স্মৃতির জলে ডুবসাঁতার
_______রায়হান ই জান্নাত
খেলা খেলা ছেলেবেলা হিলারী সবে এভারেস্টের চূঁড়ায় হাতের পতাকাটা পুততে যাবে,এমন সময় তেনজিং পা পিছলে পড়ে গেল, কোমরে বাঁধা রশির টানে হিলারীও গড়িয়ে পড়ল নীচে দাঁড়ানো শেরপাদের উপর। ব্যথা পেয়ে চিল চিৎকার জুড়ে দিল শেরপারূপী নিভা,অন্যান্য শেরপা লিজা শেলী,ওরাও হৈ চৈ শুরু করলো।শোরগোল শুনে আম্মা রান্নাঘর থেকে খুন্তিহাতে বেরিয়েই হিলারীরূপী আমার পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন, “হতচ্ছাড়ি মেয়ে,স্কুল থেকে এসে খাওয়া গোসলের নাম নাই,জামাকাপড়ে কাদা, একী অবস্থা!” চালাক তেঞ্জিং ছোট ভাই ততক্ষনে দড়ির বাঁধন খুলে নিরাপদ দূরত্বে।
বাগান লাগোয়া পশ্চিমের ভীটায় নূতন ঘর উঠবে, উঠানে তাই পাহাড়ের মত মাটির স্তূপ। ছোট ভাইবোনদের নিয়ে সদ্য ক্লাশে পড়া “এভারেস্ট বিজয়” এর মহড়া দিচ্ছিলাম, এর মাঝে একী বিপত্তি!
মার খেয়ে মুখ গোঁজ করে গোসলখানার দিকে যেতে যেতে মনে মনে এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা করলাম,”আজ কিছুতেই ভাত খাব না,এমনকি আব্বা অফিস থেকে এসে সাধাসাধি করলেও না।” ভালকরেই জানতাম, ছেলেমেয়েদের,বিশেষ করে আমার গায়ে হাত তুললে আব্বা ভীষণ মনক্ষুন্ন হন।
গোসলখানা থেকে বের হতেই শোরগোল শুনতে পেলাম,”টীকাওয়ালী এসেছে।” তখনকার সময়টা ১৯৬৯-৭০ হবে,সিটি কর্পোরেশনকে মিউনিসিপ্যালিটি বলা হত।সেখানকার নিযুক্ত ভ্যাক্সিনেটর আসত টীকা দিতে, স্মল পক্স,যক্ষা, কলেরা কত কি–ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক,পেঁকে ফুলে স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন হয়ে যেত। আমাদের এখানে আসতেন এক মহিলা,পরনে নীলপাড় সাদাশাড়ী,হাতে হাল্কাগোলাপী প্লাস্টিকের ঝুড়িতে টীকার সরঞ্জাম,তাকে দেখলে আমরা সবাই ভুত দেখার মত আঁৎকে উঠতাম।
গোছলখানার দরজা খুলে যেই দেখলাম তিনি তার প্লাস্টকের ঝুড়ি পাশে রেখে বারান্দার চেয়ারে বসে আছেন,আমি আর উঠানে ঢুকলাম না,মাথা মোছার সময় নেই,টুপটুপ পানি ঝরছে,কোনমতে জামাটা গায়দিয়ে একদৌড়ে রান্নাঘরের পিছন দিয়ে কাকী আম্মাদের বড়ই গাছের নীচ দিয়ে রাস্তায়।আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম খোলামাঠে যেখানে মিস্ত্রীরা টীনের ঘর তৈরী করছে। সব ভুলে বসে দেখতে লাগলাম তাদের কাজ, কি সুন্দর কাঠ রানদা করে মসৃণ করছে এর চিলতে কাঠ ছিটকে জমা হচ্ছে।এরমাঝে তারা কাজ থামিয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসল, দুপুরের খাবার,মোটা লাল আটার রুটি আর ডেলা পাকানো আখের গুড়, বসে আছি দেখে আমাকেও সাধল,কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিলাম,ক্ষুধার মুখে মন্দ লাগল না।
ততক্ষনে আমার খোঁজে বাড়িতে তুলকালাম,দিকে দিকে লোক ছুটেছে বেশীদূর নয়, বাড়ীর কাছেই মাঠে পেয়ে গেল আমাকে।বাড়ীর পথে যেতেই মনে পড়ল,আমার আজ রাগ করে না খেয়ে থাকার কথা(মিস্ত্রীদের রুটি বাড়তি সাহস দিচ্ছিল)সেদিন বাড়ির সকলকে বেশ নাকানিচুবানী খাইয়েই অন্নগ্রহণ করেছিলাম বটে।
বহু বছর পর আমি যখন ডাক্তার হয়ে বাসাবোতে প্র্যাক্টিস করি, সেই টীকাওয়ালী এসেছিলেন আমার চেম্বারে রোগী হয়ে, সাথে তার ছেলে ও বৌমা।এই নিরীহ মানুষটিকে কত ভয় পেতাম ভেবে আর হাসি আটকাতে পারছিলাম না।তাঁকে সেকথা বলতে তিনিও হাসতে লাগলেন।এতদিন পর আমাকে তাঁর চেনার কথা নয়,আমি তো দেখেই চিনেছি।এরপর যতবার এসেছেন,তাঁর সাথে ফিরে এসেছে আমার একটুকরো ছেলেবেলা।
৭০দশকের গোড়ার দিকে কদমতলায় দূরে দূরে হাতেগোণা কয়েকটি বাড়ি, চারদিকের খালি প্লটে চুটিয়ে খেলা চলতো সারাদিন। মাঠভর্তি ঝোঁপঝাড়ে মনমাতানো জংলী ফুলের বাহার আর বড় বড় রংগীন প্রজাপতির উড়াউড়ি।ফুলের নাম নিজেরাই দিতাম,একটা ফুলের নাম দিলাম,”পরীর চেয়ে সুন্দরী”পরে জেনেছি ওটা ল্যান্টানা।তেমনি বাগান বিলাস-“কাগজ ফুল।” ঘাসফুল বলতাম যাকে,এখন জানলাম,তিনি পর্তুলাক।গেটের উপর লতিয়ে উঠা গেইটফুল আসলে কুঞ্জলতা,এমন কত কি!
