জিপিএ ফাইভ
________আবদুল্লাহ ইবনে আলী
রাস্তার পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলাম।তার পাশেই একটা কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো।মাইকে কেউ একজন বললো, যেসব শিক্ষার্থী জিপিএ ২.০০/৩.০০/৪.০০ পেয়ে পাশ করেছে তাদের আন্তরিক অভিনন্দন।আমরা আজ সেসব কৃতি শিক্ষার্থীদের গল্প শুনতে চাই।তাদের অভিনন্দন দিতে চাই।তাদের ফলাফলের জন্য শুভকামনা জানাতে চাই।
আমি এমন ভিন্নধর্মী আয়োজনের প্রতি হঠাৎ একটা আকর্ষন বোধ করলাম।আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের জায়গায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসবো।দেখতে চাই কি ঘটতে চলেছে।
ততক্ষণে একজন শিক্ষার্থীকে মঞ্চে আমন্ত্রন জানানো হলো কিছু বলার জন্যে।শিক্ষার্থীর নাম জয়নাল এবং সে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ২.৭৭ পেয়ে পাশ করেছে।স্বাভাবিক ভাবেই স্পিকারের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থাকলো।জীবনে খুব সম্ভবত এই প্রথম এমন কোনো সুযোগ সে পেয়েছে অনেকগুলো দর্শকের সামনে কিছু বলার জন্য।স্বভাবতই সে খুবই নার্ভাস এবং কিছু বলতে যেয়েও তার কথা বারবার আটকে যাচ্ছে।আমি সেই মুহুর্তে জয়নালের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলাম।হয়তো আমি সাহস করে সেখানে দাড়াতেই পারতাম না।জয়নাল পানি চাইলো।অনুষ্ঠান সঞ্চালক পানির বোতল নিয়ে জয়নালের দিকে এগিয়ে গেলেন।জয়নাল পানি পান করলো এবং সঞ্চালক জয়নালের পিঠ চাপড়ে দিয়ে কিছু একটা বললেন।সম্ভবত জয়নালকে সাহস জুগিয়েছিলেন।আমি দেখলাম জয়নালের দুচোখ অশ্রুতে টলমল করছে।সে পুনরায় স্পিকারের সামনে এসে দাড়ালো।সে বললো, আমি বড় হইলে বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ারটেকার হইতে চাই।আমি দেখছি আমার বস্তির পাশে বড় যে বিল্ডিংটা আছে সেই বাসার মালিক তার বাবা-মাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিছে।পরে শুনছি তারা বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা পাইছিলো কোন এক আত্মীয়ের তদারকিতে।কিছুদিন পর লোকটার বাবা বৃদ্ধাশ্রমেই নাকি মারা গেছে।অনেকটা বিনা যত্নে।আমার এইসব মানুষের কষ্ট ভালো লাগে না।তাই আমি বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ারটেকার হইতে চাই।আমার সেইসব মানুষের দোয়া যারা অসহায় এবং দুস্থ।আমাকে কথা বলার সুযোগ দিছেন তাই সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
জয়নাল যখন মঞ্চ থেকে নামছিলো আমি তালি দিয়ে শুরু করলাম।ততক্ষণে সবাই তালি দিতে শুরু করেছে।
পরবর্তী শিক্ষার্থীকে আমন্ত্রণ জানানো হল।ওর নাম আজমেরী।আজমেরী এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৫০ পয়েন্ট পেয়ে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেছে।আজমেরী মাইকের সামনে দাড়িয়ে সাবলীল ভাবে কথা বলা শুরু করলো।
আমি আজমেরী আপনাদের সবাইকে সালাম,আদাব জানাই।আজ এতগুলো মানুষ আমার কৃতিত্বকে সম্মান করছে দেখে খুবই ভালো লাগছে।আমি সারাটা জীবন বই পড়ে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।স্কুলের গতানুগতিক বিদ্যায় আমি কোনো আকর্ষন বোধ করতাম না।আমার বাবা কখনো আমাকে পড়াশোনার জন্য চাপ দিতেন না।আমার মা নেই।এসএসসি পরীক্ষার একমাস আগে আমার মা মারা যান।বাবা আমাকে আগলে রেখেছেন।আমি যখন বাবাকে বললাম আমি জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে পাশ করেছি তখন বাবা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কাঁদলেন।বিকেলবেলা আমার জন্য আমার সবচে প্রিয় মিষ্টিটা বাজার থেকে কিনে আনলেন।সাথে অনেকগুলো প্রিয় লেখকের বই।