝি আর আমি জানিনা।
– পুরুষরা বদনাম বলে জানা ছিল না তো! আমি তো জানতাম এ কাজ মেয়েরাই করে!
– তোমার জানার মধ্যে ভুল আছে। যাই হোক কি করেছো আর কি না করেছো সে সব হিসাব-নিকাশ পরে হবে। যে ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস আসছে বাইরে থেকে এমন সময় তোমার একটা গান হলে কিন্তু মন্দ হতো না। প্লিজ, ওই গানটা একটু ধরো না! কতদিন তোমার সুরে ওই গানটা শোনা হয় না।
– কোনটা?
– ওই যে “আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে! ”
উত্তরা দিয়াবাড়ির দিকে সা সা করে ছুটছে গাড়ি।
সুমনের সাথে সাথে বেণুও আজ সুর তুলেছে। বাতাসের সাথে দূর থেকে দূরে দুলে দুলে মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের সুর। যেনো মনের টানে একজোড়া প্রেমের পাখি হারিয়ে যাচ্ছে দূর-দূরান্তে।
“আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে!
সেই অঙ্গীকারের রাখী পরিয়ে দিতে
কিছু সময় রেখো তোমার হাতে।
কিছু স্বপ্নে দেখা, কিছু গল্পে শোনা
ছিলো কল্পনা জাল এই প্রাণে বোনা
তার অনুরাগের রাঙা তুলির ছোঁয়া
নাও বুলিয়ে নয়ন পাতে।
আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে।।”
চারদিকে সাদা কাশফুলের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রবেশ করতেই ফুরফুরে আমেজ বয়ে যেতে লাগলো বেণু ও সুমনের মনে। বাতাসের সাথে সাথে কাশবন দুলছে। দেখে মনে হচ্ছে কাশফুলগুলো যেন ঢেউয়ে ঢেউয়ে তাদেরকেই স্বাগতম জানাচ্ছে।
ভিতরে ঢুকতে দেখা মিলে আরো অনেক দর্শনার্থীর। কেউ হাতে কাশফুল নিয়ে সেই মুহূর্তটাকে তাদের ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত। কেউ আবার এই ঘন কাশবনের একটু ভিতরে যাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।
– জানো সুমন, কাশফুলের সঙ্গে রোমান্টিকতার এক অদ্ভুত সম্পর্ক! এখানে আসতে না আসতেই সেই স্টুডেন্ট লাইফের কথা মনে পড়ে গেল! মনে পড়ে সেই দিনগুলো তোমার! বিয়ের পরেও অনেক বছর ধরে সেই দিনগুলোকে মিস করতাম।পরে ধীরে ধীরে সংসারের যাঁতাকলে পড়ে এসব আর মনে পড়তো না। কিন্তু আজ অনেক বছর পরে সেই একই জায়গায় সেই তোমাকে পেয়ে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি। কি এক অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছে মনের ভিতরে তোমাকে বোঝাতে পারবো না। মনে হচ্ছে সেই প্রথম প্রেমে পড়ার মতো অনুভূতি! তোমারও কি একই রকম হচ্ছে?
– তোমার মত অত সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারব না তবে আমারও যে খারাপ লাগছেনা! কেমন যেন অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে! তুমি তোমার ভালোলাগা গুলোকে কত সুন্দর করে প্রকাশ করতে পারো সেই আগের দিনের মতো। এর জন্য কিন্তু তোমার স্বামী বেচারাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তার রোমান্টিকতাই হয়তো তোমার রোমান্টিকতাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। আফসোস আমার নিজের জন্য! আমার বউটা আমাকে সেই সুযোগ দিলে তো!
– শোনো, এখানে আমরা ঘুরতে এসেছি। এখানে এসে তোমার বউ এবং আমার স্বামী দুজনের কোনো গল্প হবে না। আমরা এখানে প্রেম করতে এসেছি। চুটিয়ে প্রেম করব। একদম সেই আগের মত।
– ওকে ম্যাম!
পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের কিরণ কাশফুলের ওপর পড়েছে , কাশফুলের মুগ্ধতা আর পশ্চিম আকাশের রঙে রঙে রঞ্জিত রংধনু, এ দুইয়ের মিথস্ক্রিয়ায় অদ্ভুত এক আভা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। বেণু আর সুমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে। যত দূরে চোখ যায়, দৃষ্টিজুড়ে শুধু কাশবন আর কাশবন। বিস্তীর্ণ এলাকা যেন শুভ্রতার চাদরে মোড়া এক অপরূপ সৌন্দর্যের রাজ্য।
সবুজ নরম ঘাসের উপরে সুমন আর বেণু বসলো। হঠাৎ করে বেণুর ডান হাতটা চেপে ধরলো সুমন।
– কি মন চাচ্ছে জানো, বেণু!
– উহু, জানিনা! কি মন চাচ্ছে বল।
– মন চাচ্ছে যুগের পর যুগ তোমাকে নিয়ে এভাবে এখানেই বসে থাকি।
– তাই নাকি! তুমি তো বললে তোমার বউ নাকি একদম জল্লাদ ! তুমি আমাকে নিয়ে এখানে যুগের পর যুগ বসে থাকলে বাসায় যেয়ে তোমার উপরে উত্তম মধ্যম যদি হয় তখন কি করবে?
– জল্লাদ ঠিক না! জল্লাদের খালাতো বোন বলা চলে! হালকা-পাতলা একটু দয়া মায়া আছে। উত্তম-মধ্যম হবে, তবে একমাত্র স্বামী তো! তাই হয়তো একটু ছাড় পেতে পারি।
– হা হা! স্বামী বুঝি কারো দুইমাত্র হয়?
– বিয়ের আগের সেই দিনগুলির কথা তোমার মনে পড়ে!
– পড়ে! খুব পড়ে!
– গান গাওয়ার সাথে সাথে তুমি অনেক ভালো নাচতে পারতে। নাচের অভ্যাসটা কি এখনো আছে, নাকি সংসারের ব্যস্ততায় সবকিছু ভুলে গিয়েছো!
– নাচ-গান করার এখন আর সময় কোথায়? আমার স্বামী বাবু সেই সময় দিলে তো!
– সময় করে স্বামীকে মাঝে মাঝে দেখালেই পারো! সে বেচারা হয়তো ব্যস্ততার কারণে সময় পায়না। তাই বলে তুমিও কি একটু সময় করে তার মনোরঞ্জন করতে পারোনা?
– আমার বয়েই গেছে! ভালো করে সে কখনো আমার দিকে তাকানোরই সময় পায়না আর নাচ দেখবে, তাও এই বুড়ো বয়সে! সে অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতেই দিন রাত পার করে কখন তাই টের পেলে তো! কোনোদিন চুলটা আঁচড়ালাম কিনা, চোখে কাজল আঁকলাম কিনা, লিপষ্টিকে ঠোঁট জোড়া রাঙালাম কিনা সেটাই তাকিয়ে কবে দেখেছে মনে করতে পারছিনা! সপ্তাহের সাতদিনই একই রুটিন তার। নানান কাজের ব্যস্ততা আর অজুহাত। তার কাজকে তো আমার এখন সতীন মনে হয়।
– হা হা! এভাবে বলছো কেনো? অর্থ ছাড়া সমাজে চলাটা মূল্যহীন। এইসব তো সে তোমাদের জন্যই করছে! তার কষ্ট কি তোমরা বোঝ?
