বই—পর্যালোচনা:জাহান্নম হইতে বিদায়
—আব্দুল লতিফ
শওকত ওসমান স্যারের স্বল্পদৈর্ঘ্য উপন্যাস “জাহান্নম হইতে বিদায়” পড়লাম। ছোট এবং হৃদয়গ্রাহী হওয়ার কারনে বিরতিহীনভাবে এক নিঃশাসে বইটি পড়েছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশের একাধিক বরেন্য সাহিত্যিক উপন্যাস, কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ লিখেছেন। এই উপন্যাসটি সেই তালিকায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন সন্দেহ নেই। স্যার আমাদের সাহিত্যজগতের প্রভূত সম্মাননার অধিকারি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। আলোচ্য পুস্তকটিতেও তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছেন। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি।
২৫ মার্চের কালরাত্রির পর থেকে পাকিস্তানী জানোয়ারদের অমানুষিক নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, আর পাশবিক অত্যাচারে এ দেশে একটা নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিক থেকে বিচার করলে নামকরনে জাহান্নম শব্দটির প্রয়োগ হয়ত অমূলক নয়। কিন্তু তবু এ দেশ আমাদের পুন্যভূমি। সর্বোপরি এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মত সোনার সন্তানেরা, সখিনার মত কোমলস্বভাবা নারী, কিরন রায়ের মত বিপ্লবীদের অবস্থান, তাই যে কোন পরিস্থিতিতে দেশটাকে জাহান্নম আখ্যা দিতে মন সায় দেয় না। তাছাড়া বিদায় শব্দটির মধ্যে একটা হতাশা লুকিয়ে থাকে। গাজী রহমানর বিদায় ছিল দেশের বাইরে অবস্থানের একটা সাময়িক ব্যবস্থা, যেটা ছিল মুক্তি আন্দোলনের প্রথম ধাপ বা স্ট্রাটেজি মাত্র। তাই “জাহান্নম হইতে বিদায়” নামটি আমার কাছে কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে গেছে। স্যার বেঁচে থাকলে আমি তাঁকে প্রশ্ন করতাম যে তিনি তাঁর উপন্যাসটিকে “আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়” এ জাতীয় অর্থবহ কোন নাম কেন দেননি? অথচ এই কথাটিই তিনি তাঁর উপন্যাসের শেষ কয়েকটি লাইনের মধ্যে উচ্চারণ করেছেন।
মূল কাহিনি একজন প্রধান শিক্ষক গাজী রহমানকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তিনি এ কাহিনির প্রধান চরিত্র। কাহিনির সময়কাল ২৫ মার্চের বিভীষিকাময় রাত থেকে শুরু করে মাত্র দেড় মাস। তখন সবেমাত্র স্বাধীনতাযুদ্ধ রূপ নিতে শুরু করেছে। প্রথম পর্যায়ে তিনি অবস্থান গ্রহণ করেছেন তাঁর এক ছাত্র ইউসুফের বাড়িতে। ইউসুফের স্ত্রী বাংলার অন্যসব নারীর মত কোমলস্বভাবা সরল এক নারী। তার একমাত্র ছোট ভাই খালেদ ২৫ মার্চের রাতে পাকসেনাদের বর্বর হামলায় নিহত হয়েছে। সখিনা তা জানে না। কিন্তু বোনের অশান্ত মনে সান্ত্বনার প্রলেপ দেবার জন্য গাজী রহমান মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেন যে খালেদ মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছে। তারপর গাজী রহমানের মনে যে প্রশ্নের জন্ম হয়, “কিন্তু একটি রমনীর বুকে ঈষৎ আত্মবল যোগানোর জন্য কি ছলনা প্রয়োজন ছিল?” পাঠকমনেও এ প্রশ্নের জন্ম দেবে সন্দেহ নেই। সত্য তো একদিন প্রকাশ পাবেই। স্বজন হারানোর বেদনা তো তখন সখিনাকে গ্রাস করবেই তবে কী প্রয়োজন এই সাময়িক অসত্যভাষণের?