মিছিমিছি ইটবালু আর ফুলপাতা দিয়ে রান্নাবাড়া ছেড়ে ইতিমধ্যে আমরা একটু বড় আপুদের প্ররোচনায় সাহসী হয়ে উঠেছি,ফলে মার চোখ লুকিয়ে সত্যিকার রান্নাবাড়া চলতে লাগলো বাগানে,বড়রা যখন দিবানিদ্রায়।
আর সবচে’ প্রিয় ছিল পুতুল খেলা। কাপড় দিয়ে বানানো পুতুল, কালো সূতার চুল।সেলাই করা চোখমুখ। পুতুল বানানোতে আমরা বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলাম।সুন্দর পুতুলগুলোকে অন্যের কাছে দিতে মন চাইতো না,তাই ঘরজামাই করে রাখতাম।বুদ্ধিটা কে দিয়েছিল আজ আর মনে নেই। তখন তো এসব বার্বীডল হাউস আমাদের কল্পনাতেও ছিল না, জুতার বাক্স ব্লেড দিয়ে কেটে দরজা জানালাওয়ালা ঘর, সিগারেটের খালি প্যাকেট আর ম্যাচবাক্স দিয়ে খাটপালং সোফাসেট, ছোটবাক্স দিয়ে বানানো গাড়ি এসবই ছিল অমূল্যধন। স্কুল থেকে ফেরার পথে সোনামিয়া দর্জির দোকান থেকে পুতুলের জন্য হাতভর্তি রংগীন কাপড়ের টুকরা নিয়ে খুশিমনে বাড়ী ফিরতাম।
স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার পর আমরা ও পাশের বাড়ির কাকী আম্মারা রেজাল্টের আগপর্যন্ত লম্বা সময় গ্রামে যেতাম।যেবার মামা খালারা ঢাকায় আসতেন,সেবার যেতাম না।একমাত্র কাকা তখনো বিয়ে করেন নি,আমাদের সাথেই থাকতেন।একমাত্র ফুপুও আসতেন,কিন্তু গ্রামের বিশাল সংসার ছেড়ে বেশীদিন থাকতে পারতেন না।ফুপু নিয়ে আসতেন নানান পিঠাপুলি,কি তার বাহারী নক্সা,খাওয় ছেড়ে শুধু চেয়েদেখতে মন চায়।
আম্মারা তিনবোন, আম্মা মেজ।একবার দুই মামা, দুই খালাম্মা সপরিবার ঢাকায় আমাদের বাড়ী এলেন,আমাদের খুশীর সীমা নেই।অনেক রাতপর্যন্ত হৈচৈ করেছি,তাই বেশ বেলা করে ঘুম ভাংল সবার।ঘুম থেকে উঠে কেউ কোন সেন্ডেল খুঁজে পাচ্ছেনা
,ব্যাপার কি!অবশেষে দেখাগেল সারি সারি সেন্ডেল পাশের ডোবায় ভাসমান।জিজ্ঞাসাবাদে জানাগেল আমাদের করিৎকর্মা মামাতভাই তুহীন আর খালাতভাই নোবেল সবার আগে ঘুম থেকে উঠে কোন কাজ না পেয়ে নৌকা নৌকা খেলেছে।
আরেক বিকেলে শীতের রোদে বাড়ির পাশের মাঠে আমরা সবাই ছুটাছুটি করছি,ছোটখালাম্মা মুগ্ধ হয়ে বললেন,”বুবু,আমাদের ছেলেমেয়ে দিয়েই ত মাঠটা ভরে গেছে।”মৃদুভাষী বড়খালাম্মা বললেন,”মাশাল্লা বল,মুখ লাগবে” পাশ দিয়ে কাকা যাচ্ছিলেন, উঁকি দিয়ে দেখে বললেন,”এতগুলিরে মুখ লাগাইতে গেলে মানুষের মুখ বেঁকা হইয়া যাইব।”শুনে সবাই হেসেই অস্থির।
এখন রাস্তাঘাট কত উন্নত,গ্রামের বাড়ি গাড়িতেগিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসা যায়, তখন সারাদিন লেগে যেত।ভোরে ঘুম চোখে ট্রেনে ওঠা,”গ্রীণএরো”নাম ছিল ট্রেনটার,সেকি উত্তেজনা,খাবার পেটে ঢুকত না।ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে যেতাম,ভৈরবের পুলে ট্রেন এলেই ঘটঘট শব্দে জেগে উঠে বিস্ময়ে চেয়েদেখতাম কুয়াশাঢাকা নদী,অস্পষ্ট ছবির মত নৌকা,মানুষজন। বাড়িগেলে আমাদের পুতুলের সংসারও সাথে যেত।একদিন আপু(আমাদের দাদী) তার বিয়ের ট্রাংকটি বের করে দিলেন।দুইস্তর বিশিষ্ট ট্রাংকটির নীচের ভাগ শাড়িকাপড় রাখার আর উপরের নানা খোপবিশিষ্ট স্তর হয়ত সেকালের ফ্যাশন অনুযায়ী গহনা ও প্রসাধনীর জন্য। পুতুলের জন্য এই চমৎকার দোতলা বাড়ি পেয়ে নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
পুতুল খেলা নিয়ে মজার কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে, গ্রামে গিয়ে দেখি ওরা পুতুলের বিয়েতে নানা উপহারসহ বউকে সত্যিসত্যি বরের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তাই দেখে আমার ছোট ভাই ন্যাকড়া দিয়ে বিশ্রী এক পুতুল বানিয়ে একের পর এক বিয়ে করাতে লাগল আর লম্বা এক মোজার মধ্যে উপহার সামগ্রী জমাতে লাগল।জামাইয়ের ঘরবাড়ি নেই,পরিত্যক্ত মোজায় বসবাস,চেহারাও বদখত,তবু পাত্রীর অভাব নেই,একটা বিয়ে করে আগেরটাকে কাজের বেটী বানিয়ে ফেলে।এখানে বলে নেই,এখন যেমন মায়ের পেটে থাকতে ই জেন্ডারভেদ শুরু হয়,ছোট বাচ্চাটাও বোঝে,পিংক মেয়েদের, ব্লু ছেলেদের, তখন এমনটি ছিলনা, আমরা ছেলেমেয়ে সবাই মিলে পুতুল,রান্নাবাটি, ফুটবল, গোল্লাছুট সবই খেলতাম।
একদিন আমার চাচাত বোন এলো তার বিবাহিত মেয়ে পুতুলের খোঁজখবর নিতে,মেয়ের কাজের বেটি স্ট্যাটাস দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বেয়াইর চুলের মুঠি ধরে ঝুলে পড়ল।বহুকষ্টে দুই বেয়াই বেয়ানকে ছাড়ানো হল।মেয়েকে যে নিয়ে যাবে,সে ত বলাই বাহুল্য।