তারও তো মন চায় তোমাদের সাথে সময় কাটাতে! তোমার আর ছেলেমেয়ের কথা ভেবেই হয়তো সে এভাবে অর্থের পেছনে হণ্য হয়ে ছুটছে।
– সে না হয় বুঝলাম। আর কত? এক জীবনে আর কত লাগবে? কাল যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে কি হবে? হায়াত মউতের কি আজকাল ঠিক ঠিকনা আছে! আমার কি মন চায়না তার সাথে একটু একান্ত সময় কাটাতে! ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ওরা যার যার মত পড়াশোনা আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রান্নাঘরের কাজ ছাড়া আর কিইবা করার আছে! সারাদিন একাকীত্ব যেন আমার পিছু ছাড়েনা। মন চায় ওর সাথে একটু একান্ত সময় কাটাই। কিন্তু কোথায় কি? রাতে যখন ফিরে প্রচণ্ড ক্লান্ত! ক্লান্তি নিয়েই বিছানাতে যায়। তখন কি আর গল্প করার ইচ্ছে জাগে! রুটিন বাঁধা কথাবার্তা ছাড়া আর কিছুই হয়না। সকালবেলা উঠে সেই একই নিয়ম। এখন তো মনে হয় মনটাই মরে গেছে।
এজন্যই তো আমার পুরানো প্রেমিকের খোঁজখবর নিলাম। হঠাৎ করে মনে হলো তাকে নিয়ে এই বুড়োবয়সে ঘুরে এলে একটু সময়তো কাটবে! তাইতো হুট করে দুপুরের খাবারের পর এই প্লান মাথাতে আসলো। তাই তোমাকে মেসেজ করেছি।
– হুম। অনেক অভিযোগ দেখছি স্বামী বেচারার প্রতি। বেচারার দেখছি পদে পদে দোষ! যে
মেসেজ দিয়েছো তাতে যে কোনো পুরুষেরই মাথা আউলা হয়ে যাবে। আর আমি তো তোমার পুরানো প্রেমিক। আর পুরানো প্রেমিকাকে কাছে পেতে কার না ইচ্ছে করে, বল!
কিন্তু এই টাক পড়া, পাকা চুলের মানুষটির মাঝে তুমি কি তোমার সেই মানুষটিকে খুঁজে পাচ্ছো?
– উহু! আমার কাছে তুমি আজও সেই প্রথম দিনের মত। তোমার প্রতি এক ফোঁটার জন্যও ভালোলাগা, ভালোবাসা কমেনি, উলটো বেড়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোমার বরং আমার হাজবেন্ডের মত এই ভুঁড়িওয়ালি, মোটা বান্ধবীকে এখন আর সেই আগের মত ভালো লাগছেনা, তাইনা! আমার হাজবেন্ড তো সুযোগ পেলেই এই ভুঁড়ি নিয়ে খোঁচা মারে। খুব কষ্ট লাগে। সন্তান হওয়ার পরে যে মেয়েদের শারিরীক পরিবর্তন ঘটে সেটা সে কেন বোঝেনা!
– এত এত অভিযোগ ভদ্রলোকের প্রতি তোমার!
– ভদ্রলোক না ছাই! ভদ্রলোকসুলভ ব্যবহার তো দেখিনা!
– তাই! আমার মনে হয় উনি ঠিকই সবই বোঝে। তবে হয়তো তোমাকে ভালোবাসে বলেই ক্ষ্যাপানোর জন্যই এইসব কথা বলে। আর তুমি না কিছুক্ষণ আগে বললে উনার তোমার দিকে তাকানোর সময় নেই, তাহলে তোমার ভুঁড়ি নিয়ে এত মাতামাতি করে কি করে?
– করে করে! দোষগুলি খুব চোখে পড়ে তার। সারাদিন ভালো কিছু করলে তা আর চোখে পড়েনা। একটু
সেজেগুজে থাকলেও দেখেনা। দেখে শুধু কখন কোথায় খুত খুঁজে পাওয়া যায়। ফাজিল লোক!
– আমরা কিন্তু এখানে আসার শুরুতেই প্রমিজ করেছি আজ কোনো স্বামী স্ত্রীর, সংসারের, সন্তানের গল্প হবেনা। আজ শুধু এই সময়টুকু একান্ত আমাদের। তুমি কিন্তু লাইন ছাড়া হয়ে যাচ্ছো, বেণু!
মেসেজে কি লিখেছিলে ভুলে গেছ?
