ভয়ংকর ঘন্টা টা বেজেই চলেছে, ঢং, ঢং। ঢং,ঢং।
ঘুমের মধ্যে একঘেয়ে শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছেন মিসেস রেহানা।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ কেটে গেল হিসেব করে বলা যাবেনা।ঘুমটা পুরোপুরি ভাঙার পর রেহানা টের পেলেন,ফোন বেজে চলেছে অনবরত।
এতক্ষণ তাহলে ফোনের রিং ই বাজছিল, গভীর ঘুমে যেটাকে ঘন্টার শব্দ ভেবে ভুল করছিলেন তিনি।
কটা বাজে? ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলেন রেহানা। রাত ৩.১১। এত রাতে কে ফোন দিতে পারে? ছেলেটা বিদেশ বিভুইয়কে থাকে, হঠাৎ টেনশানে অস্থির হয়ে উঠলেন তাই।
তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা হাতে নিতে গিয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে পরে গেল। যা ভয় করছিলেন তাই, ব্যাটারি খুলে মোবাইল অফ হয়ে গিয়েছে।
মনকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে মোবাইল অন করলেন রেহানা। মাঝের কয়েকটা মিনিট যেন কয়েক ঘন্টার মত মনে হল তাঁর।
১১ মিসড কল। আয়না ফোন দিয়েছে। টেনশান আরো বেড়ে গেল। অনিকের কিছু হয়নি তো?
এখনি তো ফোন দিল! কোথায় গেল মেয়েটা? ফোন ধরছেনা কেন? কলব্যাক করে আয়নাকে না পেয়ে তৎক্ষণাত ভাবছিলেন রেহানা।
-হ্যালো, মা! আয়না হিয়ার। ১৪ সেকেন্ড রিং হওয়ার পর ফোন ধরল মেয়েটা। কি সুন্দর মিষ্টি কন্ঠ! শুনলেই মন ভরে যায়।
– হ্যা মা, তোমার নাম্বার তো সেইভ করা আছে আমার। এত রাতে?
-ওহ স্যরি মা! আই ফরগোট যে, বাংলাদেশে এখন গভীর রাত। আম সো স্যরি।
-না, অসুবিধা নাই! কোন সমস্যা? তুমি ভালো আছো তো? অনিক ঠিক আছে?
অনিকের কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করল মেয়েটা।
আয়না। অনিকের গার্লফ্রেন্ড। বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। অস্ট্রেলিয়াতে জন্ম হলেও খুব ভালো বাংলা বলে। এক্সেন্ট টা একটু ভীনদেশী,এই যা। আর কথাবার্তায় যেন মায়া ঝড়ে পরে।
অনিকের সাথে একই ভার্সিটিতে পোস্ট গ্রাড করেছে আয়না। ছেলে একদিন ফোন করে বলেছিল,
– মা, একটা ভীনদেশী মেয়ে তোমার পুত্রবধূ হতে চায়। কি বলব?
– হাহাহা। কি বলবি মানে? বেশ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেও রেহানা মনে মনে ঠিকই টেনশান করছিলেন ছেলে কি শেষ পর্যন্ত বিদেশিনীকেই ঘরে আনবে!
-মানে হ্যা করব? নাকি না করে দিব? তোমার কি মত?
-আমার কি মত থাকতে পারে? তোর জীবন! তোর যাকে ভালো লাগে তাকেই সংগী করবি।
-মা! আমার জীবন কি শুধুই আমার? আমার পছন্দ তো ভুল ও হতে পারে! এ ব্যাপারে তোমার কোন সে নাই?
-না বাবা! তুই এখন যথেষ্ট ম্যাচইউরড। তোর শিক্ষা দিক্ষা যা বলে, তুই সেভাবে চলবি। আর কিছু ব্যাপার একান্তই নিজের। কারো হস্তক্ষেপ করা চলেনা এসব বিষয়ে।
-হয়েছে!নাও কথা বল…
বলেই আয়নাকে ধরিয়ে দিয়েছিল।প্রথম দিন কথা বলেই মেয়েটাকে বেশ ভাল লেগে যায় রেহানার। কি সুন্দর বাচ্চাদের মত খিল খিল করে হাসে।
আয়না। এ নামের অর্থ তো প্রতিবিম্ব। নামের মতই স্বচ্ছ মেয়েটার মন, একথা প্রথমদিনেই বুঝেছিল রেহানা। এরপর ভিডিও কলে কয়েকবার আলাপে বুঝেছে মেয়েটা আসলেই মনের ভাব আড়াল করতে পারেনা। মনে মনে বিরক্ত হলেও সেটা নিমেষেই তার চেহারায় ফুটে উঠে। এতটাই সরল সে।
-কি হয়েছে মা? এভাবে কান্না করছো কেন? আমাকে বল?
-মা অনিক আমাকে এভইড করছে, আমার সাথে কন্টাক্ট বন্ধ করে দিয়েছে। এই যে মেয়েটা তাঁকে আন্টি না বলে মা বলে ডাকে, এই ব্যপারটা ও বেশ লাগে রেহানার।
-সে কি? কেন?