দ্বিতীয় অধ্যায়ে গাজি রহমান তাঁর অবস্থান বদলের জন্যে নৌ পথে পাড়ি জমিয়েছেন তাঁর বন্ধু রেজা আলির মফস্বল শহরে। নৌকার মাঝি তাঁকে প্রশ্ন করেছে, “শেখ মুজিব কি অ্যারেস্ট অইছে?” তারপর কথাবার্তার এক পর্যায়ে মাঝি তার নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছে,”সাব, শেখ মুজিবরে ধইরব কোন্ হালা। আমি কই হোনেন, শেখ মুজিবর অ্যারেস্ট অইছে না।”
গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষের এই দৃপ্ত বিশ্বাস সম্পর্কে লেখক বলেছেন, “ব্যক্তি নামে আবদ্ধ হয়। তারপর সাধনায় ব্যক্তি হয় ভাবমূর্তি। আইডিয়াকে কোন পশুশক্তি বন্দী করতে পারে?”
বাংলা সাহিত্যের সাহিত্যিকদের লেখনিতে রূপসী বাংলার রূপ ফুটে ওঠে অনেক কাব্য ও কথায়। সে রূপের মোহন শোভায় আমরা বিমুগ্ধ হই, নতুন করে ভালবাসার রঙ প্রলেপ দিয়ে যায় আমাদের হুদয় জুড়ে। আমরা একাত্মতা ঘোষনা করে বলে উঠি, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা আমাদের এই জন্মভূমি। কিন্তু সাহিত্যের রঙ তুলি দিয়ে শওকত ওসমান স্যার সে সময়কার বাংলাদেশের বিষন্নতার যে ছবি আঁকলেন তাতে অশ্রুসিক্ত না হয়ে উপায় থাকে না। নৃশংসতার ছবিগুলো হন্যে হয়ে বিভীষিকার রূপ নেয়। সেদিন পশুর অধম অমানুষদের প্রতি জনমনে যে ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিল তা শিশুমনেও মারাত্মক দাগ কাটে। নিজ জনকের মৃত্য সম্পর্কে শিশু ফালুর মুখে যখন ধ্বনিত হয়, “তুমি কইলে না ক্যান মা, বা-জান আমাগো ধাক্কা দিয়া পাশে ঠেইলা দিছিল, হালা খানকির পুতেরা যহন গুলি ছোঁড়ে। তাই বাজান মইরা গেলেন, আঁরা বাঁচলাম। আমিও হালাদের গুলি করমু।” তখন শোকে আমাদের মনও অবুঝ এই শিশুর জন্যে কেঁদে ওঠে।
তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখি গভীর রাতে প্রেতপুরীর মত স্তব্ধ এক মফস্বল শহরে গাজি রহমান তার বন্ধু আইনজীবি বন্ধু রেজা আলির বাসায় এসেছেন। শহরটিতে মৃত্যুর হিমশীতল নীরবতা। সেখানে পাকসেনারা নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। রেজা আলির বাসায় আগে থেকেই আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করছিলেন আজীবন বিপ্লবী কিরন রায়। ওঁরা দুজনে গাজি রহমানকে নিরাপদে সীমান্ত পার করে ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। গাজি রহমানের মধ্যে একটা হীনমন্যতা কাজ করছিলো। “খামোকা দেশের ভার বাড়াতে জন্মেছিলাম”, এই খেদোক্তির জবাবে কিরন বলেন,”আমি যা করি, তোমার পক্ষে তা সম্ভব নয়, আবার তুমি যা করো, তা আমার সাধ্যের বাইরে”।
“কিছু কিছু মুক্ত এলাকা আছে, যেখানে তোমার মত প্রবীণ শিক্ষক গেরিলা শিবিরে বক্তৃতা দিতে পারে। যুদ্ধ তো শুধু অস্ত্রের কাজ নয়। কেন লড়ছি, কিসের জন্য লড়ছি, তার সঠিক হদিস যদি জানা থাকে, তাগদ অনেক বেড়ে যায়।”
