চৌধুরীবাড়ির বউ
________ফারজানা ইসলাম
ঊনিশ বছর বয়সে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম। আমি তখন বিকম পড়ছি। পাশাপাশি একটা নাচের স্কুলে বাচ্চাদের নাচ শেখাতাম। টিভিতে এক নাচের প্রোগ্রামে আমাকে দেখে, শাশুড়ি মা আমাকে খুব পছন্দ করেছিলেন। এরপর উনি খোঁজ-খবর নিয়ে ঠিক ঠিক আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। তিনি আমার বাবার কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। ওদিকে বাবা পড়ালেখা শেষ না করিয়ে কিছুতেই বিয়ে দেবেন না দেখে এককথায় নাকচ করে দিলেন; কিন্তু শাশুড়ি নাছোড়বান্দা। তিনি বাবাকে কথা দিলেন, আমায় লেখাপড়া করাবেন, নাচেরও কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। তিনি তাঁদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে ছেলের খোঁজ-খবর নিতে বললেন। খোঁজ নেওয়ার পরও যদি বাবা রাজি না হন, তাহলে তিনি আর বিরক্ত করবেন না।
বাবা ঠিকানা লেখা কাগজটা নিলেন ঠিকই; কিন্তু আমার শাশুড়ি যাওয়ার পরপরই কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে রুমে চলে গেলেন। পড়ে থাকা কাগজটা তুলে নিয়ে, মা আমার বড়ো মামার হাতে দিলেন ছেলের বাড়ির খোঁজ নেওয়ার জন্য। বড়ো মামা করিৎকর্মা মানুষ। তিনি যথাসময়ে ছেলের এবং বংশের খোঁজ নিয়ে এলেন। আমরা একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। সেই তুলনায় ছেলের বাড়ির অবস্থা অনেক ভালো। ঐরকম ধনী পরিবার কেন এমন সাধারণ ঘর থেকে মেয়ে নেওয়ার জন্য এত জোরাজুরি করবে! ব্যাপারটা কারও মাথায় ঢুকল না। বড়ো মামী বললেন, “এতে না বোঝার কী আছে? আমাদের মৌমিতার মতো এমন সুন্দরী আর গুণী মেয়ে কোথায় পাবে, বলো তো? জহুরির চোখ ঠিকই হীরা চেনে, বুঝেছ তোমরা?”
আমি ছোটোবেলা থেকেই শুনে বড়ো হয়েছি, আমি সুন্দরী। সবাই আমার সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলত। বলত বাপ-মা’র সঙ্গে মেয়ের চেহারা তো কিছুতেই মেলে না। কেউ বলত আমি কাশ্মীরি মেয়েদের মতো দেখত, তো কেউ বলত ইরানি মেয়ে। আমার ওসব নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কারণ চেহারার কারণে বাড়িতে আমি কখনও বাড়তি আদরযত্ন পাইনি। বরং আমার বড়ো ভাইয়া ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে, পরীক্ষার সময় বাড়তি যত্ন পেতো। তখন মা, ভাইয়ার পছন্দের খাবার তৈরি করে দিতেন। আমরা অন্য ভাইবোন সেটা পেতাম না। অন্যদিকে আমার চেহারার কারণে পাড়ার ছেলেরা বড্ড জ্বালাতন করত। বাড়িতে হুটহাট প্রেমের চিঠি আসতো। এসব নিয়ে মা আমাকে সন্দেহ করতেন। অথচ আমি কখনও এসব পাড়াতো প্রেমিকের দিকে ফিরেও তাকাইনি। আমি অবশ্য এক ভাইয়াকে পছন্দ করতাম। আমার বন্ধু নামিরার বড়ো ভাই, প্রশান্ত ভাইয়া। ভাইয়ার