কথাগুলি বলতে বলতে সুমন মোবাইলটার মেসেজটি তুলে ধরলো বেণুর সামনে!
“হে যুবক!
আমি কি কিছু সময়ের জন্য তোমার সাথে কোথাও হারিয়ে যেতে পারি?
সেই আগেকার মত একটি দিনের কিছু সময়ের ব্যস্ততার ফাঁকে সেই পুরানো প্রেমিকার জন্য একটু সময় কি বের করা যাবে? এই সংসারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে আমি কি ক্ষাণিক সময়ের জন্য আমার সেই বিশ বছর আগের মানুষটিকে
সাথে নিয়ে তার হাতে হাত রেখে ভালোবাসার টাইম মেশিনে চড়ে বিশ বছর আগে ফিরে যেতে পারি?
যেখানে আমার স্বামী বা তোমার স্ত্রীর কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা। যেখানে শুধু থাকবে সেই চঞ্চলা যুবতী বেণু আর তার প্রাণের মানুষ স্মার্ট, সুদর্শন, ড্যাশিং যুবক সুমন।
কিছু সময়ের জন্য কি এই একঘেয়ে আর ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্ত হয়ে তোমার হাত ধরে মুক্ত বাতাসে সবুজের অরণ্যে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে পারি? জানিনা, হয়তো এমন সুযোগ দ্বিতীয় বার জীবনে আর নাও আসতে পারে! যদি সংসারের মায়া ত্যাগ করে অতল বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাই, তখন কিন্তু খুব খুঁজবে!
খুব বেশি আজ মন চেয়েছে!
কেনো জানিনা! খুব কি বেশি চেয়ে ফেলেছি তোমার কাছে?
বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছি আজকাল।
উত্তরের অপেক্ষায় তোমার সেই বিশ বছর আগের ভালোবাসার মানুষ,
বেণু!”
মেসেজটা দেখে বেণুর নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। হেয়ালিপনা করে বাচ্চাদের মত কি এক মেসেজ লিখেছে সে! এত আবেগ এই বয়সে আসলেই বড্ড বেমানান।
– তুমি আমার বিশ বছর আগের ভালোবাসার মানুষ হবে কেনো? তোমাকে আমি প্রতি মুহুর্তেই মিস করি। আগের থেকে বরং এখন বেশিই ভালোবাসি। ভালোবাসার গভীরতা সময়ে নয় অনুভূতিতে পরিমাপ করতে হয়। এত কিছু বোঝ, তাহলে আমার চোখে তোমার জন্য যে আকুলিত প্রেম এটা কেন বোঝনা!
তাই কত বছরের সম্পর্ক তা নয়, বোঝার চেষ্টা কর সম্পর্কে দুইজনের সম্পৃক্ততাকে। ভালোবাসায় কমিটমেন্ট থাকে, আশা থাকে, যা নিয়েই একটু একটু করে দুইজনে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। আমরা হয়তো সব কমিটমেন্টগুলি আমাদের কিছু ভুল, কিছু ব্যস্ততা, সংসার আর সন্তানদের কারণে পুরোপুরিভাবে পূরণ করতে পারিনি, তাতে কি!
সময় তো ফুরায়ে যায়নি। এখনো সময় আছে। কথায় আছেনা যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ! আমরা না হয় একটু দেরী করে ফেলেছি। এবার না হয় সেই বিশ বছর আগে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া স্থান থেকে আবার শুরু করবো। তোমার কষ্টগুলিকে ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করবো যেটা তোমার স্বামী করতে হয়তো ব্যর্থ। আমি না হয় বাকি জীবন প্রেমিকের মতই বাঁঁচব। তাও কোনোদিনই আমাকে আর এভাবে ছেড়ে যাবার হুমকি দিবেনা! তাহলে আমি মরে যাবো।
বেণু ছলছল চোখে সুমনের মুখটা চেপে ধরলো।
– এসব কি বলছো! তোমাকে ছেড়ে বেঁচে থাকার চাইতে মৃত্যুও আমার কাছে আরো সহজ মনে হবে।
কথাগুলি বলতে বলতেই সে সুমনকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
সুমনও বেণুকে তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো।
লোকালয় থেকে সরে একটু নির্জন পরিবেশে বসার কারণে ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ নেই। না হলে এই বুড়োবয়সে এদেরকে এসব করতে দেখলে ঢি ঢি পড়ে যেত।
– এই বেণু! মাথা তোল! চল, সেই আগেকার মত একসাথে মিলে একটা ডাবে দুটা পাইপ লাগিয়ে দুজনের মাথাতে দুজন হেলান দিয়ে ডাব খাই।
– লোকে হাসবে!