খেলা যতই করি, আব্বা আম্মা দুজনেই পড়াশুনার ব্যপারে খুব সিরিয়াস ছিলেন, সূর্যডোবার পর কেউ পড়ার টেবিলছাড়া অন্যকোথাও থাকবে না। তখন আমাদের বদ্ধমূল ধারণাছিল যারা লেখাপড়া করে না,বাবামা তাদের আদর করে না। ভাইবোনেরা সবাই তুখোর মেধাবী ছিল বলেই হয়তো এ ধারণার ব্যত্যয় ঘটে নি। আমার এক সহপাঠি আমাকে খুব পছন্দ করত,মেয়েটি পিছনের বেঞ্চে চুপচাপ থাকত,ঠিকমত পড়া করত না রোল নং ও পিছনের দিকে ছিল।স্কুল ছুটির পর প্রায়ই আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে খেলতে চাইত,স্কুলের কাছেই বাসা কিন্তু আমাদের স্কুল থেকে কোথাও না বলে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। আম্মাকে জিজ্ঞেস করে জানাবো বললাম এবং একদিন গেলাম। বাড়ী দেখস আমি তো থ, আমার ধারণা ছিল খারাপ ছাত্র ছাত্রিদের বাড়ি হয় ভাংগাচোরা,তাদের পুতুলগুলো ছেঁড়াখোঁড়া, কিন্তু ওদের সুন্দর গেটওয়ালা দালানবাড়ি,গেটের উপর টুকটুকে লাল ঝুমকোজবা লতিয়ে উঠেছে।চমকের উপর চমক ওর মা কেমন মিষ্টিসুরে আদর করে মেয়েকে ও তার বন্ধুকে খেতে দিলেন,আর ওর পুতুলগুলো! আমাদের বয়সী মেয়েদের স্বপ্নের মত।আব্বা তো বিদেশ থেকে বড়বড় ডল আনেন,যেগুলোকে আমরা বাচ্চা বানিয়ে ঘরকন্না খেলি।এগুলো কোন দেশে পাওয়া যায়? আমাদের কাপড়ের পুতুলের জামাকাপড় গায়ে হবে,এমন সাইজের প্লাস্টিকের পুতুল,সত্যিকারের সোনালিচুল মাথাভরা,হাত পা নাড়াতেপারে। “লেখাপড়া করে যে, গাড়ীঘোড়া চড়ে সে।” আমার আজন্মলালিত বিশ্বাস এক ধাক্কায় চূর্ণ হয়ে গেল! তখন কি আর জানতাম, এই সবে শুরু।
স্মৃতিময় বাড়ী আর মায়াময় প্রতিবেশীরাঃ-
আমাদের কদমতলার বাড়িটি ছিল বেশ সুন্দর – অনেকটা মফস্বলের ডাকবাংলোগুলোর মত। যে আসত সেই মুগ্ধ হয়ে বলে উঠত, “ঢাকা শহরে এমন বাড়ি ভাবা যায় না।”
বিরাট উঠানের চারপাশ ঘিরে ঘর, সাদাদেয়াল ,টীনশেড। ভিতর বাইরে নানারকম ফুল ফলের গাছ। বাইরের ঘরের দেয়ালের পাশে টাইগার লিলির ঝাড়, মোটা ডাটায় একসাথে অনেক ফুল ফুটত বছর ভরে, ছাদ সমান উঁচু গন্ধরাজ গাছ, বারমাস ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকত। তখন মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ী সকালে রাস্তায় পানি ছিটাত, আর সুইপাররা ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করত রাস্তা। একদিন সকালে ঘুম ভাংলো ছোটভাই সোহেলের চেঁচামেচিতে, বাংলা উর্দু মিশিয়ে কাকে যেন বকাবকি করছে, ,”যেই না প্যাচা কি মাফিক চেহারা হ্যায়, আবার মাথামে ফুল লাগায়া কিউ?” চেয়ে দেখি গন্ধরাজ গাছ খালি, সব ফুল একদল সুইপার মহিলার মাথায় । বকা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
তখন সমস্ত পাড়া মিলে একটা বাড়ীর মত ছিল। হয়ত এলোচুলে এক্কাদোক্কা খেলছি, প্রতিবেশী কেউ ধরে বলত, এত সুন্দর চুলের যত্ন করিস না কেন? ,ধরে চপচপে তেল দিয়ে এত টাইট বেণী করে দিলেন, যে চুলের গোড়া ব্যথা করত। আমার ভাল লাগত না কিন্ত তখনকার দিনে যত্ন বলতে তারা এটাই বুঝতেন। পাড়া প্রতিবেশী বড় আপারা তাদের স্কুলে কোন অনুষ্ঠান থাকলে আম্মাকে বলে আমাকে পুতুলের মত সাজিয়ে সাথে নিয়ে যাবেন ই। সুলতানা আপারা ছিলেন কদমতলার সবচে’ “পশ” বাড়ীটার বাসিন্দা। অমন রংগীণ মাছের একুরিয়াম, হরিণের চামড়া বিছানো ড্রইংরূম, শুধু বাংলা সিনেমায় দেখতাম। তাদের বাড়ীর কুকুর আর বিড়ালের হ্যান্ডশেক দেখেও মুগ্ধ হতাম। সেই সুলতানা আপা স্কুল থেকে ফেরার পথে আমাকে বগলদাবা করে আনতেন। ভাত খেতে খেতে আমাকে তার পছন্দের কোন গান গাইতে বলতেন, আর আমিও তোতাপাখীর মত গাইতাম। খাওয়া শেষ করে সুরটা হারমোনিয়ামে তুলে নিতেন। তখন টু কি থ্রি তে পড়ি, রেডিও ছাড়া আর কোন সহজলভ্য উপায় ছিল না গান শোনার। স্কুলের স্যাররাও মাঝে মাঝে কমনরূমে ডেকে নিয়ে আমাদের গান শুনতেন।
আব্বা হারমোনিয়াম কিনে আনলেন, গানের টীচার ও ঠিক করলেন, দেখেই ত আমার মেজাজ গরম। গান হল আনন্দের ব্যাপার, তারজন্য ঘড়ি ধরে টীচারের কাছে ভ্যা ভ্যা করতে হবে কেন? টীচার আসলে এমন জায়গায় লুকাতাম, কেউ খুঁজে পেত না, সংগীত চর্চ্চার এখানেই সমাপ্তি।
আমার আব্বা খুব রোমান্টিক মানুষ ছিলেন ।যতবার আম্মা ঢাকার বাইরে যেতেন ফিরে এসে একটা সারপ্রাইজ পেতেন। কখনো সমস্ত বারান্দা নেটিং করে চমৎকার নীল রঙ করলেন, আরেকবার নারিকেল গাছের গোড়া উঁচু করে ঘিরে পার্কের মত বসার জায়গা করলেন, সুন্দর লাগত দেখতে। তখন কদমতলায় ইলেকট্রসিটি ছিল, ওয়াসার পানি সাপ্লাই এসেছিল স্বাধীনতার পর। চাপকলের পানিই ভরসা। একবার ছুটি কাটিয়ে ফিরে দেখি মস্ত ড্রামে কল লাগানো,কাজের লোক ড্রাম ভরে দিয়ে যায়, আমাদের কি আনন্দ!এভাবেই আমাদের জীবনকে সহজ ও আনন্দময় করতে আব্বার নিরলস চেষ্টা ছিল, আর আমরা ও কত অল্পেই খুশী হতাম। আকাশছোঁয়া বায়না করে বাবামাকে বিব্রত করতাম না।
পাশের বাড়ির কাক্কু কাকী আম্মাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই তা কখনোই মনে হয় নি। দুটি বাড়ি ছিল এক পরিবারের মত। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটতাম কাকী আম্মার কাছে,আমার অন্তহীন বকবক শোনার ধৈর্য আর কার আছে? একদিন দেখলাম কাকী আম্মা কাঁথাগায়ে শুয়ে আছেন।
-কি হয়েছে?
-জ্বর।
-জ্বর হলে কি হয়?
-মানুষ মরে যায়।
মরে গেলে কি হয়?
-কবরে দিয়ে আসে।
তখন মনে পড়ল কিছুদিন আগে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে একজনকে কবর দেয়া হল। তখন মাথায় অন্য চিন্তা এল।–কাকী আম্মা, কবরে তো এ লকেট টা নিতে দিবে না(কাকী আম্মার গলার লাল পাথর বসানো লকেট টা বেশ পছন্দ ছিল)তাহলে এটা আমাকে দিবেন?