সঙ্গে একবার কথা বলার জন্য আমি কতবার নামিরাদের বাসায় গিয়েছি; কিন্তু ভাইয়া তার ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই থেকে মুখ তুলে কোনোদিন আমার দিকে তাকায়নি। আমি মুখ ফুটে মনের কথাটা বলতে পারিনি দেখে, ভাইয়াও বোঝেনি আমার চোখের ভাষা। এসব দেখে তাই আমার মনে হত, চেহারা সুন্দর হওয়াটা তেমন কোনও বিশেষ যোগ্যতা না। তাই চেহারা নিয়ে মাতামাতি না করে আমি পড়ালেখা আর নাচ নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকতাম। নাচে আমি দুইবার জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছি। নাচের ব্যাপারে যদিও বাড়ি থেকে তেমন একটা উৎসাহ পাই না; কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা, একদিন আমার নিজের একটা নাচের স্কুল হবে। যেখানে ছোটোদের আমি নিজে হাতে তৈরি করব।
************
কেমন করে যে কী হয়ে গেল, মা শেষ পর্যন্ত বাবাকে রাজি করিয়েই ফেললেন। এত বড়ো ঘর পরে যদি আর না পাওয়া যায়? আমি কয়েকদিন কান্নাকাটি করলাম, দুই রাত না খেয়ে থাকলাম। তবুও কোনও লাভ হল না। আমার খালা, মামীরা আমাকে বোঝালেন, “ভাগ্যগুনেই এমন পরিবার পাওয়া যায়। মৌমিতা তুই রাজরানীর কপাল নিয়ে জন্মেছিস। এমন কপাল পায়ে ঠেলতে নেই। তাছাড়া তাঁরা তোকে লেখাপড়া করতে দেবেন, নাচের ক্লাস করাতে পারবি। আশপাশে চাকরবাকর ঘুরতে থাকবে, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে গাড়ি। কোথাও যেতে আর কোনও কষ্টই করতে হবে না। আর কী চাই, বল?”
তাঁদের সবার ক্রমাগত প্রলোভনে, এবার আমিও লোভে পড়লাম। তাই তো, এমন আরামের জীবন কে না চায়? অবশেষে আমি বিয়েতে রাজি হলাম। আমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো, ফরহাদের বউ হয়ে, চৌধুরীবাড়িতে এলাম। শ্বশুরবাড়িতে যৌথ পরিবার। শ্বশুরেরা পাঁচ ভাই মিলে চারতলা বাড়িটায় থাকেন। সবসুদ্ধ আটাশজন সদস্য আর সাতজন কাজের লোক। এবাড়িতে আসার পরই বুঝলাম, এখানে কর্তায় ইচ্ছাতেই কর্ম সম্পাদিত হয়। গিন্নিদের দৌড় রান্নাঘর অবধি। মেয়েদের ইচ্ছের কোনও দাম নেই এখানে। হোক সে বাড়ির বউ অথবা মেয়ে।
আমাদের তিনতলায় তিনজন কাজের লোক ছিল; কিন্তু আমাকেও তাঁদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করতে হত। কে, কখন কী খাবে, কার কোন জিনিসটা প্রয়োজন, সবকিছুতেই আমাকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছিল। সকালের আর দুপুরের খাবার তিনতলাতেই রান্না হত। সকাল থেকে দুপুর গড়ানো অবধি সিরিয়াল দিয়ে খাওয়া চলছেই! আর সবার মুখে, “মৌমিতা এদিকে এসো, মৌমিতা ওটা লাগবে, ভাবী, দেখো তো কোন শাড়িটা পরব? মৌমিতা, সারা’র হোমওয়ার্কটা দেখিয়ে দাও না প্লিজ, মৌমিতা দাদুর হাতের নখগুলো তোমায় কেটে দিতে হবে, মৌমিতা, মৌমিতা, মৌমিতা……… উহ!”
