বই পর্যালোচনা: বিশ্বকবির কালান্তর
আলোচক: আব্দুল লতিফ
রবিঠাকুরের প্রবন্ধ সংকলন কালান্তর। কালান্তর শব্দটি বিশেষ অর্থ বহন করে। কালের বিবর্তনে অখন্ড ভারতবর্ষে যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিলো, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিণত বয়সের ভাবনায় সেই বিষয়টির পরিস্ফুটন ঘটিয়েছেন এই প্রবন্ধ সংকলনের মাধ্যমে। সণাতন ভারতবর্ষ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত যে সব ঘটনা ডানা মেলেছে এ দেশের জনগণের জীবনে, তার একটি সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষন এই প্রবন্ধ সংকলনটির মধ্যে পাওয়া যাবে। যদি প্রবন্ধটি শুধু রাজনৈতিক অথবা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ হতো, তবে প্রবন্ধগুলিকে বিশ্লেষণধর্মী ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক প্রবন্ধ বলে অভিহিত করা যেত। কিন্তু কবিগুরু এই প্রবন্ধগুলির মধ্যে তাঁর সমৃদ্ধ ভাষা এবং উপমায় সিক্ত করেছেন। ফলে ইতিহাস রাজনীতি সমাজনীতির বেড়া পার হয়ে কালান্তর এক অমর উন্নত সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে।
পুস্তক পর্যালোচনা করার সময় যে বিষয়টি আমাকে বাধাগ্রস্ত করেছে তা হলো এর মধ্যেকার তেত্রিশটি পৃথক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ একখাতে গড়িয়ে চলেনি ফলে এর মধ্যে একটি বিভাজনের প্রয়োজন হয়। সেখানেই ঘটে বিপত্তি। আমার মতো অনভিজ্ঞ অভাজন প্রবন্ধগুলির বিভাজনে অক্ষম কারণ প্রতিটি প্রবন্ধ তার পৃথক বক্তব্যবিষয়ে ভাস্বর। তাই প্রতিটি প্রবন্ধের একটি পৃথক পর্যালেচনা করতে বলা হতো তবে হয়তো বিষয়টি অনেক সহজ হতো। কিন্তু সেক্ষেত্রে এই পর্যালোচনা বিশাল আকার ধারণ করতো। সেটা হয়ত অংশুর পাঠচক্রের কর্ণধারদেরও কাম্য নয়। অতএব শর্টকাট পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া আমার মতো আনাড়ি পর্যালোচকের গত্যন্তর নেই।
বিভাজনের প্রশ্ন যখন এসেই পড়লো, একটা গোঁজামিল দেবার চেষ্টা করি। প্রবন্ধগুলোর মধ্যে যে সব উল্লেখযোগ্য দিক চোখে পড়ে তার মধ্যে আছে সনাতন ভারতবর্ষের চিত্র, সেখানে মুসলিম আগমন এবং ইংরেজদের আগমনের প্রভাব, হিন্দু মুসলমানের সমস্যার কারণ ও সেই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথনির্দেশ, পাশ্চাত্য সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে লেখকের ভাবনা, প্রবীন ও নবীনের চিন্তাভাবনার সমন্বয় এবং এদেশের জনগণের মুক্তির পথনির্দেশনা সম্পর্কে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা।
বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের সাথে সংকলনের প্রথম প্রবন্ধটির নামও কালান্তর। পাঠ আরম্ভ করার সময় প্রথমেই চোখের ওপর ভেসে ওঠে পুরাতন ভারতবর্ষের ছবি। যেখানে চণ্ডীমন্ডপের ছায়ায় চলছে বাঙালির প্রিয় বিষয় আড্ডা, গল্প গুজব। ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় আর আছে জনগণের অবসর সময়ের বিনোদন তাস-পাশা। আছে যাত্রা সংকীর্তন, কথকথা, রামায়নপাঠ, পাঁচালী, কবিগান। দিবানিদ্রা আর অলস সময় নিয়ে আবর্তিত হয়ে চলেছে শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন। সে জীবনের আরেক দিক ছিল কঠিন সংস্কারের নিয়মে ঘেরা। নিয়ম আর অনিয়মের এমনি এক জীবন নিয়ে এদেশের মানুষের দিন কেটে যাচ্ছিল।