-আচ্ছা।
তারপর সকাল বিকাল খোঁজ নিতে থাকলাম। একবার বলেন,”তোর কাক্কু অফিস থেকে ফিরুক, “আবার বলে তোর বড় ভাইয়ের পরীক্ষা শেষ হোক।” একসময় ভুলে গেলাম, কাকী আম্মাও সুস্থ হয়ে উঠলেন।
আব্বা সেক্রেটারিয়েট এ চাকরী করতেন, মাসে দু তিনবার পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হত। সবসময় বাসায় আসার সময় পেতেন না, বাসায় ফোন ছিল না,পাশের বাসায় খবর দিতেন,আম্মা সুটকেস গুছিয়ে রাখতেন,পিয়ন বা ড্রাইভার নিয়ে যেত। আসার সময় বাসস্কেট ভরা এত ফল আনতেন,আমরা খেয়ে কুলাতে পারতাম না আত্মীয় প্রতিবেশীদের বিলানো হত। একবার আব্বা নিয়ে এলেন অপূর্ব এক হ্লুদ গোলাপ।এতদিন জানতাম গোলাপ শুধু লাল, সাদা আর গোলাপী হয়, হলুদ গোলাপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসত বাহারি সব কাপড়,নেট সার্টিন সিল্ক ব্রোকেড। সেসব কাপড় পাড়ার দর্জিকে দেয়া হত না,আলুবাজারে বুড়ো বিহারী দর্জির কাছে মাপ দিয়ে বানানো হত সিল্ক সাটিনের চূড়িদার,ব্রোকেডের কামিজ আর নেটের কুঁচিদেওয়া ফ্রক। আসার সময় পুরনো ঢাকার মিষ্টি আর নিমকপারার স্বাদ ভোলার নয়।
তখন ব্যবসা বাণিজ্য চাকুরী সবক্ষেত্রেই অবাংগালী বিহারীরা এগিয়ে ছিল। অভিজাত মার্কেট বায়তুল মোকাররমের অধিকাংশ দোকান ছিল বিহারীদের। পূর্ব পাকিস্তানের বাংগালীরা ছিল যেন “নিজভূমে পরবাসী”।
দু একটি ঘটনা আমার ছোট্ট মনেও দাগ কেটেছিল।প্রতিবেশী নাসিমা আপা মতিঝিল সেন্ট্রাল গভ: স্কুলে পড়তেন। স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে আমাকে তার সাথে নেয়া চাই। ঐ স্কুলের মর্নিং শিফট ইংলিশ মিডিয়াম অবাঙালী ছাত্রীদের জন্য, আর ডে শিফট বাংলা মিডিয়াম। কোন অনুষ্ঠান হলে মনে হয় দুই শিফট একত্র হত। সেখানে দেখতাম বিহারী মেয়েদের দাপটে বাংগালী মেয়েরা জড়সড় হয়ে থাকত। অবাক হয়ে দেখতাম, তারা যখন মাঠের টিউবওয়েল থেকে পানি খাচ্ছে, বাংগালী মেয়েরা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত কাছে যেতে সাহস পেত না। ওরা গাড়ী করে স্কুলে আসত,অনর্গল ইংরেজী ঊর্দুতে কথা বলত,দামী পোষাক পরত, যা অধিকাংশ বাংগালী পরিবারের সামর্থের বাইরে ছিল। দিনে দিনে ক্রমেই পূর্ব পশ্চিমের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছিল। এভাবেই ধীরে ধীরে হয়ত অসন্তোষ পূঞ্জিভূত হচ্ছিল বাংগালীর মনে।২য় পর্ব
স্মৃতিময় বাড়ী আর মায়াময় প্রতিবেশীরাঃ-
আমাদের কদমতলার বাড়িটি ছিল বেশ সুন্দর – অনেকটা মফস্বলের ডাকবাংলোগুলোর মত। যে আসত সেই মুগ্ধ হয়ে বলে উঠত, “ঢাকা শহরে এমন বাড়ি ভাবা যায় না।”
বিরাট উঠানের চারপাশ ঘিরে ঘর, সাদাদেয়াল ,টীনশেড। ভিতর বাইরে নানারকম ফুল ফলের গাছ। বাইরের ঘরের দেয়ালের পাশে টাইগার লিলির ঝাড়, মোটা ডাটায় একসাথে অনেক ফুল ফুটত বছর ভরে, ছাদ সমান উঁচু গন্ধরাজ গাছ, বারমাস ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকত। তখন মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ী সকালে রাস্তায় পানি ছিটাত, আর সুইপাররা ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করত রাস্তা। একদিন সকালে ঘুম ভাংলো ছোটভাই সোহেলের চেঁচামেচিতে, বাংলা উর্দু মিশিয়ে কাকে যেন বকাবকি করছে, ,”যেই না প্যাচা কি মাফিক চেহারা হ্যায়, আবার মাথামে ফুল লাগায়া কিউ?” চেয়ে দেখি গন্ধরাজ গাছ খালি, সব ফুল একদল সুইপার মহিলার মাথায় । বকা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
তখন সমস্ত পাড়া মিলে একটা বাড়ীর মত ছিল। হয়ত এলোচুলে এক্কাদোক্কা খেলছি, প্রতিবেশী কেউ ধরে বলত, এত সুন্দর চুলের যত্ন করিস না কেন? ,ধরে চপচপে তেল দিয়ে এত টাইট বেণী করে দিলেন, যে চুলের গোড়া ব্যথা করত। আমার ভাল লাগত না কিন্ত তখনকার দিনে যত্ন বলতে তারা এটাই বুঝতেন। পাড়া প্রতিবেশী বড় আপারা তাদের স্কুলে কোন অনুষ্ঠান থাকলে আম্মাকে বলে আমাকে পুতুলের মত সাজিয়ে সাথে নিয়ে যাবেন ই। সুলতানা আপারা ছিলেন কদমতলার সবচে’ “পশ” বাড়ীটার বাসিন্দা। অমন রংগীণ মাছের একুরিয়াম, হরিণের চামড়া বিছানো ড্রইংরূম, শুধু বাংলা সিনেমায় দেখতাম। তাদের বাড়ীর কুকুর আর বিড়ালের হ্যান্ডশেক দেখেও মুগ্ধ হতাম। সেই সুলতানা আপা স্কুল থেকে ফেরার পথে আমাকে বগলদাবা করে আনতেন। ভাত খেতে খেতে আমাকে তার পছন্দের কোন গান গাইতে বলতেন, আর আমিও তোতাপাখীর মত গাইতাম। খাওয়া শেষ করে সুরটা হারমোনিয়ামে তুলে নিতেন। তখন টু কি থ্রি তে পড়ি, রেডিও ছাড়া আর কোন সহজলভ্য উপায় ছিল না গান শোনার। স্কুলের স্যাররাও মাঝে মাঝে কমনরূমে ডেকে নিয়ে আমাদের গান শুনতেন।
আব্বা হারমোনিয়াম কিনে আনলেন, গানের টীচার ও ঠিক করলেন, দেখেই ত আমার মেজাজ গরম। গান হল আনন্দের ব্যাপার, তারজন্য ঘড়ি ধরে টীচারের কাছে ভ্যা ভ্যা করতে হবে কেন? টীচার আসলে এমন জায়গায় লুকাতাম, কেউ খুঁজে পেত না, সংগীত চর্চ্চার এখানেই সমাপ্তি।
আমার আব্বা খুব রোমান্টিক মানুষ ছিলেন ।যতবার আম্মা ঢাকার বাইরে যেতেন ফিরে এসে একটা সারপ্রাইজ পেতেন। কখনো সমস্ত বারান্দা নেটিং করে চমৎকার নীল রঙ করলেন, আরেকবার নারিকেল গাছের গোড়া উঁচু করে ঘিরে পার্কের মত বসার জায়গা করলেন, সুন্দর লাগত দেখতে। তখন কদমতলায় ইলেকট্রসিটি ছিল, ওয়াসার পানি সাপ্লাই এসেছিল স্বাধীনতার পর। চাপকলের পানিই ভরসা। একবার ছুটি কাটিয়ে ফিরে দেখি মস্ত ড্রামে কল লাগানো,কাজের লোক ড্রাম ভরে দিয়ে যায়, আমাদের কি আনন্দ!এভাবেই আমাদের জীবনকে সহজ ও আনন্দময় করতে আব্বার নিরলস চেষ্টা ছিল, আর আমরা ও কত অল্পেই খুশী হতাম। আকাশছোঁয়া বায়না করে বাবামাকে বিব্রত করতাম না।
পাশের বাড়ির কাক্কু কাকী আম্মাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই তা কখনোই মনে হয় নি। দুটি বাড়ি ছিল এক পরিবারের মত। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটতাম কাকী আম্মার কাছে,আমার অন্তহীন বকবক শোনার ধৈর্য আর কার আছে? একদিন দেখলাম কাকী আম্মা কাঁথাগায়ে শুয়ে আছেন।
-কি হয়েছে?