শুরুতে আমার খুব ভালো লাগছিল। ভাবছিলাম, “আহা আমাকে কতো গুরুত্ব দিচ্ছে সবাই। আমার পছন্দের কতো দাম দিচ্ছে!” আমিও দৌড়ে দৌড়ে সবার ফরমায়েশ খাটতাম। সবাই আমায় আদরও করত অনেক। সারাদিন সকলের ফরমায়েশ খাটার পর, রাত এগারোটা বাজলেই দু’চোখ ছাপিয়ে ঘুম নেমে আসত; কিন্তু তখনও আমার ছুটির সময় হয়নি। বিছানায় স্বামীর পাওনা ষোলোআনা বুঝিয়ে দিতে হত নিয়মিত। কখনও আমার ইচ্ছে করছে কি না, সেটা ভাবার মতোন মানসিকতা বা সময়, কোনোটাই তাঁর ছিল না। নিজের সুখটুকু বুঝে নিয়ে, আমার আগেই তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। আমিই সকলের প্রয়োজন হয়ে উঠছিলাম। আমার প্রয়োজন বোঝার মতো কোনও মানুষ ঐ বাড়িতে ছিল না।
এতকিছুর পর লেখাপড়া করার মতো একদম সময় পাচ্ছিলাম না। বইখাতাগুলোয় ধুলো জমতে শুরু করেছে। দু’মাস পেরিয়ে গেছে ক্লাসে যাওয়া হয়নি। নাচের স্কুল থেকে আমাদের বাড়িতে ফোন এসেছিল দুইবার। মা বলে দিয়েছে, আমি সময় করে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব। ব্যাংকার স্বামীর কাছে কথাটা বলতেই, সে বলল, “পাগল নাকি! তুমি এখনও নাচানাচি করবে? ভুলে যেয়ো না, এটা চৌধুরীবাড়ি৷ এ বাড়ির মেয়েরা এসব নাচাকোঁদা করে না।”
আমার মনটা ভেঙে গেলে একেবারে। থাক, এবিষয়ে পরে একসময় তাঁর সঙ্গে কথা বলব। আপাতত লেখাপড়ার কথাটা তুললাম, “অনেক দিন হল আমি ক্লাসেও যাচ্ছি না। পড়ালেখার ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে।”
“বিয়ের পর আবার লেখাপড়া কিসের?”
“মা তো বলেছিলেন।”
“তুমি কী এবাড়ির নিয়মনীতি কিছুই জানো না? বিয়ের আগে তোমার বাবা-মা যা পড়ানোর, পড়িয়েছেন। এখন আর ওসব আশা করো না।”
“কিন্তু মা তো বলেছিলেন……
“তবে তুমি মা’র সঙ্গেই কথা বলো।”
পরদিন শাশুড়িকে কথাটা মনে করিয়ে দিতেই তিনি বললেন, “তোমার শ্বশুর পারমিশন দিলেন না, মা। আমি ভেবেছিলাম তাঁকে রাজি করাতে পারব; কিন্তু তিনি বললেন, এখন তোমার ঘরকন্না সামলানোর সময়। যথেষ্ট লেখাপড়া হয়েছে। এবার মন দিয়ে সংসার করো।”
ব্যস, তাঁর ঐ এক কথায় আমার সব স্বপ্ন মাটিচাপা পড়ে গেল। আমি মৌমিতা এত মানুষের ভিড়ে একপ্রকার হারিয়ে যেতে লাগলাম। রাগ আর ক্ষোভে মাঝেমধ্যে সবকিছু ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছে করত; কিন্তু পারতাম না। মাঝেমধ্যে পায়ের অদৃশ্য শেকলটা ছিঁড়ে ফেলতে মন চাইত। সেটাও পারতাম না। শেকল ছেঁড়ার মতো মানসিক শক্তি সবার থাকে না। আমার কেবলই দমবন্ধ হয়ে আসত। সংসারের রঙিন নেশা কেটে গিয়ে, দিনকে দিন সবকিছু বড্ড ক্লিশে মনে হতে লাগল। বাবার ওপর রাগ করে বহুদিন বাপের বাড়ি যাইনি আমি। বাবার কারণেই তো আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। বাবা রাজি হলেন বলেই তো, অবশ্য পুরো দোষ বাবাকে দিই কী করে? লোভে তো আমিও পড়েছিলাম। গাড়ি-বাড়ি, শাড়ি-গয়নার লোভ।
এরপর ছেলেমেয়ে হল। ছেলেমেয়ে বড়ো হতে হতে, এবাড়িতে আমার অধিকার যেন কিছুটা বাড়ল। আমার সাহসও বাড়ল খানিকটা। আগে যেমন কারও কথারই ঘুরে উত্তর দিতে পারতাম না, সকলের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাতাম, এখন পরিস্থিতি কিছুটা পালটে গেল। এতদিনে এসে আমি বুঝতে পেরেছি, আমি যতই নমনীয় হব, এরা আমাকে তত বেশি ভেঙেচুরে ফেলবে। শুধু আফসোস, এই বোধটা আসতে দশটা বছর পেরিয়ে গেল। নিজের কষ্ট, অভিমান সব ভুলে গিয়ে বাচ্চাদের মানুষ করায় মন দিলাম।
আমার মেয়ে পুষ্পিতা, ওর খুব গানের আর ছবি আঁকার শখ ছিল। স্বামী, শ্বশুরের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পুষ্পিতাকে দু’টোই শেখাতে শুরু করলাম। এসব নিয়ে সংসারে মাঝেমধ্যে অশান্তি হত। হোক অশান্তি। ‘চৌধুরী বাড়ির বউ’ এই গালভরা ডাক ছাড়া এমনিতেও আমি কী সুখ পেয়েছি এ সংসারে?