– হাসুক না! আই ডোন্ট কেয়ার! চলতো!
বেণু আর সুমন সেই আগেকার মত করে একটা ডাব দুজনে শেয়ার করে খাচ্ছে। ঠিক তখনই বেণুর সামনে কোথা থেকে এসে হাজির হলো শোয়েব! বেণুর ছেলে। এবার এইচএসসি পড়ছে। বেণুর চোখ একদম ছানাবড়া। সুমন তখনও শোয়েবকে দেখেনি।
খুব রাগত স্বরে শোয়েব বলে উঠলো,
– আম্মু, আমি জানতাম তুমি এইসবই করে বেড়াচ্ছো। আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিলো। মাই গড! তুমি এসব কেমনে কর,আম্মু!
বেণু থতমত খেয়ে গেল।
– কি করেছি আমি! তোমার তো এখন বাসায় থাকার কথা। তিন্বি আর তন্বীকে রেখে তুমি বাইরে কেনো! ওদের তো তোমার ভরসায় রেখে এলাম।
তিন্বি আর তন্বী বেণুর জমজ মেয়ে। সুমনের সাড়ে তিন বছরের ছোট।
– ওরা ক্লাস নাইনে পড়ে, আম্মু। দুজন এখন নিজেরাই থাকতে পারে। নিজেরাই নিজেদের ম্যানেজ করতে পারবে। কিন্তু তুমি কি এটা ঠিক করেছো? আজ সকালে ঠিকই আমার ঘর গোছানোর বাহানায় ওইসময় আমার সব ইনফরমেশন আড়ি পেতে কালেকশন করে সময়মত বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার নাম করে আমার গুপ্তচরগিরী করতে পিছু নিয়ে এখানে চলে এসেছো তাও আবার আব্বুকে সাথে নিয়ে।
সুমন চুপচাপ এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলো।
শোয়েবের কথা শুনে সুমন আর বেণু দুইজনই চিন্তামুক্ত হলো। কি লজ্জায়ই না পড়তে হতো আজ দুজনকে। যাক ছেলে নিজেই তাহলে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ওদেরকে আর কোনও মিথ্যে অজুহাত দাঁড় করাতে হলোনা।
– আব্বু, আম্মুর কথায় একদম কান দিবেনা! আম্মুর তো সেই আমি কলেজে যাবার পর থেকেই আমাকে অযথা সন্দেহ করার বাতিকে পেয়েছে। ফোনে পাসওয়ার্ড পর্যন্ত দিতে দেয়না। সে মনে করে আমি কোন মেয়ের সাথে নাকি প্রেম করি। যত্তসব আজাইরা চিন্তা আম্মুর! যত বলি না, তার সন্দেহ তত গাঢ় হয়। ফলাফল দেখো, আমাকে ফলো করতে করতে নিজেতো এসেছেই আবার তোমাকেও হয়তো অফিস থেকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে আমার হাতানাতে চোর ধরতে!
– তোমার আম্মু আসলেই কিচ্ছু বোঝেনা। যাক বাদ দাও! আচ্ছা, তোমার হঠাৎ করে না জানিয়ে এখানে আসার কারণ কি?