-জ্বর।
-জ্বর হলে কি হয়?
-মানুষ মরে যায়।
মরে গেলে কি হয়?
-কবরে দিয়ে আসে।
তখন মনে পড়ল কিছুদিন আগে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে একজনকে কবর দেয়া হল। তখন মাথায় অন্য চিন্তা এল।–কাকী আম্মা, কবরে তো এ লকেট টা নিতে দিবে না(কাকী আম্মার গলার লাল পাথর বসানো লকেট টা বেশ পছন্দ ছিল)তাহলে এটা আমাকে দিবেন?
-আচ্ছা।
তারপর সকাল বিকাল খোঁজ নিতে থাকলাম। একবার বলেন,”তোর কাক্কু অফিস থেকে ফিরুক, “আবার বলে তোর বড় ভাইয়ের পরীক্ষা শেষ হোক।” একসময় ভুলে গেলাম, কাকী আম্মাও সুস্থ হয়ে উঠলেন।
আব্বা সেক্রেটারিয়েট এ চাকরী করতেন, মাসে দু তিনবার পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হত। সবসময় বাসায় আসার সময় পেতেন না, বাসায় ফোন ছিল না,পাশের বাসায় খবর দিতেন,আম্মা সুটকেস গুছিয়ে রাখতেন,পিয়ন বা ড্রাইভার নিয়ে যেত। আসার সময় বাসস্কেট ভরা এত ফল আনতেন,আমরা খেয়ে কুলাতে পারতাম না আত্মীয় প্রতিবেশীদের বিলানো হত। একবার আব্বা নিয়ে এলেন অপূর্ব এক হ্লুদ গোলাপ।এতদিন জানতাম গোলাপ শুধু লাল, সাদা আর গোলাপী হয়, হলুদ গোলাপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসত বাহারি সব কাপড়,নেট সার্টিন সিল্ক ব্রোকেড। সেসব কাপড় পাড়ার দর্জিকে দেয়া হত না,আলুবাজারে বুড়ো বিহারী দর্জির কাছে মাপ দিয়ে বানানো হত সিল্ক সাটিনের চূড়িদার,ব্রোকেডের কামিজ আর নেটের কুঁচিদেওয়া ফ্রক। আসার সময় পুরনো ঢাকার মিষ্টি আর নিমকপারার স্বাদ ভোলার নয়।
তখন ব্যবসা বাণিজ্য চাকুরী সবক্ষেত্রেই অবাংগালী বিহারীরা এগিয়ে ছিল। অভিজাত মার্কেট বায়তুল মোকাররমের অধিকাংশ দোকান ছিল বিহারীদের। পূর্ব পাকিস্তানের বাংগালীরা ছিল যেন “নিজভূমে পরবাসী”।
দু একটি ঘটনা আমার ছোট্ট মনেও দাগ কেটেছিল।প্রতিবেশী নাসিমা আপা মতিঝিল সেন্ট্রাল গভ: স্কুলে পড়তেন। স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে আমাকে তার সাথে নেয়া চাই। ঐ স্কুলের মর্নিং শিফট ইংলিশ মিডিয়াম অবাঙালী ছাত্রীদের জন্য, আর ডে শিফট বাংলা মিডিয়াম। কোন অনুষ্ঠান হলে মনে হয় দুই শিফট একত্র হত। সেখানে দেখতাম বিহারী মেয়েদের দাপটে বাংগালী মেয়েরা জড়সড় হয়ে থাকত। অবাক হয়ে দেখতাম, তারা যখন মাঠের টিউবওয়েল থেকে পানি খাচ্ছে, বাংগালী মেয়েরা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত কাছে যেতে সাহস পেত না। ওরা গাড়ী করে স্কুলে আসত,অনর্গল ইংরেজী ঊর্দুতে কথা বলত,দামী পোষাক পরত, যা অধিকাংশ বাংগালী পরিবারের সামর্থের বাইরে ছিল। দিনে দিনে ক্রমেই পূর্ব পশ্চিমের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছিল। এভাবেই ধীরে ধীরে হয়ত অসন্তোষ পূঞ্জিভূত হচ্ছিল বাংগালীর মনে।২য় পর্ব
স্মৃতিময় বাড়ী আর মায়াময় প্রতিবেশীরাঃ-
আমাদের কদমতলার বাড়িটি ছিল বেশ সুন্দর – অনেকটা মফস্বলের ডাকবাংলোগুলোর মত। যে আসত সেই মুগ্ধ হয়ে বলে উঠত, “ঢাকা শহরে এমন বাড়ি ভাবা যায় না।”
বিরাট উঠানের চারপাশ ঘিরে ঘর, সাদাদেয়াল ,টীনশেড। ভিতর বাইরে নানারকম ফুল ফলের গাছ। বাইরের ঘরের দেয়ালের পাশে টাইগার লিলির ঝাড়, মোটা ডাটায় একসাথে অনেক ফুল ফুটত বছর ভরে, ছাদ সমান উঁচু গন্ধরাজ গাছ, বারমাস ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকত। তখন মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ী সকালে রাস্তায় পানি ছিটাত, আর সুইপাররা ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করত রাস্তা। একদিন সকালে ঘুম ভাংলো ছোটভাই সোহেলের চেঁচামেচিতে, বাংলা উর্দু মিশিয়ে কাকে যেন বকাবকি করছে, ,”যেই না প্যাচা কি মাফিক চেহারা হ্যায়, আবার মাথামে ফুল লাগায়া কিউ?” চেয়ে দেখি গন্ধরাজ গাছ খালি, সব ফুল একদল সুইপার মহিলার মাথায় । বকা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
তখন সমস্ত পাড়া মিলে একটা বাড়ীর মত ছিল। হয়ত এলোচুলে এক্কাদোক্কা খেলছি, প্রতিবেশী কেউ ধরে বলত, এত সুন্দর চুলের যত্ন করিস না কেন? ,ধরে চপচপে তেল দিয়ে এত টাইট বেণী করে দিলেন, যে চুলের গোড়া ব্যথা করত। আমার ভাল লাগত না কিন্ত তখনকার দিনে যত্ন বলতে তারা এটাই বুঝতেন। পাড়া প্রতিবেশী বড় আপারা তাদের স্কুলে কোন অনুষ্ঠান থাকলে আম্মাকে বলে আমাকে পুতুলের মত সাজিয়ে সাথে নিয়ে যাবেন ই। সুলতানা আপারা ছিলেন কদমতলার সবচে’ “পশ” বাড়ীটার বাসিন্দা। অমন রংগীণ মাছের একুরিয়াম, হরিণের চামড়া বিছানো ড্রইংরূম, শুধু বাংলা সিনেমায় দেখতাম। তাদের বাড়ীর কুকুর আর বিড়ালের হ্যান্ডশেক দেখেও মুগ্ধ হতাম। সেই সুলতানা আপা স্কুল থেকে ফেরার পথে আমাকে বগলদাবা করে আনতেন। ভাত খেতে খেতে আমাকে তার পছন্দের কোন গান গাইতে বলতেন, আর আমিও তোতাপাখীর মত গাইতাম। খাওয়া শেষ করে সুরটা হারমোনিয়ামে তুলে নিতেন। তখন টু কি থ্রি তে পড়ি, রেডিও ছাড়া আর কোন সহজলভ্য উপায় ছিল না গান শোনার। স্কুলের স্যাররাও মাঝে মাঝে কমনরূমে ডেকে নিয়ে আমাদের গান শুনতেন।