আমি বই পড়তে খুব ভালোবাসি।আমার ফুফাতো বোন মুনিয়া জিপিএ ফাইভ পায়নি বলে আমার ফুফা রেজাল্টের দিন তাকে খুব মারলেন।লজ্জায়,অপমানে মুনিয়া পরদিন আত্মহত্যা করেছিলো।সে ছিলো আমার খুব ভালো বন্ধু।ফুপির ধারণা আমার সাথে থেকেই মুনিয়া পরীক্ষায় খারাপ করেছে।তাই মুনিয়াকে বলেছে আমার সাথে যোগাযোগ না করতে।জিপিএ ফাইভের জন্য আমি আমার বন্ধুকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম।সে আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো,’তোর মা নেই তো কি হয়েছে আমি সারাক্ষণ তোর সাথে আছি।কিশোর, মুসা আর রবিন কিংবা হিমু-রুপার গল্প করেই তো আমরা এই ছোট্ট জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি।’ মুনিয়া তার কথা রাখেনি।আমাকে কতগুলো নিঃসঙ্গ বিকেল উপহার দিয়ে সে অন্ধকার কবরে চলে গিয়েছে।তাই আমি আমার জীবনে কখনো জিপিএ ফাইভ পেতে চাই না।আমি শুধুমাত্র আমার বাবার জন্য বেঁচে থাকতে চাই।আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।
আজমেরী মঞ্চ থেকে নামলো।তার কাছে এগিয়ে গেলেন মধ্য বয়সী একজন লোক।মুনিয়া সেই লোককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।আমি বুঝে নিলাম লোকটা মুনিয়ার বাবা।খেয়াল করলাম আমার চোখেও পানি।এবার আজমেরীর জন্য হাততালি দিতে পারি নি।বিনিময়ে দুফোঁটা অশ্রুই কেবল দিলাম।
চোখ মুছে সঞ্চালক সাহেব তার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করলেন।এবার তৃতীয় শিক্ষার্থীকে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হল কিছু বলার জন্য।
আসসালামুআলাইকুম সবাইকে।আমি নঈম।এবারের এসসসি পরীক্ষায় ৩.৭৫ পেয়ে পাশ করেছি।খুব সম্ভবত আমার পরিবার আমার রেজাল্টে খুশি নয়।আমি সেটা বুঝতে পেরেছি।কিন্তু আমি চেষ্টা করেও অনেককিছু বুঝতে পারিনা।কেনো জানি আমার মনে হয় আমি সবকিছু ভুলে যাচ্ছি।তবুও আমি চেষ্টা করে যাই।আমার বাবা চান আমি একদিন স্কুল শিক্ষক হবো।এই পেশাটা সম্মানজনক পেশা।আমি নিজেও চাই বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে।কিন্তু সবকিছু কেমন যেনো কঠিন বোঝার মত মনে হয়।সবসময় ভাবতে থাকি পড়াশোনার ব্যাপারটা যদি আরেকটু সহজ হতো।আমি খুব ভালো ফুটবল খেলি।ফরোয়ার্ডের পজিশনে খেলতে ভালো লাগে।সেখান থেকে বিপক্ষ দলের গোলকিপারকে পরাস্ত করে গোল করাটা পড়াশোনার চাইতে সহজ বলে মনে হয়।কিন্তু আমি জানি বাবা কখনো এই খেলাধুলার বিষয়টা মেনে নেবেন না।কখনো যদি সুযোগ পেতাম তবে বাবাকে বলতাম আমাকে যেনো একবার সুযোগ দেয়া হয় নিজের স্বপ্ন পূরণে।কিন্তু সবকিছু কেমন যেনো।
নঈম মঞ্চ থেকে নেমে গেলো।আমি নিজেও ভাবতে লাগলাম সবকিছু কেমন যেনো।আমাদের জন্য সহজ নয়।প্রায় পঞ্চাশজন শিক্ষার্থীকে পুরষ্কৃত করেছে কৃতপক্ষ।একটা সামাজিক সংগঠন যারা বিশ্বাস করে শিক্ষা ব্যাপারটা জিপিএ ফাইভের মুখাপেক্ষী হয়ে যাচ্ছে।শিক্ষার্থীদের ভেতরে জ্ঞান আহরণের চেয়ে জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাশ করাটা বেশি কৃতিত্বের।আমি সংগঠনের সবাইকে সাধুবাদ জানাই।ফেরার সময় নিজের বাহুতে থাকা কুচকুচে কালো দাগটার দিকে বেশ কয়েকবার তাকালাম।বছর ছয়েক আগে বাবা মেরে দাগ বসিয়ে দিয়েছিলেন।জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে পাশ করেছিলাম তার জন্য।আজ বাবা বেঁচে নেই।থাকলে হয়তো বাবাকে এখানে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখতে পারতাম।আর বলতাম জিপিএ ফাইভ না পেয়ে মার খেয়েছি তবে এতদিনে বুঝতে পেরেছি সৎ এবং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য জিপিএ ফাইভ মূখ্য বিষয় নয়!এই দেশের হাজার-লাখ অসৎ মানুষের ভীড়ে সৎভাবে বেঁচে থাকাটাই মূখ্য বিষয়।
Views: 14