নিস্তরঙ্গ জনজীবনে প্রথম আঘাত আসলো বিদেশী আক্রমনের মাধ্যমে। ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম আঘাত আসলো তুর্কি আফগানদের দ্বারা। গজনীর সুলতান মাহমুদ একাধিকবার ভারতবর্ষের ওপর আক্রমন করেন। ১২০৬ থেকে ১৫২৬ সময়কালের মধ্যে তুর্কি আফগান আক্রমনকারীরা দিল্লির মসনদ দখল করে নেয়। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির পরাজয়ের পর মোগল সাম্রাজ্যের শুরু হয়। এভাবে এদেশে ক্রমান্বয়ে বিদেশীদের আগমন শুরু হয়। তুর্কি আফগানরা ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তারা যখন এদেশে এসে বাসা বাঁধলো তখন এদেশের মানুষের চিত্তে কোন সৃষ্টিবৈচিত্রের প্রবাহ সঞ্চালন করতে সক্ষম হয়নি। অর্থাৎ তাদের চিরাচরিত প্রথার সাথে এদেশের মানুষের সনাতন বিপরীতধর্মী আর এক প্রথার আদানপ্রদান ঘটলো না। এক প্রথা অন্য প্রথার বিপরীতে মুখ ফিরিয়ে রইলো। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ করে সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যদিও তখনকার ভদ্রসমাজে পার্সিভাষার প্রচলন ঘটেছিলো কিন্তু কাব্যের প্রকৃতিতে এই ভাষার স্বাক্ষর পড়েনি। যদিও বাংলা শব্দের মধ্যে অনেক পার্সি শব্দের অনুপ্রবেশ গটেছিলো।
ব্যবসা করার নমে এদেশে এসে একসময় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এ দেশ দখল করে নেয়। মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং দেশের শাসনভার খ্রীষ্টান ইংরেজদের হাতে চলে যায়। ইংরেজদের আগমন এদেশের জনগীবনকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করলেও লেখক ইংরেজদের আগমনের ইতিবাচক দিক লক্ষ্য করেছেন। ইংরেজের আগমনকে তিনি বিবেচনা করেছিলেন এক বৈচিত্র্যময় ঘটনা হিসেবে। তারা এদেশের জনগণের সাথে একটা মানসসংযোগ ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলো। সেখানে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির আদান প্রদানে এ দেশকে সমৃদ্ধ করেছিল। পক্ষান্তরে, মুসলিমদের আগমন দেশের সাহিত্যসংস্কৃতি অঙ্গনে কোন প্রভাব রাখেনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বাহির থেকে মুসলমান হিন্দুস্থানে এসে বাসা বেঁধেছে কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকে বাহিরের দিকে প্রসারিত করেনি। তারা ঘরে এসে ঘর দখল করে বসলো বন্ধ করে দিল বাহিরের দিকের দরজা।” রবীন্দ্রনাথ একথা বলতেই পারেন কারন ইউরোপ তাঁর গলায় পরিয়ে দিয়েছে নোবেলের মনিহার। নাইট উপাধিতে তিনি ভূষিত হয়েছেন, সেও ইংরেজদের অবাধ স্বীকৃতি। আর তাঁর চিত্রকলা ইউরোপের নানা আর্টমিউজিয়মে যে প্রভূত স্বীকৃতি লাভ করেছে সেও তো সমঝদার ইউরোপিয়দের কারনে। তবু কিছু পাঠকের মনে প্রশ্ন থেকে যায় যে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে মুসলমাদেরও একটা বড় অবদান আছে। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে ভারতবর্ষের সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা, কারিগরি তথা মানুষের জীবনযাত্রায় মুসলমানেরা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ঐতিহাসিক ও পন্ডিত কে এম পানিকর বলেছেন,”মুসলমানদের বদৌলতে হিন্দুদের মধ্যে স্রষ্টার উপাসনার ধারনা সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের সাম্যের ধারনা ও ভ্রাতৃত্বের চেতনা ছিল ভারতের সমাজ জীবনের মূল্যবান বস্তু। ফলে মধ্যযুগের ভারতীয় বর্ণপ্রথার সমাজ শৈথিল্য লাভ করে”।
প্রসঙ্গতঃ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। ” The impact of the invaders from the northwest and of Islam on India had been considerable. It had pointed out and shone up the abuses that had crept into Hindu society in the petrification of caste, untouchability, and exclusiveness carried to fantastic lengths. The idea of brotherhood of Islam and theoretical equality of its adherents made of a powerful appeal especially to those in the Hindu fold who were denied any semblance of equal treatment.”