আব্বা হারমোনিয়াম কিনে আনলেন, গানের টীচার ও ঠিক করলেন, দেখেই ত আমার মেজাজ গরম। গান হল আনন্দের ব্যাপার, তারজন্য ঘড়ি ধরে টীচারের কাছে ভ্যা ভ্যা করতে হবে কেন? টীচার আসলে এমন জায়গায় লুকাতাম, কেউ খুঁজে পেত না, সংগীত চর্চ্চার এখানেই সমাপ্তি।
আমার আব্বা খুব রোমান্টিক মানুষ ছিলেন ।যতবার আম্মা ঢাকার বাইরে যেতেন ফিরে এসে একটা সারপ্রাইজ পেতেন। কখনো সমস্ত বারান্দা নেটিং করে চমৎকার নীল রঙ করলেন, আরেকবার নারিকেল গাছের গোড়া উঁচু করে ঘিরে পার্কের মত বসার জায়গা করলেন, সুন্দর লাগত দেখতে। তখন কদমতলায় ইলেকট্রসিটি ছিল, ওয়াসার পানি সাপ্লাই এসেছিল স্বাধীনতার পর। চাপকলের পানিই ভরসা। একবার ছুটি কাটিয়ে ফিরে দেখি মস্ত ড্রামে কল লাগানো,কাজের লোক ড্রাম ভরে দিয়ে যায়, আমাদের কি আনন্দ!এভাবেই আমাদের জীবনকে সহজ ও আনন্দময় করতে আব্বার নিরলস চেষ্টা ছিল, আর আমরা ও কত অল্পেই খুশী হতাম। আকাশছোঁয়া বায়না করে বাবামাকে বিব্রত করতাম না।
পাশের বাড়ির কাক্কু কাকী আম্মাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই তা কখনোই মনে হয় নি। দুটি বাড়ি ছিল এক পরিবারের মত। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটতাম কাকী আম্মার কাছে,আমার অন্তহীন বকবক শোনার ধৈর্য আর কার আছে? একদিন দেখলাম কাকী আম্মা কাঁথাগায়ে শুয়ে আছেন।
-কি হয়েছে?
-জ্বর।
-জ্বর হলে কি হয়?
-মানুষ মরে যায়।
মরে গেলে কি হয়?
-কবরে দিয়ে আসে।
তখন মনে পড়ল কিছুদিন আগে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে একজনকে কবর দেয়া হল। তখন মাথায় অন্য চিন্তা এল।–কাকী আম্মা, কবরে তো এ লকেট টা নিতে দিবে না(কাকী আম্মার গলার লাল পাথর বসানো লকেট টা বেশ পছন্দ ছিল)তাহলে এটা আমাকে দিবেন?
-আচ্ছা।
তারপর সকাল বিকাল খোঁজ নিতে থাকলাম। একবার বলেন,”তোর কাক্কু অফিস থেকে ফিরুক, “আবার বলে তোর বড় ভাইয়ের পরীক্ষা শেষ হোক।” একসময় ভুলে গেলাম, কাকী আম্মাও সুস্থ হয়ে উঠলেন।
আব্বা সেক্রেটারিয়েট এ চাকরী করতেন, মাসে দু তিনবার পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হত। সবসময় বাসায় আসার সময় পেতেন না, বাসায় ফোন ছিল না,পাশের বাসায় খবর দিতেন,আম্মা সুটকেস গুছিয়ে রাখতেন,পিয়ন বা ড্রাইভার নিয়ে যেত। আসার সময় বাসস্কেট ভরা এত ফল আনতেন,আমরা খেয়ে কুলাতে পারতাম না আত্মীয় প্রতিবেশীদের বিলানো হত। একবার আব্বা নিয়ে এলেন অপূর্ব এক হ্লুদ গোলাপ।এতদিন জানতাম গোলাপ শুধু লাল, সাদা আর গোলাপী হয়, হলুদ গোলাপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসত বাহারি সব কাপড়,নেট সার্টিন সিল্ক ব্রোকেড। সেসব কাপড় পাড়ার দর্জিকে দেয়া হত না,আলুবাজারে বুড়ো বিহারী দর্জির কাছে মাপ দিয়ে বানানো হত সিল্ক সাটিনের চূড়িদার,ব্রোকেডের কামিজ আর নেটের কুঁচিদেওয়া ফ্রক। আসার সময় পুরনো ঢাকার মিষ্টি আর নিমকপারার স্বাদ ভোলার নয়।
তখন ব্যবসা বাণিজ্য চাকুরী সবক্ষেত্রেই অবাংগালী বিহারীরা এগিয়ে ছিল। অভিজাত মার্কেট বায়তুল মোকাররমের অধিকাংশ দোকান ছিল বিহারীদের। পূর্ব পাকিস্তানের বাংগালীরা ছিল যেন “নিজভূমে পরবাসী”।
দু একটি ঘটনা আমার ছোট্ট মনেও দাগ কেটেছিল।প্রতিবেশী নাসিমা আপা মতিঝিল সেন্ট্রাল গভ: স্কুলে পড়তেন। স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে আমাকে তার সাথে নেয়া চাই। ঐ স্কুলের মর্নিং শিফট ইংলিশ মিডিয়াম অবাঙালী ছাত্রীদের জন্য, আর ডে শিফট বাংলা মিডিয়াম। কোন অনুষ্ঠান হলে মনে হয় দুই শিফট একত্র হত। সেখানে দেখতাম বিহারী মেয়েদের দাপটে বাংগালী মেয়েরা জড়সড় হয়ে থাকত। অবাক হয়ে দেখতাম, তারা যখন মাঠের টিউবওয়েল থেকে পানি খাচ্ছে, বাংগালী মেয়েরা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত কাছে যেতে সাহস পেত না। ওরা গাড়ী করে স্কুলে আসত,অনর্গল ইংরেজী ঊর্দুতে কথা বলত,দামী পোষাক পরত, যা অধিকাংশ বাংগালী পরিবারের সামর্থের বাইরে ছিল। দিনে দিনে ক্রমেই পূর্ব পশ্চিমের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছিল। এভাবেই ধীরে ধীরে হয়ত অসন্তোষ পূঞ্জিভূত হচ্ছিল বাংগালীর মনে।
নবীনগরে নবীন অভিজ্ঞতা