পুষ্পিতা আর অঙ্কুর, দু’জনেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। অঙ্কুর রাজশাহী মেডিক্যালে চান্স পেল। ফরহাদ ছেলেকে কিছুতেই ঢাকার বাইরে যেতে দেবে না। চোখের আড়াল হলে নাকি ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে। তাঁকে যখন কিছুতেই রাজি করাতে পারিনি, তখন কাউকে না জানিয়ে, ছেলেকে নিয়ে একাই রাজশাহীতে এসে মেডিক্যালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম।
****************
একসময় ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শেষ করল। ওদের বিয়ে হল। তারা দু’জন বিয়ে-থা করে প্রবাসে থিতু হয়েছে। ওরা দু’জনেই আমাকে খুব জোরাজুরি করে ওদের কাছে গিয়ে থাকতে; কিন্তু আমি যাই না। ভালো লাগে না। নিজের জায়গা, চেনা পরিবেশ এসব ছেড়ে নতুন কোথাও যাওয়ার মন নেই আমার। মানুষের জীবনটা তো অনেকটা গাছের মতো। যত সময় বাড়ে, শেকড় তত বেশি ছড়ায়। চারাগাছ তুলে নিয়ে সহজে অন্যত্র বসিয়ে দেওয়া যায়। গাছ সহজেই বাঁচে, বেড়ে ওঠে; কিন্তু বড়ো গাছ শেকড় উপড়ে তুলে নিয়ে অন্য কোথাও বসিয়ে দিলে, সহজে বাঁচে না। তেতাল্লিশ বছর এ সংসারে কাটিয়ে আমার জীবন কী কম শেকড় ছড়িয়েছে? অন্য কোথাও তাই এত সহজে মিশে যেতে পারব না আমি।
চৌধুরীবাড়ির লোকজন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল। কেউ পরপারে চলে গেছেন, কেউ বা নতুন ঠিকানায়। আমার স্বামী গত হয়েছেন তিন বছর হল। তিনি মারা যাওয়ার পর আমার খুব একটা কষ্ট হয়নি। বরং মনে হয়েছে, এবার বোধহয় নিজের মতো করে একটু নিঃশ্বাস নিতে পারব। নিজের মতো করে বাঁচার মতো কিছুটা সময় হয়ত পাব এবার। ফরহাদ মারা যাওয়ার কিছুদিন পর নীচতলায় একটা স্কুল চালু করেছি। নাম দিয়েছি “প্রিয়প্রাঙ্গণ।” ওখানে নাচ, গাান আর ছবি আঁকা শেখানো হয়। চারজন শিক্ষক আছে স্কুলে। শিক্ষার্থী আছে গোটা পঞ্চাশেক। ছুটির দিনের সকাল আর অন্য দিনে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি ওদের সঙ্গে আমার সময় কাটে। তখন, গত তেতাল্লিশ বছরের না পাওয়ার কষ্টগুলো আমি ভুলে যাই। এক জীবনে নিজের মনকে মেরে ফেলে আমি অন্যদের মনোরঞ্জন করেছি। আজ আমি নিজের আনন্দের জন্য বাঁচি। আত্মীয়স্বজন আর পড়ার লোকেরা পিছনে অনেক কথা বলেন। আমার নাকি বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে। বলুক। লোকের কথায় কী যায়-আসে? সামনে যে কয়টা দিন সঞ্চয়ের খাতায় জমা আছে, সেই দিনগুলোয় আমি শুধু নিজের জন্য বাঁচব।
Views: 22