বাবা হয়ে কন্যা সন্তান প্রত্যাশার পূর্বে আপনার ঘরে যেই কন্যা সন্তানটি স্ত্রী রূপে এসেছে তার যথাযথ সম্মান নিশ্চিত করুন। নিশ্চিত করুন তার নিরাপত্তা আপনার এবং আপনার পরিবারের শারিরীক ও মৌখিক নির্যাতনের হাত থেকে। একজন মা সচরাচর চেয়ে থাকেন তার পুত্র সন্তান হোক। কেন চান? তার ভরণপোষণ নেবে বলে? তার সাথে সম্পর্ক ভালো হবে বলে? না, পুত্র সন্তান কামনার পেছনে তার নারী জীবনের প্রাপ্ত কষ্টগুলো দায়ি। ভয়, অপমান, অবহেলা, ত্যাগ এসব নির্মম বাস্তবতা দায়ি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবনে এসব ভয়, অপমান, অবহেলা, ত্যাগ মারাত্নক আকারে লেগে থাকে।
একটা মেয়ে যখন গর্ভবতী হয় তখন সবার চাওয়া থাকে পুত্র সন্তানের, কেবল বাবা আশায় থাকে একটা রাজকন্যা আসুক। গর্ভবতী মায়ের উপর এ বড় কম মানসিক নির্যাতন নয়! কোল জুড়ে এলো কন্যা সন্তান, বাবা খুশি হলেন, কিন্তু সমগ্র জগতে মেঘের কোলে রোদ হাসলো না, বৃষ্টি দেখা দিলো। এইবার সামলাও মেয়ের ঠ্যালা। মেয়েটা বড় হতে হতে হাটতে শিখে, তখন ভয় হাটতে হাটতে না জানি কোন পারভার্টের কাছে চলে যায় অবুঝ মেয়ে আমার, স্কুলে ভর্তি করালে ভয়, এই বুঝি হায়ানা পড়ার নাম করে হাতিয়ে নিচ্ছে মেয়েটাকে। যে বয়সে ওর দুরন্ত কৈশোর থাকার কথা, ভাবনাহীন জীবন থাকার কথা সেই বয়সে ওকে কাউন্সিলিং করানো হয়, ওর কাছে যাবে না, এভাবে কেউ আদর করলে কামড়ে দিবা, ওভাবে কেউ ডাকলে কাছে যাবা না। সেই শিশু বয়সেই ওকে বুঝিয়ে দেয়া হয় এই পৃথিবী তোমার জন্য নিরাপদ নয়। শৈশব কৈশোর অধিক সতর্কতার সাথে পার করার পরও নিস্তার নেই, প্রাপ্ত বয়সে এসে একদল পর্যবেক্ষক কড়া চোখে পর্যবেক্ষণ করে, মেয়েটি লম্বা নাকি বেটে? কালো না ফর্সা? নাকটা উঁচু নাকি বোচা? চোখগুলো টানা টানা তো? চুলের রঙ কেমন, আর লম্বায় কতোখানি? পেটে ভাজ পড়ে? হাতে পায়ের আঙুলগুলো ঠিক আছে? চেহারায় কোন দাগ নেইতো? শরীরে কোন ব্যামো আছে? এসব নানাবিধ পর্যবেক্ষণ চলে নারীর শরীরটাকে ঘিরে। তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় তুমি যেমন তেমনটি পারফেক্ট নয়, তোমাকে হতে হবে পুরুষ চোখে অসাধারণ অনন্যা। তবেই না তুমি বর পাবে। মেয়েটি তখন কষ্টে থাকে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার বড় অভিমান হয়, কেন এভাবে বানালে? আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে প্রচুর টাকা খরচ করে নিজেকে পারফেক্ট করা যায়, করেও অনেকে কিন্তু মুক্তি কি মেলে? প্রবাদে আছে “ঘষে নাকি রূপ হয় না”৷ বিফোর আফটার ছবি দিয়ে তখন চলে নতুন অত্যাচার। সেসবকে পাশ কাটিয়ে যখন বিয়ের আসনে বসতে চায় তখন দেখা মিলে নতুন পর্যবেক্ষকদের। রান্না পারে? ঘর গোছায় কেমন? মুখে মুখে কথা বলে? হাসে কিভাবে? সেবা যত্ন করবেতো? উপহার হিসেবে কি দেবে? নানারকম অনিশ্চয়তার মাঝে মোটামুটি খুশির জোয়ার দেখে নিশ্চিত ভালো থাকতে পারা রাজকন্যাটি চলে যায় পরের ঘরে।
জন্ম থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত যাদের কোন ভূমিকাই ছিলো না রাজকন্যার জীবনে তারাই এখন তার জীবনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর যারা এতোকাল ধরে বউ হবার যোগ্য করে তুললো তারা হয়ে গেলো পর। অজানা, অচেনা মানুষগুলোর ক্রমান্বয়ে অত্যাচার করে যায় বউটাকে, আবার সেই বউটাকে দিয়েই বাধ্য করানো হয় তাদের সেবা নিশ্চিতে। বিদায় নিয়ে আসা ঘরটাকে কিছু দিতে গেলে দানব আর ডাইনীর থাবা আসলেও সেই ঘরটা থেকে কিছু নিতে মোটেও লজ্জা হয় না তাদের। বরং কেন কিছু দেয় না এ নিয়ে মিটিং মিছিল বসে। আর কিছু দিলেও সেটা কতোখানি, দামী নাকি কমদামী এসব