চতুর্থ অধ্যায়ে গাজি রহমান চলেছেন সীমান্তের ওপারে। এখানে তাঁর সঙ্গী সৈয়দ আলি, যাকে তাঁর উপরোক্ত বন্ধুরা সাথে দিয়েছেন, নিরাপদে সীমান্তের ওপারে পাঠানোর জন্যে। এখানে বাসযাত্রা কালে যাত্রীদের সাথে পাকিস্তানী সৈন্যদের দুর্ব্যবহারের ঘটনা বর্নিত হয়েছে।
পঞ্চম অধ্যায়, গাজি রহমান এবং বাসের আরো জনা দুয়েক হেঁটে চলেছেন গ্রাম্য পথে। গন্তব্য বর্ডারের ওপার। এখানে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানা গেল কিভাবে পনের জন রাইফেলধারী পাঞ্জাবী সৈন্যদের তাড়া করে নিরস্ত্র গ্রামবাসীরা তাদের কাবু করে। পঁয়ষট্টি জনের জীবন এবং দুইশত জখমের বিনিময়ে তারা এই পনের জন খানসেনাদের জীবনাবসান ঘটিয়েছিল। এই বীরগাথার বর্ণনায় পাঠক মুগ্ধ হয়ে সেদিনকার এই নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবনতমস্তক হবেন।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে নৌকা চলেছে সীমান্তের খুব কাছে, মাত্র তিন মাইলের মধ্যে। “মাঝি জোরে চালাও, আরো জোরে। এ কোথায় আনলে? এমন সুড়ং। অন্ধকার, দেখছ না চারিদিকে দোজখ। অগ্নিকুন্ড দাউ দাউ জ্বলছে। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য নর-নারী-শিশু দলে দলে এবং ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে আর এক কুণ্ডের মধ্যে। এরা কিন্তু কেউ পাপ করেনি। গ্রামের সাধারন মানুষ। …হাত চালাও মাঝি, দেরি করো না, ওরা পিছু ধায়, যদি এসে পড়ে।”
শেষ অধ্যায়। সৈয়দ আলির দায়িত্ব শেষ হয়েছে। গাজী রহমানের জানা হয়নি তার পরিচয়। সৈয়দ আলি তার স্বরূপ তুলে ধরলো,”গোলামের কোন পরিচয় থাকে না স্যার, গোলাম গোলামই। স্বাধীন বাংলাদেশেই হবে আমার পরিচয়।” বিদায়ক্ষণে গাজী, সৈয়দ আলির হাতে একটা চিঠি দিলেন। তাঁর ছাত্র ইউসুফের স্ত্রীকে লেখা। তার কাছে চিঠিটা পৌঁছে দিতে বললেন। সৈয়দ আলির স্ত্রীর নামও সখিনা। ছোট্ট একটু নাটকীয় আবহ তৈরি করলেন লেখক। তবে হয়ত তার প্রয়োজন ছিল না।
গাজী রহমান পালিয়ে যাচ্ছেন জাহান্নাম থেকে দূরে। মনে আশা, “আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়।”
কাহিনিটি মোটামুটি এ রকম। যেসব চরিত্রগুলো একের পর এক এসেছে, তারা যেন ক্ষণিক দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেছে। চরিত্রগুলোকে কি আর একটু ধরে রাখা যেত না? তাহলে এই উপন্যাসের অবয়ব যে শুধু বড় হতো তাই নয়, পাঠকের ভালবাসা আরো গভীর অন্তরঙ্গতায় চরিত্রগুলোর সাথে মিশে যেতে পারতো। জানিনা, স্যার এর উত্তরে কী বলতেন। তবে অনুপম ভাষার অলঙ্কারে কাহিনির অঙ্গ ভরে থাকলেও আমার ভাললাগা একটা অপূর্ণতায় হঠাৎ শেষ হয়ে গেল।
Views: 314