ছায়াশত্রু
______✍সাইফুল আলম
-আম্মাজান আপনার নাম?
-আছিয়া!আছিয়া খাতুন!
-মাশাল্লাহ আল্লাহর এক অতি প্রিয় বান্দির নাম ছিল আছিয়া!আপনার কি জানা আছে?
-জি বাবা!তিনি ফেরাউনের বিবি ছিলেন!
-আলহামদুলিল্লাহ!আপনার সমস্যা কি আম্মা?
-বাবা,আমার স্বামী আমার কথা শুনে না।
-তিনি কি আরেক বিবাহ করেছেন?
-জি না জনাব।
-তিনি কার কথা শুনেন?
-সে সর্বদাই তার মা বোনের কথায় চলে!
আমারে কোন দামই দেয় না।
পীর সাহেব কেবলা সৈয়দ সাফায়েত উল্লাহ গভীর দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়েন।
তার দু’চোখ বোজা।মাগরিবের পর পর দরবারে তাশরিফ এনেছেন তিনি।
তার চারপাশে জান্নাতী খুশবু!
আতর আর আগরবাতির ঘ্রানে কেবলাজানের দরবার মৌ মৌ করছে।
শ্বেতশুভ্র শশ্রু মন্ডিত মুখ মন্ডল,চোখে সুরমা,মস্তকে সবুজ পাগড়ী,গৌর বর্ণের পীর সাহেব কেবলাজানকে অপুর্ব সুন্দর লাগছে আজ!
-আম্মা এতে আপনার উল্লেখযোগ্য কোন পেরেশানি হচ্ছে কি?
আছিয়া খাতুন চটজলদি এ কথার কোন জবাব দিতে পারলেন না।তিনি বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকলেন।
-চুপ করে থাকবেন না আম্মা।
-তেমন কোন পেরেশানি এখনো দেখা দেয় নাই বাবা!
তবে দেখা দিতে কতক্ষন?আমার সংসারে শাশুড়ী ননদের খবরদারি অসহ্য ঠেকে।
সারাক্ষন কেউ ঘাড়ের উপর খাড়ায়া থাকলে যেমন খারাপ লাগে তেমন লাগে বাবা।
-আমার কাছে আসার উদ্দেশ্য কি আম্মা?
-আপনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা-পীর,আপনি আমার একটা উত্তম ফায়সালার ব্যবস্থা করুন।
-নাউযুবিল্লাহ!এসব শেরেকী কথা বলবেন না আম্মাজান।আল্লাহ,একমাত্র আল্লাহই উত্তম ফায়সালাকারী।আমার মনে হয় আপনি ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন।
আমার কোন অলৌকিক ক্ষমতা নাই গো মা।
-বাবা!আপনার অনেক কারামতের কথা শুনছি!আপনে অসুস্থ কে সুস্থ্য করেন,
বাঁজা মেয়েলোক আপনার দোয়ায়…
পীরসাহেব কেবলা হাত উঁচু করে আছিয়া খাতুনকে থামিয়ে দিলেন।
-আপনি আবার শেরেকী কথা বলতেছেন আম্মা……।
-অনেক আশা করে আইছিলাম বাবা…।
-একটা উপকারি কথা বলি মাগো শোনেন।যে রোগের বাসা মনে সেই রোগের চিকিৎসা করে কোন জনে?
মা বোন যেমন আপনি ফেলে দিতে পারেন না আপনার স্বামীর কাছেও তেমনটি আশা করা ঠিক না।
নাকফুল হারাইছেন পুকুরে,যমুনা নদীতে খুঁজলে কি তারে পাওয়া যাবে মা?যাকে আপনার সমস্যা মনে হয় তার কাছেই সমাধানের দাওয়াই বিদ্যমান জানবেন।
স্বামীর মা বোনকে আপন ভাবলে ক্ষতি কি?তবে সতর্ক থাকাটাও জরুরী কোন কুমন্ত্রনা না দেয় আবার;শয়তান তো পিছে লেগেই আছে সারাক্ষন।আপনি তাদের ভাল বুদ্ধিগুলোই কেবল গ্রহন করবেন;মন্দগুলো নয়-অনেকটা মৌমাছি আর মাকড়সার মত।
একই ফুল থেকে কেউ মধু আহরন করে,
কেউ করে বিষ!আমি কি আপনাকে সহি বুঝ দিতে পেরেছি আম্মা?
আশাহত আছিয়া খাতুন একগাদা গরম নিঃশ্বাস ছাড়লেন সৈয়দ সাফায়েত উল্লাহর দরবার শরীফে।মনে মনে বিড়বিড় করে বললেন
-ভন্ড পীরে ভরে গেছে দেশটা!কত আশা নিয়ে এসেছিলাম।
সাফায়েত উল্লাহ কেবলাজান দুঃখিত হলেন।
-আমি ভন্ড না আম্মাজান!