এছাড়া মোগল আমলে সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলার যে অগ্রগতি ঘটেছিলো ইতিহাস তার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দেয়। আমি সে বিষয়ের অবতারনা করে পর্যালোচনাটিকে দীর্ঘায়িত করতে চাইনে।
পরবর্তী প্রবন্ধগুলোর দিকে যতই এগিয়ে গেছি ততই নতুন নতুন চিন্তাধারায় মন আপ্লুত হয়েছে।
পরবর্তী একটা প্রবন্ধ “বিবেচনা ও অবিবেচনা” নবীন ও প্রবীনের মানসিকতার সমন্বয়ের একটি রূপরেখা। যখন বিধাতার দেয়া কর্মশক্তিকে উপেক্ষা করা হয় তখন সমাজে স্থবিরতা নেমে আসে। কঠিন এক জড়তা আমাদের জীবনকে গ্রাস করে। আমরা খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে যাই, তাঁর প্রদত্ত পাখার প্রতি আমাদের আস্থা, আগ্রহ সব হারিয়ে ফেলি।
একদিন একটা ছোট্ট কুকুরছানার সামনে একটা পোকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। দেখে কুকুরছানাটা ভারী মজা পেয়েছে। কুকুর ছানার গতিবিধির দিকে তার ভারী আগ্রহ। সে তার পেছন পেছন চলেছে। কিন্তু পোকাটা যখন হঠাৎ করে ধড়ফড় করে তখন কুকুরছানা চমকে উঠে পিছনে সরে আসে।
প্রাণের প্রকৃতি হলো, নতুন নতুন অভিযানে নির্ভিকভাবে এগিয়ে চলা। প্রাণ দুঃসাহসী, বিপদ দেখেও নিরস্ত হতে চায় না। তবুও তার মধ্যে একটা প্রবীণসত্ত্বা আছে। সে বিপদের সম্ভাবনা দেখলে বলে ওঠে, কী দরকার এই অবাঞ্ছিত বিপদকে টেনে আনা। নবীন প্রাণ এবং প্রবীণ ভয় দুটোই জীবের মধ্যে কাজ করে।খাঁচার ভেতর পাখা ঝাপটানোটাই আমাদের বিধি, ধর্ম। তার বাইরে আমাদের জগৎ নেই, সেখানে আছে অনন্ত আকাশ ভরা নিষেধ। এমন একটি সমাজের অগ্রগতি কি সম্ভব?
নবীনেরা প্রবীণকে গদি থেকে উৎখাত করার মত সঙ্কীর্ণমনা নয়। শুধু যদি কখনো তাদের প্রাণের রাজ্যে একেশ্বর করার ষড়যন্ত্র হয় শুধু তখন তারা বিদ্রোহ করবে। নবীনরা ভাবনা এবং নির্ভাবনা দুটোকেই খাতির বা ব্যালেন্স করে চলবে। স্বাভাবিক ভাবে প্রাণের প্রবৃত্তি হল যে সে সবকিছুর না জানা বস্তুর প্রতি আগ্রহ। সব কিছুকেই পরীক্ষা করে দেখতে চায়। নতুন অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের আগ্রহ তাকে গতিশীল করে তোলে, সে নিরস্ত হতে চায় না। তবু তার মধ্যে একটা প্রবীণবোধও কাজ করে। যখন তার সামনে হঠাৎ কোন বাধা এসে পড়ে তখন তার দ্রুতগতিতে বাধা পড়ে।
প্রাণের প্রকৃতি হলো, নতুন নতুন অভিযানে নির্ভিকভাবে এগিয়ে চলা। প্রাণ দুঃসাহসী, বিপদ দেখেও নিরস্ত হতে চায় না। তবুও তার মধ্যে একটা প্রবীণসত্ত্বা আছে। সে বিপদের সম্ভাবনা দেখলে বলে ওঠে, কী দরকার এই অবাঞ্ছিত বিপদকে টেনে আনা। নবীন প্রাণ এবং প্রবীণ ভয় দুটোই জীবের মধ্যে কাজ করে।
প্রবীনের ভাবনা চিন্তার মধ্যে রয়েছে অবিবেচনাবোধ। কিন্তু যারা নবীন, তারুন্যের গরিমায় দীপ্ত তারা সনাতনের প্রাচীর ভেঙ্গে উদ্ধতবেগে অসাধ্যসাধন করতে পারে। তাদের দুঃসাহসের মধ্যে একটা প্রবল অবিবেচনা আছে। সেই অবিবেচনার উত্তেজনাতে তারা অসাধ্যসাধন করতে পারে। তাই বলে প্রবীণের বিবেচনার সংযমটাও দরকার। তবে অবিবেচনার বেগ বন্ধ করে বিবেচনাবোধের অধিকার না দেওয়াটা কখনোই কাম্য নয়। কবির ভাষায়, তুমি শক্তিও চালাইয়ো না, বুদ্ধিও চালাইওনা, কেবলমাত্র ঘানি চালাও, এ বিধান চলবে না।