গবেষণা চলে আজীবন। নিজ বাবা মাকে এসব কষ্টের কথা জানানো যায় না, বাবা মা কষ্ট পাবেন এই ভেবে। অন্যান্য কাউকে বলা যায় না, শ্বশুরবাড়ির বদনাম হবে, স্বামীর বদনাম হবে, এ নিয়ে বউকেই সবাই শাসন করবে, ঘরের কথা পরকে কেন বলা হচ্ছে? যাদের ঘরে আছো তাদেকেই খারাপ বলছো? এতো সাহস তোমার! কোন নবাবজাদার ঘরের বেটি তুমি যে তোমাকে মাথায় তুলে রাখতে হবে? মানুষের কাছে আমাদের ছোট করা হচ্ছে, দেখাচ্ছি মজা। নানারকম সমস্যার জালে যখন বউটা দম বন্ধ হয়ে মরার দশা হয় তখন উপায়ন্তর না পেয়ে স্বামীটাকে বলতে যায় কষ্টের কথা। তখন স্বামী বউকে সান্ত্বনা দেয়, মেনে নাও, এমনটিই হয়ে থাকে। স্বামী ঘুমায়, পাশে স্ত্রী এপাশ ওপাশ করে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, সাথে প্রার্থনায় বলে, আমার যেনো কন্যা সন্তান না হয়।
পুরুষদের অনেক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে তারা নিজের সখ আহ্লাদ পূরনে ব্যর্থ। আচ্ছা, এই দায়িত্ব কাদের প্রতি? নিজের বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান তাদের প্রতিইতো? আর একটা মেয়ের দায়িত্ব কাদের প্রতি? বিয়ের আগে যারা কোনদিন তাকে দেখেনি তাদের উপর তথা শ্বশুরবাড়ির লোকদের প্রতি, সন্তান, স্বামীর প্রতি। যারা কন্যাটাকে কখনোই ভালোবাসলো না তাদের সেই কন্যা থেকে ভালোকিছু পেতে হলেতো আগে সেই কন্যাকে ভালোবাসতে হবে, তার জন্য ভালোকিছু করতে হবে, তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। যদি তা নাই হবে তবে কেন সেই মেয়ে অতোগুলো অত্যাচারীকে সেবা দিবে, তাদের জন্য ত্যাগ করবে? কেবল স্বামীকে লালন করেছে বলে? উক্ত স্বামী কি ত্যাগ শিকার করে তার বউটাকে যারা লালন পালন করেছে তাদের প্রতি? শ্বশুরবাড়ির খাবারের মেনুতে চোখ বুলিয়ে তরকারির আইটেম গোনার আগে কখনও ভেবেছেন, আপনার স্ত্রী তার পছন্দের খাবারটা তৃপ্তি ভরে খেতে পারছে কিনা আপনার সংসারে? শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাই হিসেবে কি পেলেন সেই হিসাব কষার আগে বউটার পরনের কাপড়ের দিকে তাকিয়েছেন কি কোনদিন? চেষ্টা করেছেন শ্বশুরবাড়ি থেকে যা পেয়েছেন তার একধাপ বেশি আপনার বউটাকে দিতে? কন্যা সন্তানের জনক হয়ে নিজেকে রাজা ভাবতে চাওয়া পুরুষটা কখনও জানতে চেয়েছেন রাজকন্যাকে বিদায় দেয়া রাজাটা কেমন আছে? তার রাজকন্যাটা কেমন আছে? বাবা হয়ে না হয় ত্যাগ করলেনি নিজের চাওয়া পাওয়া কিন্তু রাজকন্যাটার ভালো থাকার পরিবেশ তৈরি করেছেন কি? আপনার মতো বউকে পারিবারিক অত্যাচারের মুখে ঠেলে দেয়া স্বামী যখন আপনার রাজকন্যার স্বামী হবে তখন ভেবে দেখেছেন আপনার রাজকন্যা কেমন থাকবে? আপনি যেভাবে কোন বাবার রাজকন্যাকে দাসত্বের জীবন যাপনে বাধ্য করছেন তেমনি আপনার আজকের রাজকন্যাটি যে আগামী দিনের দাসী হতে যাচ্ছে ভেবে দেখেছেন কি? রাজকন্যার তো রাণী হবার কথা, কিন্তু তারা দাসি হয় কেন?
শ্বশুরবাড়িতে নারীরা কবে মুক্তি পাবে নির্যাতনের হাত থেকে? কবে নারীর সম্মান নিশ্চিত হবে? নারী নিয়ে বিলাসিতা বন্ধ হবে কবে? নারীর চাওয়া কে কটাক্ষ করা আদৌ কি বন্ধ হবে? নারীর হাত ধরে পুরুষের এগিয়ে যাওয়ার গল্প সবাই করে কিন্তু পুরুষের হাত ধরে নারীর পিছিয়ে যাওয়ার গল্পটা কেন কেউ করতে চায় না? সেটাকে নিয়তি, রীতি বলে কেন ধামাচাপা দেয়া হয়? যার কন্যা সন্তান আছে তার নাকি একটি জান্নাত আছে। যদি সত্যি তাই হয় তবেতো এই জান্নাতগুলোর এমন বেহাল দশা হওয়ার কথা না৷ মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত অথচ এই মায়েরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, নিগৃহীত।
Views: 266