মানব মন বড়ই বিচিত্র,সে আগে মিথ্যা এবং অসত্যকে গ্রহন করে!
আছিয়া খাতুন চমকে উঠলেন।
পীরসাহেব কেবলা তার মনের কথা জানলেন কি করে?সত্যিইতো তিনি তাকে ভন্ড বলেছেন।তার গা কাঁটা দিয়ে উঠল!
কেবলাজান হুজুর হাল্কা করে চোখ মেললেন,
– মা ভাই বোন বিহীন স্বামী তো কেবল এতিমখানাতেই পাওয়া যায় মা জননী।
আছিয়া খাতুন হন হন করে দরবার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন,তার এখন প্রচন্ড গা জ্বালা করছে!
দুই বছর পর………
কাক ডাকা ভোরে বংশালের অপ্রশস্ত গলি মুখে মুশকিল আসান ফকিরের বাসার দরজায় কড়া নাড়ছেন আছিয়া খাতুন!কিছুক্ষন পরপরই নাড়ছেন!
আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা আছিয়া খাতুনের কড়া নাড়া দেখেই বুঝা যায় কিছু একটা নিয়ে তিনি খুব পেরেশানিতে আছেন।
ভিতর থেকে মুশকিল আসান ফকিরের খুসখুস কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে,
-খুলতাছি!দরজা ভাইঙ্গা ফালাইব নাকি?
-ফকির বাবা আমার বড় বিপদ……!
আচমকাই ফকির সাহেবের দরজা খুলে গেল।একরাশ বিরক্তি নিয়ে মুশকিল আসান ফকির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
-বাবা!আমারে ভিতরে ঢুকতে দেন।
-কি বিষয়?
-ভিতরে ঢুকে বলি?
-না এইহানেই কও,আজাইরা প্যাঁচাল পাড়নের সময় আমার নাই।
-বাবা!আপনের তাবিজ আর মধু পড়ার কারামতির কথা অনেক শুনেছি।
-ভুল শুনছ!যত্তসব বোগাস!
-আমারে নিরাশ করবেন না বাবা।
-তোমার সমস্যাটা কি?
-একটু যদি ভিতরে যেতে পারতাম।
মুশকিল আসান ফকির অনিচ্ছা সত্ত্বেও আছিয়া বেগমকে ভিতরে ঢুকতে দিলেন।
সকাল বেলায়ই তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে।
তিনি মনে মনে বকবক করছেন-’বাইরে খাঁড়ায়া কইলেও যা,ভিতরে বইসা কইলেও তা!আমার বাইরে ভিতরে সাদা ফকফকা’!
-কি সমস্যা কইয়া ফালাও।
-বাবা!আমার স্বামী তার মা বোনের কথায় চলে;আমার কথা একদম শুনে না।
-সে কি তোমারে মাইর ধইর করে?আদর যত্ম কম করে?সংসারে মন নাই?
-না বাবা!মিথ্যা বলব না;সে সব কিছুই না।কিন্তু……
-বে সবুর মাইয়া!তরে বনের বাঘে না মনের বাঘে খাইব।আমি এই নাহান তাবিজ কবজ,পানি পড়া,মধু পড়া জানি না রে বেটি!
-বাবা……।
-তুই সহসাই বাটপারের পাল্লায় পইড়া ধরা খাবি-আমার মন কয়!তাবিজ কবজ আর মধু পড়া দিয়া কি মানুষরে বশ করন যায় রে পাগলি?
যদি সত্যি সত্যি তারে বশে আনতে চাস,
অর মায়েরে মা ভাবতে শিখ,বইনেরে বইন ভাবতে শিখ,স্বামীরে ভালবাসতে শিখ,বিশ্বাস করতে শিখ।মনে রাখবি পরের লেইগা গাড়া খুঁড়লে সেই গাড়ায় নিজেরই পড়ন লাগে।
তুই যেমন গোপনে গোপনে অরে বশ করার লেইগা কোসিস করতাছস ওই কি তর লেইগা এমন করতাছে?দোষ তো পুরাই তর দেখতাছি!
আছিয়া খাতুন ভিতরে ভিতরে রাগে গজগজ করছেন।তারপরও যথাসম্ভব মুখটা স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করেন।
-তাইলে আমার কোন উপায় নাই বাবা?
-বেশি কথা কম।আউট,দূর হ চউক্ষের সামনে থেইক্কা!
