এই মায়ালোকে
________কোয়েল তালুকদার
সবিতা মালবী বাংলাদেশের যমুনা পাড়ের মেয়ে।
কিন্তু সে এখন এ পাড়ে নেই। যৌবন প্রস্ফুটিত সময়ে সে ভালবেসেছিল এক তরুণকে। তারই ঘরে সে উঠতে চেয়েছিল। কিন্তু কনকাঞ্জলীর সময় হলো ক্রান্তিকাল। হঠাৎ সানাইয়ের সুর থেমে যায়। অমাঙ্গলিক এক ঝড়ে অঞ্জলীর সব ফুল মাটিতে পড়ে যায়। হলো না তার আর ধান দূর্বার মঙ্গলচরণ পেরিয়ে কারোর ঘরে যাওয়া।
তারপর কত দিন হয়েছে গত। সবিতা এখন বিগত যৌবনা। অনেক মঠ, মন্দির,আশ্রম ঘুরে এখন সে ক্লান্ত। একদিন সূর্যক্লান্ত এক বিকেলে দেরাদুনের হিমালয়ের পাদদেশে মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে তার সাথে দেখা হয় এক পর্যটকের। সেও বাংলাদেশের এক যুবক। পার্বত্য সোপান পেরুতে পেরুতে কথা হয়েছিল সেই যুবকের সাথে। পার্বত্য শিখরে যে পাথর খণ্ডে বসে স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যান করত, সেই পাথরে বসে সবিতাকে যুবক বলেছিল — ‘তুমি কী আমার সাথে তোমার সেই যমুনার তীরে কুসুমপুর ফিরে যাবে ?’
রুক্ষ বসন্তের মায়াবতীর পার্বত্য গাত্রে সারি সারি পাইন গাছ থেকে শুকনো পাতা দুঃখের মর্মর বেদনার মতো ঝরে পড়ছিল তখন। অরণ্যের আলোছায়াময় পথগুলো নির্জন অন্ধকারের মতো আঁধারে ঢেকে আসছিল। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে নীলনীলনীল আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে যায়। এত পাখির কলরব যেখানে সারা মায়াবতীতে। আচমকা সব পাখির কলরব যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
শত বছর আগে স্বামী বিবেকানন্দের সেই ধ্যান মগ্নের ক্ষণ যেন মূর্তিমান হলো সেই পার্বত্য শিখরে। কোথাও কারও স্পর্শ নেই। কারও শরীরের ছায়া পড়ল না কারও উপরে। বিবেকানন্দের সেই পাষাণ খন্ডে বসে সবিতা সেই যুবককে বলেছিল —
”এই খেলাঘর, এই ধুলোমাটির বাইরে কি রসদ নিয়ে যাব, গিয়ে কী বলতে পারব, আমি কানায় কানায় পূর্ণ? সংসারের চার দেওয়াল কী আমাকে সেই বিস্ময় এনে দিতে পারবে, যা আমি মায়াবতীর এক নির্জনবাসী যোগীর আশ্রম প্রাঙ্গনে সন্ধ্যা নামার পূর্ব মুহুর্তে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম? সেই অনুভব কি আমায় সংসার দেবে? যে অনুভব আমায় দিয়েছিল উত্তরকাশীর ক্ষীনধারা গঙ্গার বয়ে চলার আওয়াজ?
আমি যোগিনী হয়েই ভালো আছি। চলার পথে কত নতুন মানুষ, কত নতুন গল্প, কত অভিজ্ঞতা, কত ভাটিয়ারী ভোর, কত বাগেশ্রীর সুরে মেশা সন্ধ্যা, কত মালকোষী রাত … একে ছেড়ে যাই কি করে? ঐ চার দেওয়ালের খাঁচায়? এখানে এরা কি কম বড় সঙ্গী?’
যমুনার পাড়ের সেই ছায়া সুশীতল কুসুমপুরকে তুমি আমাকে মনে করে দিও না। নয়নের সমস্ত জল সব শুকিয়ে গেছে। আর কোনও জল নেই যে, তোমাদের ঐ যমুনার জলে যেয়ে ফেলতে পারব।
এই বিশ্বলোকের সারসত্য কী আমি জানি না। তবে আমার জীবনের সত্বা আমি খুঁজে পেয়েছি এই মায়ালোকে, মায়াবতীর এই অদ্বৈত আশ্রমে। সংসার লোকে ফিরিবার অন্য কোনো পথ তাই আমার জানা নেই।”
Views: 9