ব্রাজিল বনাম আমরা
_______রেজওয়ান রাজু
মেসির কার্ভড ফ্রি কিক থেকে পাওয়া গোল আনন্দদায়ক
অথবা নেইমারের পায়ের গোড়ালিতে প্রাপ্ত চোট বেদনাদায়ক
কিংবা জিদানের পাওয়া লালকার্ড হতাশাদায়ক।
এমন আবেগ লালন করে আমরা সাধারণ মানুষের লেভেলেই আছি বা থাকতে চাই। অথচ এই আবেগকে একটু ভিন্নপথে পরিচালনা করলেই আমরা অসাধারণের লেভেলে উঠতে পারতাম।
ধরুণ মেসির কার্ভড শটের পিছনে কি ফিজিক্স কাজ করে, সেটা জানার জন্য আগ্রহী হলে আমাদের ব্রেইনের নিউরনগুলো যে প্যাটার্ন নিতো তা দিয়ে অনায়েসে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা এস্ট্রোফিজিক্স বুঝতে খুব সহজ হতো। আবার নেইমারের ব্যথা বোধকে উপলক্ষ করে যদি আমরা চিন্তাকে প্রসারিত করতাম, তাহলে একই নিয়মে হিউম্যান এনাটমি বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের উত্তরাধুনিক জটিল ইস্যুগুলো বুঝতে ব্রেইন সাপোর্ট পেতাম।
কিংবা মাতারাজ্জির মন্তব্যের প্রতিবাদে জিদানের প্রতিক্রিয়া এবং তার লালকার্ড প্রাপ্তিকে স্বাভাবিক ফুটবলের হিসেব মেনে বসে না থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শিক্ষা নিতাম, তাহলে সমাজ, জাতি বা দেশের ছোট ছোট বিচ্যুতি থেকে শুরু করে উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে অবদান রাখতে পারতাম। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের লেভেলে থাকতেই পছন্দ করি।
একটা কথা বলি, আমাদের সাধারণের লেভেলে থাকার প্রবনতা যতটা না আমাদের ইচ্ছা বা পছন্দের বিষয় তার চেয়ে বেশি এটা আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্কের মেকানিজম। আমাদের ব্রেইন আমাদের ততটাই সক্ষম রাখে যতটা রাখলে তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পাদন করতে সহজ হয়।
আসুন খেলা বা অন্যান্য উপাদান থেকে প্রাপ্ত আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগাই, আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করি। কোনভাবে যদি আপনার মস্তিষ্ক নতুন কিছু গ্রহনের উদ্দিপনায় সাড়া দেয়, তবে আপনি আর সাধারণের লেভেলে থাকবেন না, এটা গ্যারান্টিড।
কথায় আসি, গত পরশু খেলায় ব্রাজিল পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছে আর বিপরীতে আর্জেন্টিনা সেমিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। স্বাভাবিক কারনে ব্রাজিলের সমর্থকরা মর্মাহত ও হতাশ হয়েছে আবার আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা আনন্দ উপভোগের তুঙ্গে। এমন বিপরীত পরিস্থিতিতে দুটি ভিন্নধর্মী উপাদানের সহাবস্থান অনেক ঝুকিপূর্ণ, কিন্তু আমরা মানুষ বলেই এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকি, থাকতে হবে।
একটা বিষয় খেয়াল করেন, বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি খেলোয়াড়দের একেক রকম গল্প আছে, জীবন বদলে দেবার গল্প। আমি হলফ করে বলতে পারি এ আসরে বা এর আগে পরে কোন আসরে কোন খেলোয়াড় খুঁজে পাবেন না যারা বিলিয়নিয়ার বা বিত্তবান পরিবারের সন্তান। এরা আমাদের মতই পরিবার থেকে উঠে আসা। মেধা আর পরিশ্রম ছিল নিজেকে বিশ্ব আসরে তুলে ধরার হাতিয়ার।
তাই অনেক সময় চলমান খেলায় নিজেদের সমর্থিত দলের নিশ্চিত জয়ের পাশাপাশি পরাজিত দলের প্রতি একটা টান অনুভব করি। কারণ আমরা প্রত্যেকেই জীবনের কোন না কোন বাঁকে পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করে এসেছি। একারনে পরাজিত টিমের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই।
আরো খেয়াল করেন, আমাদের সমর্থিত কোন দলের প্র্যাক্টিস থেকে কোন পর্যায়েই আমাদের কোন অংশগ্রহণ নেই, অবদান নেই। শুধুমাত্র ভালোলাগার যায়গা থেকে প্রিয়দলের বিজয়ে আমরা আনন্দে আনন্দিত হই এবং সে বিজয়ের কৃতিত্ব নিজের ভেবে অন্যদের হেয় করি, তর্ক করি, বিবাদে জড়াই। তাহলে আপনার বা আমার অংশগ্রহণ আছে, অবদান আছে এমন কাজের সফলতার আনন্দ কতটা উপভোগ্য হতে পারে তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন।
আমরা যে চক্রে আছি তার প্রাত্যহিক মিথস্ক্রিয়ায় একে অপরের সাথে কোন না কোন ভাবে নির্ভরশীল। কেবলমাত্র খেলাধুলার দলবাজি করতে গিয়ে যে নেগেটিভিটির চর্চা করি তার প্রভাবে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো ঝুঁকিতে পড়ছে, সে বিষয়ে খেয়াল করছি না। আজকে ব্রাজিল বাদ পড়ে গেছে তা নিয়ে ব্রাজিল সাপোর্টারদের হেয় করে, ট্রল করে আসলে আমরা কি অর্জন করছি, দ্বন্দ্ব ছাড়া কিছুই না।
শেষকথা, আর সপ্তাহখানেকের মধ্যে বিশ্বকাপ শেষ হবে, কিন্তু এর মাধ্যমে যে বিষবাষ্প আমরা ছড়িয়ে দিলাম বা আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-দেয়াল তুললাম, তাকে কি সহজে ভাংতে পারবো? যদি পারি তাহলে এ আয়োজনে সমর্থক হিসেবে আমাদের অংশগ্রহণ সফল। আর যদি না পারি , তাহলে আমরা সমর্থক হিসেবেও ব্যর্থ এটাই সত্য।
Views: 6