মুশকিল আসান ফকির আছিয়া খাতুনের মুখের উপর ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
পাঁচ বছর পর………।
গাইনোকোলজিস্ট ডাঃপ্রফেসর শায়লা বেগমের চেম্বারে একগাদা কাগজ পত্র নিয়ে আছিয়া খাতুন বসা।
ডাক্তার কিছু বলছেন না,চুপচাপ গভীর মনোযোগে আছিয়া খাতুনের রিপোর্টগুলো দেখছেন।
আছিয়া খাতুন ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠছেন।শায়লা বেগম মুখ তুলে তাকান।
-আপনার বিয়ে হয়েছে কত বছর?
-ম্যাম প্রায় বারো বছর!
-আপনার বয়স এখন আটত্রিশ?
-জি ম্যাম।
-আপনি উচ্চ শিক্ষিত,আপনার যে পিসিওএস আই মীন পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম ডিজিজ আছে সেটা আপনি জানতেন?
-জি ম্যাম জানতাম।
-তবে বাচ্চা নিতে দেরী করলেন যে?
পিসিওএস রোগীদের মোটামুটি তিরিশের মধ্যেই বাচ্চা নিয়ে নেয়া উচিত।
-একটা বিশেষ কারনে বাচ্চা নেই নি;
ইচ্ছে করেই নেই নি।
-কার ইচ্ছেয় নেন নি?স্বামী না……
-না ম্যাম,উনি অনেক চেষ্টা করেছেন;
আমিই নেই নি।
-লে হালুয়া!আপনার হাজবেন্ড কি উল্টাপাল্টা?
-না,তবে তার সমস্যা আছে…।
-ফিজিক্যাল?
-নট এট অল!
প্রফেসর শায়লা বেগমের হাল্কা রাগ উঠতেছে।মেয়েটা সব খুলে বলছে না কেন?
-আমার স্বামী পরের কথা শুনে বেশি।
তার মা বোনের কথায় চলে,আমাকে মোটেও পাত্তা দেয় না।তাই এতদিন বাচ্চা নেয়া হয়নি।দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি সে ভাল হয় নাকি-এদিকে মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গেছে।
ডাক্তার শায়লা প্রচন্ড বিরক্ত হলেন।এই সিজোফ্রেনিয়ার রোগীর কি ট্রিটমেন্ট দিবেন তিনি?
আছিয়া খাতুনকে একজন
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রেফার করে দিলেন তিনি।
মেয়েটির প্রচুর কাউন্সিলিং দরকার।
তার মনোরোগ না সারিয়ে তার হাতে বাচ্চা তুলে দেয়া হবে মারাত্মক অপরাধ!
বাচ্চারা মায়ের জিনও পায়।একটা মারাত্মক সিজোফ্রেনিয়ার রোগী আরেকটি মারাত্মক সিজোফ্রেনিয়ার বাহককে পৃথিবীতে আনুক তা তিনি চান না!
তিনি আছিয়া খাতুনের ভিজিট ফেরত দিলেন।এই ধরনের রোগীদের রেফার করা ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই।
এই গরীব দেশে শুধুমাত্র রেফার করে ভিজিট নেয়াটা তার কাছে অনৈতিক মনে হয়।
আজ দু’বছর যাবত আছিয়া খাতুন সাইকিয়াট্রিস্ট ফিরোজ কামালের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সিজোফ্রেনিয়ায় ব্যবহৃত ওষুধগুলো দ্রুত ওজন বৃদ্ধি করে!প্রায় একশ কেজি ওজন নিয়ে আছিয়া খাতুন এখন প্রায় সময়ই বারান্দায় বসে থাকেন।
ওজন বৃদ্ধি এবং ওষুধের প্রভাবে তার গতি শ্লথ হয়ে গেছে।তিনি সাংসারিক কোন কাজ অন্যের সাহায্য ছাড়া করতে পারেন না।শুধু একটি কাজ তিনি নিয়ম করে করেন।স্বামী অফিসে যাবার কালে গুনে গুনে চারটা প্রশ্ন করেন।
-কই যাও অফিসে?
-হুম!
-রাতে কি কথা হইল তোমার বোনের সাথে?
-লাইলীর সাথে কোন কথা হয় নাই।
-কবে আর সত্য কথা কইবা তুমি?
মা’র ঘরে অত রাতভর কি শলাপরামর্শ করলা?আমারে তালাক দিতে কয় তাই না?
-না তালাক দিতে কয় না।
-বাঁজা,হস্তীনি মেয়েলোক রেখেই বা কি করবা?
মকবুল সাহেব এমন বিশ্রী আর নিচু চিন্তা করতে পারেন না।তার অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে।আছিয়ার জন্য তার মন খারাপ হয়।তিনি গভীর দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে অফিসের পথে পা বাড়ান।
Views: 15