– হঠাৎ করে না! কালকে প্লান হয়েছিলো আমার চার বন্ধু মিলে এখানে আসবো দুপুরের পরে। আম্মু ভাববে আমি হয়তো গার্লফ্রেন্ড এর সাথে ঘুরতে যাবো। পারমিশনতো দিতইনা, উলটা আজেবাজে বকতো। তাই আম্মুকে না জানিয়েই বের হয়েছি। তবে তিন্বি, তন্বী জানে সব। ওদেরকে বলে এসেছি।
– ও আচ্ছা। কপট রাগ দেখিয়ে সুমন বলল, বেণু ছেলের পিছে পিছে তোমার এভাবে আসাটা কিন্তু একদমই ঠিক হয়নি।
– কেনো? ছেলেকে নিয়ে আমার বুঝি টেনশন হয়না! কদিন আগেই তোমার বন্ধুর টেনে পড়ুয়া ছেলে শাহেদ এক ক্লাসমেটকে বিয়ে করে নিয়ে আসলো। ওর কি এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে? ওতো শোয়েবের থেকেও ছোট। আমার এজন্যই চিন্তা হয়। আগে থেকে ঠিকভাবে ছেলেমেয়ের গাইড না করলে কখন না আবার এমন কোন অঘটন ঘটিয়ে বসবে তোমার ছেলেমেয়েও।
শোয়েব এগিয়ে সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– আম্মু, তুমি এত টেনশন করো না। আমি তোমাদের সন্তান। এমন কোনো ভুল কাজ করব না যাতে তোমাদের মাথা হেট হয়ে যায়।
– ঠিক আছে, চলো। এবার তাহলে বাসায় যাই। নাকি আরো আড্ডা দিবে বন্ধুদের সাথে?
– নাহ। তোমাদের সাথে তো গাড়ি আছে, তাই না! তাহলে তোমাদের সাথেই যাই। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি। একটু অপেক্ষা করো!
– আচ্ছা! তাড়াতাড়ি আসিস।
শোয়েব চলে যাবার পরে তারা দুজন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ছেলের প্রস্থানের দিকে।
– কি ম্যাডাম! ডেট কেমন হলো?
– আর ডেট! মান ইজ্জত যে বেঁচে গেছে সেটাই এখন বড় কথা! আমার তো প্রাণের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল প্রায়। এত বড় ছেলের কাছে যদি ধরা পড়ে যেতাম।
– কি আর হত! ছেলে বড় হয়ে গেছে। সে এখন অনেক কিছুই বোঝে। আম্মু আব্বু না হয় একটু ডেটে এসেছে, তো কি সমস্যা! বুঝলে বুঝুক। তবে তুমি কিন্তু পুরোটা সময়ই সুযোগ পেয়েই শুধু তোমার হাজবেন্ডের মানে আমার বদনাম করেছো!
– আহা! তুমি বুঝি ধোয়া তুলসীপাতা! তুমি মনে হচ্ছে আমার বদনাম করোনি।
– করেছি। তবে হালকা পাতলা। তোমার মত তো নয়। তুমি তো একটু পরপরই আমার বদনাম করেছো।
– বেশ তো! যা সত্যি কথা তাই বলেছি। মিথ্যে তো আর কিছু বলিনি।
– তোমাকে ধন্যবাদ!
– কিসের জন্য?
– কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমার পুরানো প্রেমিকা বেণুকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। আমরা কিন্তু এমন প্লান মাঝেমধ্যেই করতে পারি, কি বল! সবসময়ই যে ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়েই ঘুরতে হবে তেমন কেন? মাঝেমাঝে আমরা নিজেরাই কিন্তু এভাবে বের হতে পারি! একঘেয়ে পানসে জীবন থেকে খানিকক্ষণের জন্যতো মুক্তি মিলবে। আজ রোমান্সটা জমলোনা পুরোপুরিভাবে। নেক্সট টাইমের জন্য তুলে রাখলাম।
বেণু মুচকি হেসে বলল, তাই! চল, সামনে এগুই। শোয়েব চলে এসেছে।
– হুম, চল।।
Views: 228