মরণ বিলাস: মৃত্যুর মুখে জীবনের নৃত্য
খোবাইব হামদান
❝মানুষ তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটা খণ্ডাংশে থেকে যেতে বাধ্য হয়। আত্মা প্রসারিত হতে চায়, কিন্তু অতীত কর্ম তাকে বেবাক সৃষ্টি জগৎ থেকে একঘরে করে রাখে। এটাই হল মৃত্যুর পূর্বের আসল কষ্ট। মওলা বক্স আমার বিগত জীবনের কর্মরাশি আমার চারপাশে কারাগার রচনা করে আছে। মৃত্যুর সময়ে মানুষ এই কষ্টটাই ভোগ করে, কিন্তু ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। আমার অনন্যত্ব এইখানে যে আমি মৃত্যুর অধিক কষ্ট ভোগ করছি এবং আপন জবানে সেটা প্রকাশ করছি।❞
জীবমাত্রাই মৃত্যু অনিবার্য। কোরআনে আছে, “তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু তোমাদের স্পর্শ করবেই।”(সুরা নিসা : ৭৮) মৃত্যু, জন্ম ও জীবন নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। আরবি এক কবি বলেন, “জীবন কয়েকটি চোখের পলকের নাম।” জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যখানে কয়েকটি মুহূর্ত-ই জীবন। ছোট্ট জীবনে মানুষ বিভিন্ন কাজ করে, প্রত্যেক কাজ মানুষের মনে জমা হয় স্মৃতি হয়ে।
যখন বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়া শেষ হয় আমাদের বিদায়বেলায় তখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া থেকে কি কী করেছি সব মনের আয়নায় ভেসে উঠে স্মৃতির ঢেকুরে। তেমন জীবনের অন্তিমবেলায় পুরো জীবনের কার্যকলাপের কর্মনামা চোখের সামনে ভেসে উঠে। জীবনের কিছু মুহূর্ত বা কিছু কাজ স্মৃতির ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে থাকে সেটা নিজের ভালো কর্মও হতে পারে, খারাপ বা একেবারে নিষ্ঠুরতম কর্মও হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি হয়ে মৃত্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উপস্থিত হয় মনের আঙিনায়। জেরুজালেমের হাদাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় জানা যায়, “মৃত্যুর সময় চোখের সামনে ‘জীবনের একটি ঝলক দেখতে পায় মানুষ।”
আহমদ ছফা রচিত মরণ বিলাস’এ কথকের কথা,
❝বুঝলে হে মওলা বক্স, মৃত্যুর পূর্বে মানুষের বোধশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। বেবাক জীবনটা বায়োস্কোপের পর্দার মত চোখের সামনে ভাসতে থাকে। ডালপালা শেকড় মূলসমেত গোটা জীবন আমার চোখের সামনে ক্ষণিকে ভেসে উঠছে আবার ক্ষণিকে ডুবে যাচ্ছে।❞
আপন কৃতকর্মের ফল কাউকে সুখ এনে দেয় মনে কাউকে বিষন্নতায় ডুবিয়ে রাখে। মানুষের অন্তিম মুহূর্তে তাদের এক দিব্যদৃষ্টি জন্মায়, জীবনের কৃত ভালোমন্দ সব ধরনের কাজ সামনে হাজির হয়। প্রতিটি জিনিসকে অন্তর্গত পরিচয়ে চিনতে পারে। বিচারশক্তিতে পরীক্ষা করে বুঝতে পারে। দৃষ্টি নিয়ে জাগে প্রত্যেক স্নায়ু, বিগত জীবনের কৃতকর্মের হৈ-হুল্লোড় মিছিল ডুবে যায় সেই স্নায়ুবিক উত্তেজনায়। মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর চেয়েও অধিক কষ্ট দেয় এই চেতনা। কথকের কথায় দেখা যায়, ❝আমার অতীত জীবন আমাকে গ্রেফতার করে ফেলতে চাইছে। আমি ধরা পড়ে যাচ্ছি। পালাবার পথ পাচ্ছিনে।…..তুমি আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধর।❞ নিজের কৃতকর্মের ভার নিতে কত অক্ষম মানুষ।
মরণ বিলাস উপন্যাসে জীবনের অন্তিম মুহূর্তে কৃতকর্মের গল্প শুনাতে দেখা যায়। পুরো গল্পের প্লট একটি হাসপাতাল। হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত কথক নিজের জীবনের কথা বলে যাচ্ছেন এবং শ্রোতা শুনছেন।
মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তির মৃত্যু পূর্ব অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি নিয়ে লেখা গ্রন্থটি। সরকারের মৃত্যুপথযাত্রী মন্ত্রী তার সহকারী মাওলা বক্সের কথোপকথনে মৃত্যু পূর্ব অনুভূতির বয়ান ও তাতে পুরো জীবনের নৃত্য।
২.