১৯৬৯ সন, ক্লাশ ফোরে পড়ি,দারুণ আলোড়ণ সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটলো, পৃথিবীর মানুষ চাঁদে পা রাখলো।নানারকম গুজব শুনে আমাদের চোখ কপালে উঠতে লাগল।নবীজী(সা:)এর মোজেজায় চাঁদ যে দুভাগ হয়েছিল,নভোচারীরা নাকি তা স্পষ্ট দেখেছেন। আমরাও চাঁদ উঠলে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টাকরি, রকেটের লেজ মাথা বা নভোচারীদের কোন ছায়া দেখা যায় কিনা।আবার শুনতাম চীনের প্রাচির আর হিমালয় পর্বত নাকি চাঁদ থেকে দেখা যায়।
তখনো বাসায় টিভি আসে নি,বিশালাকৃতি মারফী রেডিও আলমারীর উপর থাকত।একদিন স্কুলে যাবার জন্য রেডী হচ্ছি,রেডিওটা বাজছে ভাবলাম বন্ধ করে যাই। ছোট আমি নাগাল পাই না, উঁচু টুলটা এনে উপরে উঠলাম,তারপর আর কিছু মনে নেই।আম্মার হুংকারে জেগে উঠলাম, “দুধটা খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর।”দেখি বিছানায় শুয়ে আছি,চুল ভেজা আর মাথায় আলুর মত ফোলা।ভাইবোনদের কথায় বুঝলাম,টুল থেকে পড়ে গেছিলাম, বেশ ভি,আই,পি ভাব নিয়ে শুয়ে রইলাম।পরদিন স্কুলে যেতেই স্যার,”কিরে কাল আসিস নি কেন?”কি গর্বভরেই না উত্তর দিলাম,”টুল থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।” সারি সারি বিস্ফারিত ঈর্ষাভরা চোখের সামনে নিজেকে বেশ সেলিবৃটি লাগছিল।
কিশোর কাজের ছেলে হালিম ছিল রেডিওর একনিষ্ঠ শ্রোতা।একদিন কাকা রেডিওটা মুছে ব্যাটারী পাল্টানোর জন্য ঢাকনা খুললেন,হালিম হাতের কাজ রেখে দৌড়ে এলো।”কিরে,কি চাস?”‘
-“আব্দুল আলিম কই? হেরে দেখতে আইছি।””
আমাদের সেকি হাসি!
ক্লাস ফাইভের পরীক্ষার পর বেশ লম্বা সময়ের জন্য নবীনগর গেলাম, ছোটমামা সেখানে কৃষিব্যাংকের ম্যানেজার। আব্বা তিন মাসের জন্য অফিসের কাজে থাইল্যান্ড,আম্মা এই সুযোগে ভাইয়ের কাছে বেড়াবেন।
নবীনগরে কাটানো কয়েকটি মাস আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নূতন মাত্রা যোগ করলো।
রাশভারী ছোটমামাকে আমরা সবাই সমীহ করতাম,কিন্তু নবীনগরে মামার অন্যরকম স্নেহময় রূপ দেখতে পেলাম।আমরা ভাইবোনেরা সবাই আব্বার ন্যাওটা ছিলাম, আব্বাও ছেলেমেয়ে অন্তপ্রাণ ছিলেন।মামা আর আব্বা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।সব মিলিয়ে আমরা যাতে আনন্দে থাকি মামা চেষ্টার ত্রুটি করতেন না।আম্মার চাচাত ভাইয়ের ছেলে মিলন ভাই ছোটমামার বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেন।নাইনে পড়ুয়া ভাইটি প্রায়ই আমাদের ৬/৭জন পিচ্চি নিয়ে বেড়াতে বের হতেন,তাই আমাদের দলের নাম হয়ে গেল,”গালিভার এন্ড লিলিপুট।”
নদীর পারে গাছপালা বাগান ঘেরা কৃষিব্যাংকটি খুব সুন্দর ছিল।তখনও ব্যাংকে টানা পাখার ব্যবস্থা চিল মনে আছে। নদীর পারে বাঁধান ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখতাম লঞ্চ স্টীমারের যাওয়া আসা।আমাদের এক খালাম্মার নামে ‘”এম এল নীলা” নামের লঞ্চটি দেখলে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতাম। বাজারের সেলুনে দল বেঁধে চুল কাটতে গিয়ে সেখানেই প্রথম ক্ষুদিরামের নাম শুনি, দেয়ালে ঝুলানো ক্ষুদিরামের ফাঁসির ছবি দেখি।ঘরে ফিরে আম্মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মদানের কথা।সেলুন থেকে ফেরার পথে নামকরা শান্তি ডাক্তারের চেম্বার। বিশাল কাঁচের জারে ফরমালিনে ডুবানো সত্যিকার মানব শিশু,লিভার,হার্ট, সম্ভ্রম মেশানো বিস্ময় উদ্রেক করত।মনে ডাক্তার হবার ইচ্ছে ছিলই সেটা আরো তীব্র হত।
মফস্বল শহরে ব্যাংক ম্যানেজার,ডাক্তার,মুন্সেফ সাহেব,সিও সাহেব ও গুটিকয় সরকারী অফিসার মিলে ছিল অভিজাত সার্কেল,আমরাও এই সার্কেলেই আবদ্ধ থেকে তাদের সাথেই খেলতাম।মামার বাসার সামনে বড় একটা পুকুর,তার পাশে বিশাল সবুজ মাঠের মাঝখানে টুকটুকে লাল ইঁটের মুন্সেফ কোর্ট।
মিলন ভাইয়ের সহযোগীতায় পুকুরে আমাদের সাঁতার শিক্ষা চলতে লাগল।আমাদের ঘাটের বিপরীত দিকে আরেকটি ঘাট ছিল,সে বাড়ীতে একজোড়া জমজ ভাইবোন ছিল।তাঁদের কেমন ছিলে নেয়া চামড়ার মত সাদা রঙ,বুড়ো মানুষের মত সাদা চুল,রোদে তাকাতে পারত না,চোখ পিটপিট করত।এখন বুঝি ওরা এলবিনো,তখন ত এতকিছু বুঝতাম না, ওরা পানিতে নামলেই আমি ঘেন্নায় উঠে যেতাম পুকুর থেকে। আর এক দু:খজনক অভিজ্ঞতা আমার আম্বিয়া।শীর্ণ এ কিশোরী মায়ের সাথে বিভিন্ন বাসায় কাজ করত, তার মাথায় ছিল বুড়োমানুষের মত টাক।মেয়েদের এমন টাক হয় ভাবতে পারিনি,ওর জন্য খুব খারাপ লাগত।
এর মাঝে এক আনন্দের ঘটনায় গোটা নবীনগর উচ্ছ্বসিত।মুন্সেফ কোর্টের মাঠে “দি কমলা সার্কাস” তাবু ফেলেছ।অন্য সময় হলে কি হত জানিনা,এবার আমাদের সার্কাস দেখার অনুমতি জুটে গেল।মুগ্ধ হয়ে দেখলাম বাঘ সিংহ, হাতীঘোড়া,আর ট্রাপিজের খেলা,রিং মাস্টার আর জোকারের মোটা দাগের রসিকতা। সার্কাসের মেয়েগুলিকে মনে হচ্ছিল স্বপ্নলোকের পরী। দোটানায় পড়লাম,ডাক্তার হবার চিন্তা বাদ দিয়ে সার্কাসের খেলোয়ারই হয়ে যাব নাকি?