-আই ডোন্ট নো মা। হি ডিড নট মেনশান এনি রিজন,নাইদার এক্সপ্লেইন্ড মাই ফল্ট।হি জাস্ট স্টপড টকিং টু মি। ফোন ও পিক করছেনা।
-একদিন বিরক্ত হয়ে মেসেজ করে জানিয়েছে, হি ডাসন্ট ওয়ান্ট টু কন্টিনিউ উইদ মি। হি ওয়ান্টস দা রিলেশান বি ফিনিশড।
-সে কি? রাতে শোয়ার আগে ও কথা বললাম। কিছুই তো বললনা। হঠাৎ কি হলো ছেলেটার? তুমি চিন্তা করোনা মা, আমি কথা বলে দেখছি, সব ঠিক হয়ে যাবে, রিলাক্স!
তোমার মা বাবা ভালো আছেন?
-জ্বী মা, ভালো আছেন উনারা।
-ঠিক আছে মা, তুমি এভাবে কান্নাকাটি করোনা, তোমার প্যারেন্টস তো টেনশান এ পরে যাবেন। আমি দেখছি, অনিকের কি হলো।
মেয়েটা এত সুন্দর করে মা বলে, মনটাই ভরে যায়। ওকে আশ্বাস দিয়ে ফোনটা রাখলেও ভীষন উৎকন্ঠায় ছেয়ে রইল রেহানার মনটা।
অনিক হুটহাট কোন ডিসিশান নেয়না। নিছক হেয়ালির বশে আয়নাকে এতটা কষ্ট দেয়ার পাত্র ও সে নয়। যা করছে অনেক ভাবনা চিন্তা করেই করছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে ও রেখে দিলেন অনিকের মা। আরো কিছুটা সময় যাক, ছেলেটাকে একটু স্পেইস দিতে চান তিনি এই অস্থিরতার সময়টাতে। অনেক কষ্টে দাতে দাত চেপে নিজের দুশ্চিন্তা দমন করে তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন ছেলের ফোন কলের জন্য। দিনে দুবার নিয়ম করে ফোন দেয় অনিক, একবার মা ঘুমাতে যাওয়ার আগে, আরেকবার নিজে ঘুমানোর আগে।
-হ্যালো মা, কি করছ? আজ বিকেলে কি নাস্তা?
-আজ কিছু করিনিরে, তোর বাবা গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন, আমি শুধু চা খেলাম। আরলি ডিনার করে ফেলব।
-হুম। মা, ভিডিও কল দিচ্ছি, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
ভিডিও শেয়ার দিয়ে আতকে উঠলেন রেহানা।
-এ কি চেহারা হয়েছে তোর? নাওয়া খাওয়া কি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?মুখটা এত শুকনা লাগছে কেন?
-কি যে বল মা! একটু আগেই তো চিকেন সাসলিক আর গাদা খানেক স্যালাড খেলাম।
-অনিক! তুই খুব ভালো করেই জানিস, তুই যতই ধূরন্ধর হোস না কেন, আমি সেই ধূরন্ধর এর মা। কি নিয়ে টেনশান চলছে ঝটপট বলে ফেল দেখি!
– কিছুনা মা, অফিসে একটু স্ট্রেস যাচ্ছে৷
-আয়না কেমন আছে?
-আছে হয়ত ভাল।
-হয়ত মানে? অনিক, কি হয়েছে? আমার দিকে সরাসরি তাকা। আমার চোখের দিকে তাকা। বল কি হয়েছে?
-মা, আয়না শহীদ সাহেবের মেয়ে।শহীদ সারওয়ার।
অনেক কাল বাদে নামটা শুনে বুকটা ধক করে উঠল রেহানার। আর মনে পড়ে গেল সুদূর প্যারিস থেকে ভেসে আসা সেই কন্ঠস্বর, “রেহানা, আমি শহীদ, ঠিকঠাক মত পৌঁছেছি আমি, সকালের সেশানটা ও অন টাইম ধরতে পেরেছি, তুমি ভাল আছ?”।
শহীদের সাথে সখ্যতার দিন গুলোতে যখন একা থাকত রেহানা, এই একটা লাইন বারবার মনে পড়ত। আর মনে হতেই তাঁর ভেতরে অদ্ভূত রোমাঞ্চের উদ্রেক হতো।
তাকে ছেড়ে যাওয়ার পরের দিনগুলোতে ও প্রথম প্রথম এই কথাটাই রেহানার কানে বাজত সারাক্ষণ রিনিঝিনি করে আর মনে পরতেই কান্নার ঢেউ উঠত তার মনে।
কিন্তু শহীদের কথা তো অনিকের জানার কথা নয়! সত্যিই কি আয়না শহীদের মেয়ে? আর অনিক ই বা শহীদের বৃত্তান্ত জানল কি করে?