❝সে নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিল।
মানুষের নিষ্ঠুরতার কাহিনী শোনার চাইতে
যন্ত্রণাদায়ক আর কিছু নেই।❞
উপন্যাসের মূল চরিত্র মন্ত্রী সাহেব মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে সহকারী মওলা বক্সকে বলে যাচ্ছেন জীবনের কৃতকর্মসমূহ। সাথে যুক্ত হচ্ছিল নিজের বর্তমান অনুভূতি ও মওলা বক্সের কথা। ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের সন্তান মন্ত্রী সাহেব নিজেকে “আলেমের ঘরে জালেম” বলে অভিহিত করেন। পিতার অবাধ্য সন্তান ছোটবেলায় সৎভাইকে সম্পত্তির ভাগ ও বংশীয় সম্মানের হেতু ধরে জারজ বলে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন। রেঙ্গুন প্রবাসী চাচাতো ভাইয়ের বউয়ের সাথে ছিল গোপন সংযোগ। “তারপর থেকে বাঁশঝাড়ে, পাটক্ষেতে, ঘোর সন্ধেয় নির্জন পুকুরের পাড়ে ভাবীর সঙ্গে আমার গোপন মিলন ঘটতে থাকল।” কিছুদিন পর অন্তঃসত্ত্বা নারী নিজের স্বামীর কাঁধে দায় চাপিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এর ভার সইতে না পেরে গ্রাম বদলায় সে। বুজুর্গ পিতার সন্তান বলে সম্মান পেয়ে পিতার এক মুরিদের ঘরে উঠেন ও স্কুলে ভর্তি হয়। স্কুলে অসৎ সঙ্গী পেয়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিভিন্ন অসৎকর্মে লিপ্ত হয়। হিন্দু শিক্ষকের মাথায় প্রস্রাব করেন এর অপরাধে হয় স্কুল থেকে বহিষ্কার। ওদের অসৎকর্মগুলো দাঁড়িয়ে যায় হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নে রাজনীতির পোশাকে। যা আমাদের চারপাশে আমরা এখনো দেখতে পাই।
চেরাগির মোড়ে এক হিন্দু দাদার সাথে আমার প্রায় দেখা হয়। আড্ডায় তিনি মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার কথা আসলেই বলেন, এরা একসময় কাঙাল ছিল এখন সব হিন্দুদের কাছ থেকে শিখেছে। উপন্যাসের কুলদাবাবু চরিত্রটি উনার মতোই, মুসলমানদের ভালো-খারাপ দুইটাতেই মাথাব্যথা। ❝কুলদাবাবু সুযোগ পেলেই মুসলমান জাতটাকে কষে নিন্দে করতেন। কোন মুসলমান লেখাপড়ায় খারাপ করলে বলতেন, ব্যাটা মুসলমান লাঙ্গল ঠেলা বাদ দিয়ে পড়াশোনার শখ কেন। আবার ভালো করলে বলেন ব্যাটা যবন নন্দন তোর বেশ লেখাপড়া হচ্ছে, নিশ্চয়ই পূর্ব জন্মে হিন্দু ছিলি।❞
উপমহাদেশের দ্বি-মেরুকৃত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দুর নাক সিটকানো এবং পশ্চাৎপদ মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের হীনমন্যতা কীভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসা, ঘৃণা ও পরিশেষে দাঙ্গার জন্ম দেয়। সৌহার্দ্যপূর্ণ দুটি গোষ্ঠীকে কিভাবে ঠেলে দেয় দাঙ্গা ফ্যাসাদের দিকে উপন্যাসে তার তাৎপর্যময় আলোচনার চাপ রেখেছেন ছফা।
