কোথা সেই আগের মানুষ
_______✍মোঃ মশিউর রহমান ভূঁইয়া
ছোটো বেলায় আমাদের এলাকায় বেশ ক’জন গ্রাম্য ডাক্তারকে দেখেছি। কেউ কেউ উনাদেরকে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে কোয়াক ডাক্তার বলেও সম্বোধন করতেন। আমার কাছে এই সম্বোধনটা ভালো লাগতোনা। কোয়াক শব্দের অর্থটা সেই বয়সে না বুঝলেও কারো কারো সম্বোধনের মধ্যে যে একটা প্রচ্ছন্ন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতা লুকিয়ে ছিলো তা বেশ বুঝতে পারতাম। মধ্যযুগের কোয়াক শব্দের আভিধানিক অর্থ অনুযায়ী উনাদের সেই ডাক্তারি পেশাটা কিন্তু আমার কাছে ঠিক সেরকম মনে হয়না। উনাদের প্রায় প্রত্যেকরই বাড়ীতে কিংবা হাটে বাজারে ঔষধের দোকান ছিলো। যেটাকে আমরা ডিসপেন্সারি বলি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উনারা রোগীদের বাড়ীতে অন কল চিকিৎসায় যেতেন। কখনো কখনো দূর দুরান্তেও যেতে হতো। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো এদের মধ্যে বেশিরভাগেরই এই ডাক্তারি পেশাটা একমাত্র আয়ের উৎস ছিলোনা। এরা কেউ কেউ ছিলেন সম্পন্ন গৃহস্থ। কেউবা স্কুল শিক্ষক। মানব সেবার ব্রত নিয়ে এই পেশাটাকে উনারা ধরে রাখতেন। তবে উনাদেরকে কোয়াক কিংবা গ্রাম্য ডাক্তার যা ই বলা হোক না কেনো গ্রামের মানুষের কাছে উনারা ডাক্তার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সাধারণ মানুষ উনাদেরকে সম্মানের চোখেই দেখতেন।
মনে পড়ে আমাদের এলাকায় যতো জন গ্রাম্য চিকিৎসক ছিলেন এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন সনাতন ধর্মীয়। মাত্র অল্প ক’জন ছিলেন মুসলিম। সনাতন ধর্মীয়দের মধ্যে মনে পড়ে হরি কাকা নিমাই কাকা উপেন্দ্র কাকা আর অরুন কাকার কথা। মুসলিমদের মধ্যে ছিলেন হেদায়েত উল্লাহ দাদা সিদ্দিক কাকা আর ছিলেন জয়নাল আবেদিন কাকা। ইনারা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন এরা। ঘর গৃহস্থালির কার্যক্রমের পাশাপাশি উনারা রোগীদের ডাকে তাদের বাড়ীতে যেতেন। ডিসপেন্সারিতে বসতেন। সন্ধ্যার পর এলাকার গন্যমান্যদেরকে উনাদের ডিসপেনসারিতে বসে গল্পগুজবে মেতে উঠতেও দেখা যেতো। মনে আছে হরি কাকা নিমাই কাকারা ধুতি আর ফতুয়া পরে আমাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে হাতে একটা চামড়ার ছোটো সুটকেস জাতীয় বেগ নিয়ে রোগীর বাড়ীতে কলে যেতেন। আমাদেরকে দেখলে চলতে চলতেই এটাসেটা জিজ্ঞেস করতেন। মুসলিমরা লুঙ্গি আর শার্ট পাঞ্জাবি ইত্যাদি পরতেন। উনাদের দেয়া ঔষধের মধ্যে মনে আছে লাল মিক্সারটাই ছিলো প্রধান। আর ছিলো ইঞ্জেকশন। মিক্সারটা বোতলে পুরে তার বাইরে চুন কিংবা কাগজ কেটে দাগ দিয়ে দিতেন। বলে দিতেন কখন কোন দাগ খেতে হবে। মাঝেমধ্যে সাদা রঙের টেবলেট দিতেও দেখা যেতো। মজার ব্যপার ছিলো এখনকার মতো তখনকার দিনে চিকিৎসা ব্যবস্থা এতো উন্নত ছিলোনা। পরীক্ষা নিরীক্ষা ইত্যাদির বালাই ছিলোনা। তথাপি এই স্বল্পশিক্ষিত ডাক্তারগণ তাদের নিজস্ব মেধা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে রোগের চিকিৎসা করতেন এবং আশানুরূপ ফলও পেতেন।
এই মানুষগুলোর পেশাগত শিক্ষাদীক্ষা একেবারেই কম থাকলেও তখনকার সময়ে বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে উনারা ছিলেন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং জনপ্রিয়। এমবিবিএস ছিলো কল্পনারও অতীত। একজন এলএমএফ ডাক্তারও সে সময়ে একটা থানায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিলো। বিশেষ করে যে সময় কলেরা বসন্তের মতো মহামারিতে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতো তখন এই গ্রাম্য ডাক্তাররাই ছিলেন মানুষের চিকিৎসার একমাত্র অবলম্বন। আরো একটা বড়ো দায়িত্ব তারা পালন করতেন। সেটা ছিলো প্রসূতি সেবা। তাছাড়া জ্বর জারি ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা তো ছিলোই। এতো কিছুর পরও ইনারা ভিজিটের ব্যপারে খুব একটা সিরিয়াস ছিলেননা। যার যা সামর্থ ছিলো তাই দিলেই তারা সন্তুষ্ট থাকতেন। কখনো কখনো গরীব রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেও দেখা যেতো। এই মানুষগুলো তাদের পেশার প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে যদি কোনো রোগী গভীর নিশিথে কিংবা ঝড় ঝঞ্ঝার রাতেও তাদের সাহায্য চাইতেন উনারা বিনা বাক্যবয়ে ছুটে যেতে দ্বিধা করতেননা।
তখনকার দিনে এই পেশায় নিয়োজিত মানুষগুলো আয় রোজগারের পাশাপাশি এটাকে মানব সেবার ব্রত হিসেবে নিতেন। তাইতো এটার বানিজ্যকায়ন ছিলোনা। অর্থের প্রতি তাদের লোভ ছিলোনা। এখনো আমাদের এলাকায় এজাতীয় চিকিৎসকেরা আগের তুলনায় অধিক সংখ্যক হারে আছেন। আবার পেশাগত শিক্ষায় তাদের থেকেও অনেক উচ্চশিক্ষিতরাও আছেন কিন্তু তাদের মধ্যে সেবার চাইতে বানিজ্যিক চিন্তাটাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। তাইতো আফসোসের সুরে বলতে হয় “কোথা সেই আগের মানুষ!”
Views: 11