– কোন শহীদ সারওয়ার, আমি কি চিনি উনাকে?
-মা, আমি তোমার ডায়েরি পড়েছিলাম একদিন। আমি সব জানি মা।
মা, আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি স্যরি, আমি না বুঝে সেদিন ডায়েরি টা পড়া শুরু করেছিলাম। তোমার লেখা এত সুন্দর, মন্ত্র মুগ্ধের মত পড়ছিলাম। মাঝে এসে যখন টের পেলাম, তোমার ব্যক্তিগত বিষয় পড়ে ফেলছি, তখন পড়া বন্ধ ও করে দিয়েছিলাম।
কিন্তু মা, তুমি জীবনে এত কষ্ট পেয়েছ, আমি নিজেকে দমন করতে পারিনি। সেই কষ্টগুলোকে একবার ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছাকেও প্রতিরোধ করতে পারিনি । লোকটা কিভাবে, কি কারণে এত কষ্ট তোমাকে দিল, তার সবটুকু না জেনে শান্তি হচ্ছিল না। তাই পড়েছিলাম। ক্ষমা কর মা।
-ঠিক আছে। কিন্তু বাবা, আমি এখন ও নিজেই পরিষ্কার না, লোকটা আমাকে আসলেই ঠকিয়েছে কিনা। সে কিন্তু কখনো মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলেনি, আমিই ধরে নিয়েছিলাম সবকিছু।
-না মা, লোকটা তোমার সরলতার সুযোগ নিয়েছে, তোমাকে তার দুঃসময়ে ব্যবহার করেছে, ভালো ও হয়ত বেসেছিল, কিন্তু দ্বায়িত্ব নিতে চায়নি।
-অনিক, সে কিন্তু আমার ক্ষতি করেনি কিছু, আর আমার অপমান হয় এমনকিছু ও কখনো করেনি।
-মা! লোকটা তোমাকে ভালোবাসা শিখিয়েছে, ভালোবেসে সব উজাড় করে দিতে শিখিয়েছে। আর যখন তোমার তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তখন ছেড়ে গিয়েছে তোমাকে, দ্বায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে, এটাই কি বড় ক্ষতি নয়?
মা, সফল প্রেম, ব্যর্থ প্রেম আর একতরফা প্রেম ছাড়া ও আরো এক রকমের প্রেম আছে। স্বার্থপর প্রেম। ভালোবাসবে, ভালোবাসা নিবে, কিন্তু দ্বায়িত্ব নিবেনা। লোকটা তোমার সাথে তাই করেছে। হিপোক্রেট একটা।
-বুঝলাম, কিন্তু তাতে আয়নার কি দোষ?
-আয়নার কোন দোষ নেই মা, সে তার বাবার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছে হয়ত। ন্যাচার’স রিভেঞ্জ বলে একটা কথা আছে মা, আমাদের ক্ষেত্রে হয়ত তাই হচ্ছে। নইলে এত মেয়ে থাকতে এই বিদেশ বিভুইয়ে এসে তার সাথেই কেন আমার পরিচয় হল আর আমরা একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তই বা কেন নিলাম?
-আয়না না হয় বাবার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছে,কিন্তু আমার ছেলের কি দোষ? সে কেন কষ্ট পাবে? আর তাছাড়া, ধর, তোর বাবার করা কোন অপরাধের জন্য তোর ভালোবাসা যদি তোকে ছেড়ে যেত? কেমন লাগতো তোর, ভেবে দেখেছিস একবারো?
সবচেয়ে বড় কথা, তুই যখন কমিটমেন্ট করেছিলি তখন তো বাবার পরিচয় না জেনেই মেয়েটাকে সারাজীবন পাশে থাকার কথা দিয়েছিলি, আজ যদি তাকে বিনা দোষে কষ্ট পেতে হয়, তাহলে শহীদের সাথে তোর পার্থক্য থাকল কই?
-কিন্তু মা…
-কোন কিন্তু না, আর ভালই তো হল, এই সুযোগে বেয়াই সাহেবের কাছে জেনে নিব, উনি আসলে কি চেয়েছিলেন? আর কি পেলেন! হা!হা!হা।
বেয়াই সাহেব! নিজের কথায় নিজেই অট্ট হাসিতে ফেটে পরলেন রেহানা।
ছেলে কে তিনি প্রমিস তো করিয়েই ছাড়লেন যে সে আয়নার হাত কখনো ছাড়বে না, একা ছেড়ে দিবেনা। কিন্তু মনের মধ্যে তাঁর উত্থাল পাত্থাল ঝড় বইতে লাগল। এত বছর পর শহীদের মুখোমুখি হবে কি করে সে? তরুণ বয়সে যাকে সে সোলমেইট ভেবেছিল আজ তাঁরই সাথে কি যোজন যোজন ব্যবধান।
কিন্তু না, তাঁকে পারতেই হবে। তিনি যে মা! অনিকের মা, আর এখন আয়নার ও……
Views: 131