মন্ত্রী সাহেব ও তার বন্ধু একসময় তাদের কুৎসিত কর্মের জন্য হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নে বাহ্বা পেতে থাকেন। বন্ধুর প্ররোচনায় মন্ত্রী নিজের পাপের কথা লুকাতে একসময় তারা হেডমাস্টারের বাড়িতে আগুন দেয়। আগুনে দগ্ধ হিন্দু হেডমাস্টার, তার সহকারী ও তার ঘরে থাকা মুসলমান ভালো ছাত্র। কৃত অপরাধের জন্য কোন অনুতাপ তার মধ্যে নেই। সে বলে, “মানুষ মানুষের কর্মের বিচারক হতে পারে না”
সহকারী মওলা বক্স যে এতদিন চাটুকারিতা ও তোষামোদ করতো মন্ত্রীর তারও ভাবান্তর ঘটে এই সব শুনে। “মওলা বক্সের শরীরে ঘাম এসে গিয়েছিল। একেকটা গল্প আত্মার ওপর নতুন বোঝা চাপিয়ে যায়।” মন্ত্রীর প্রতি তার ঘৃণা জন্মায়। মওলা বক্স অসহ্যবোধ করে। কথা দিয়েছিল, নয়তো এত নিষ্ঠুরতম গল্প কে শুনে?
❝মানুষ মানুষের কথা শুনতে পারে, ধৈর্য্য থাকলে পশুর কথাও শুনতে পারে তবে মনুষ্যসন্তান যখন পশুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন তাকে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে দাড়ায়।❞
৩.
❝আমার মানব জন্ম বৃথা যায়নি…
আমার আশা আছে মাওলা বক্স, আশা আছে!❞
সত্যসমৃদ্ধ স্পষ্টবাদী মননশীল ও সৃজনশীল লেখক আহমদ ছফা সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর। উনার লেখা উপন্যাসগুলোতে এক যোগসূত্র আছে। যখন কথক মন্ত্রী সাহেবের কথা শুনি তখন ওঙ্কারের কথকের কথা মনে পড়ে; তারা বলে যান বর্ণনা ভঙ্গি এক তবে গল্পে বিস্তর ফারাক। দুই বর্ণনায় দুই বিপরীত লোকের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার দেখা পাওয়া যায়। মানুষের মনের প্রক্রিয়া ও চিন্তাধারা তুলে আনেন যেমন সামাজিক অবস্থান সমানভাবে আনেন গল্পে ছফা।
মরণ বিলাস বইয়ে কিছু বর্ণনা দেখলাম যা ছফার কাছে আশা করি নি। উনি এখানে কিছু চরিত্র দাঁড় করালেন এক আদর্শে বা মতধারায় তার মধ্যে কর্মকাণ্ড ঢেলে দিলেন একেবারে বিপরীত মতাবলম্বীর। এ ছাড়া উপন্যাসটি আমার ‘ওঙ্কার‘ ও ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণে’র মতো ভালো লেগেছে। মরণ বিলাস একজন রাজনীতিকের রাজনীতিতে জড়ানো ও নষ্ট রাজনীতিক হয়ে উঠার গল্প। যিনি একাধারে পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে মন্ত্রীত্ব পান। উনার কাহিনীতে পাঠক বর্তমানের অনেক রাজনীতিকদের চেহারা দেখতে পাবেন।
মরণ বিলাসে একটি ভোর আসে। একটি রাত মন্ত্রীর কথা শুনে মওলা বক্স যখন ক্লান্ত ও সহ্যক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলে এরপরের ভোরটি মওলা’র জন্য অন্য ভোর থেকে আলাদা। বইটি পড়ে পাঠকের মনে একধরনের ঘোর লেগে থাকে; যা অন্য ঘোর থেকে আলাদা!
#পাঠপর্যালোচনা
১১ শ্রাবণ’২৯ | চাঁনখালী, চট্টগ্রাম
Views: 121