কালের বিবর্তনে মুসলিম আগমনের পর বিশাল ভারতবর্ষে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি পাশাপাশি অবস্থান করেছে। এই দুই জাতির মধ্যে যদি এক সৌর্হাদের সেতু বন্ধন করা যায় তবে দেশ ও জাতির অগ্রগতির পথ সুসংহত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে এই চরম সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন। এবং কালান্তরের বিভিন্ন প্রবন্ধে তাঁর উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে লোকহিত, হিন্দু মুসলমান এবং হিন্দু মুসলমান শিরোনামে শ্রীযুক্ত কালিদাস নাগকে লিখিত একটি পত্রে তাঁর যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তা পড়ে অভিভূত হতে হয়।
বঙ্গভঙ্গের বিষয়টি অখন্ড বাংলাবাসীদের হৃদয়ে আঘাত করেছিল। বাংলার মুসলমান এ ব্যাপারে নির্বিকার ছিল। তার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারন তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।”
জাতি, ধর্মের ঊর্ধ্বে মানবতাকে তিনি সর্বান্তকরনে স্থান দিয়েছেন। বলেছেন, “যে দেশে প্রধানতঃ ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ।”
পাশ্চাত্য সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়েছে, লড়াইয়ের মূল, স্বদেশী সমাজ, প্রলয়ের সৃষ্টি, আরোগ্য, সভ্যতার সংকট প্রবন্ধসমূহে।
ইউরোপের জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা ও অগ্রগতি তাঁকে আকর্ষন করলেওতাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রতি তাঁর কঠোর অবস্থানের কথা তিনি দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেছেন। “য়ুরোপের বাহিরে যখন এই নীতির প্রচার হয় তখন য়ুরোপ ইহার কটুত্ব বুঝিতে পারে না। আজ তাহা নিজের গায়ে বাজিতেছে। কিন্তু জর্মন পণ্ডিত যে তত্ত্ব আজ প্রচার করিতেছে এবং যে তত্ত্ব আজ মদের মতো জর্মনিকে অন্যায় যুদ্ধে মাতাল করিয়া তুলিল, সে তত্ত্বের উৎপত্তি তো জর্মন পণ্ডিতের মগজের মধ্যে নহে, বর্তমান য়ুরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসের মধ্যে”।
যে সকল প্রবন্ধের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও রাজনীতির চিন্তাধারা প্রকাশ পেয়েছে তার মধ্যে আছে, শিক্ষার মিলন, ছোটো ও বড়ো, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, দেশনায়ক ইত্যাদি। সেখানে ভারতবাসীর মুক্তির পথের নির্দেশিকা আছে। শিক্ষাকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে বলেছেন, শিক্ষা সমস্যার সমাধান হলেই কেবল আধিপত্যবাদীদের সামলানো যাবে।
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এমন এক ভারতবর্ষ যেখানে সকল ভেদাভেদ ভুলে মানবধর্মের মিলনের জয়গান বেজে উঠবে।
“এসো হে আর্য এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান,
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রীষ্টান।
এসো ব্রাহ্মন শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মা’র অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা,
সবার পরশে পবিত্রকরা তীর্থ নীরে,
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”
কালান্তরের ফুটে উঠেছে তাঁর সেই মহামিলনের দিকনির্দেশনা। আজ এতদিন পরেও কবিগুরুর এই দৃষ্টিভঙ্গীতে আমরা অভিভূত হই। তাঁর সাহিত্য ও কবিজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ সংকলন “কালান্তর”।
Views: 144