পরদিন পুকুরে স্বপ্নের পরীদের দেখলাম,নিতান্ত সাদামাটা,পুকুরে নেমে পরস্পর চেঁচামেচি গালিগালাজ করছিল,আর অশুুদ্ধ ভাষায় কথা বলছিল,স্বপ্নের পরীরা নিমেষেই দু:সপ্নের কাকতাড়ুয়ায় পরিণত হল।
নবীনগরে থাকাকালীন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ দেখে আৎকে উঠলাম,হাতিয়া সন্দীপ এলাকায় প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে অনেক প্রাণহানি হয়েছে।কাগজের পাতায় পাতায় গবাদিপশু, নগ্ন অর্ধনগ্ন মানুষের ফুলে উঠা মৃতদেহ দেখে বমি বমি লাগতে লাগল।বড়দের গম্ভীর মুখ আর অসন্তোষ্ট প্রতিক্রিয়ার কারণ তখন ভালভাবে না বুঝলেও পরে বুঝছিলাম,তৎকালীণ পূর্বপাকিস্তানের এই বিপূল প্রাণহানি,ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিদের কোন মাথাব্যথা নেই।যে দেশটির মানুষের শ্রমে ঘামে তাদের এ বিলাসব্যসন, তারা কীটপতংগের মত মারা পড়লেও প্রভূরা মাথা ঘামান না।কেনই বা ঘামাবেন,মানুষ ভাবলে তো!
তখনি হয়ত ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের ভিত্তি কেঁপে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘশ্বাসে।
আন্দোলনে উত্তাল দিনগুলো।
তিনমাস পর আব্বা ব্যাংকক থেকে ফিরলেন, আমরাও ঢাকায় ফিরে এলাম। ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন, কে যেন খবত নিয়ে এলো, আমাদের বাসায় টেলিভিশন এসেছে। প্রবল উত্তেজনায় ক্লাস সুদ্ধ সবাই ছুটে এলাম,অন্য ক্লাসের কয়েকজন ও এলো। কি সুন্দর চার পাওয়ালা কাঠের বাক্সে এন ই সি টিভি! বাক্সের ফরজাটা কোলাপ্সেবেল গেটের মত ভাঁজ হয়ে দুদিকে বুকে যায়,দেখে সবার সাধ মেটেনা।আমাদের পাড়ায় আর দুটো বাড়ী ছাড়া কোন টিভি ছিলনা।
তখন প্রতিমাসের শেষ শনিবার বাংলা ছায়াছবি দেখানো হতো,সেদিন ঘরে তিলধারণ এর ঠাঁই হতোনা। “তিতুমীর ” ছবিটি দেখানো হবে,তাই লম্বা বাঁশের মাথায় এন্টেনা বাঁধা হলো, টিভি বারান্দায় রেখে উঠানে বসে পাড়াপ্রতিবেশি মিলে দেখা হল। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে টিভি চলতো, সপ্তাহে একদিন, সম্ভবত সোমবারে বন্ধ থাকত।এখনকার মত দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা নানা চ্যানেলের সুবিধা ছিলনা। একটা ই চ্যানেল পাকিস্তান টেলিভিশন। উর্দু ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান, “হরতন হ্যয় দীপক” বেশ জনপ্রিয় ছিল, আর এবিসি উলের বিজ্ঞাপন দেখতে খাওয়া ফেলে ছুটে আসতাম।
ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠলাম, নতুন বইয়ের নেশাধরানো গন্ধে প্রাণ উচাটন, কিন্তু ক্লাস তো ঠিকমতো হচ্ছেনা,খালি স্কুল বন্ধ,হরতাল, অবরোধ, এসব শুনি। রেলগাড়ী,বাস,কিছুই ঠিকমতো চলেনা,যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম বিশৃঙ্খলা। বড়দের শুকনো মুখ, কেমন যেন হতাশ আর উৎকন্ঠা ভরা চাউনি। পাড়ায় পাড়ায় তরুণরা মশাল মিছিল করতে লাগলো, মিছিলে শ্লোগানে উত্তাল ঢাকা,এর মাঝে কয়েকটি মনে আছে,”৬০ টাকা মণ চাউল খেয়ে স্বর্গে যাব গো”, “আয়ুবমোনেম দুই ভাই,এক দড়িতে ফাঁসি চাই” ইত্যাদি। শেখ মুজিবের নাম ঘন ঘন শুনি,আয়ুব খান,ফাতিমা জিন্না,এসব নামও কানে আসে। আবার কিএক গদি নিয়ে কাড়াকাড়ির কথা শুনে অবাক হতাম, আর নিজেরা অলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতাম,নিশ্চয়ই গদিটা অনেক নরম,যারজন্য সবাই বসতে চায়। বন্ধুদের মাঝে চালাকচতুর একজন খবর আনলো,আইয়ুব খান নাকি অনেক বড়,আর শক্তিশালী,কদমতলার বিলে দাঁড়ালে তার মাত্র হাঁটুপানি হবে-শুনে আমরা শেখ মুজিবের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারপরনাই আশংকিত হলাম, কি করে বেচারা গদি দখল করতে পারবে!
যাই হোক,তুমুল উদ্দীপনার মাঝে নির্বাচন এসে গেল, চারদিকে ঈদ ঈদ ভাব,বড়রা সেজেগুজে ভোট দিতে যাচ্ছেন,আসা-যাওয়া র পথে আমাদের বাসায় থেমে চা- নাস্তা, গল্পগুজব চলছে। উৎসবের আমেজ তুঙ্গে উঠলো যখন জানা গেল, শেখমুজিবুর রহমান বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন।আমরা ছোটরা কিছু না বুঝেই লাফাতে লাগলাম, মনে অস্পষ্ট একটা ধারণা হলো, শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের রাজা হলে এই দেশটা মনেহয় বেহেশত হয়ে যাবে,বা কমপক্ষে টিভিতে দেখা বিলাত আমেরিকার মত হয়ে যাবে।
বড়রা চা খেতে খেতে রেডিওতে খবর শোনেন, শেখ মুজিবের সাথে পাকিস্তান সরকার আলোচনা করতে চায়। ইলেকশন জিতে এখন নতুন সরকার গঠন করবে-এখন আবার আলোচনার কি আছে! পরে সবাই বুঝতে পারে, এ সমস্তই ছিল বিশ্বাসঘাতকতার নীলনক্সা,ঘুমের মাঝে অতর্কিত হামলার পূর্ব প্রস্তুতি।
এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে অফিসের কাজে বড়মামা দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি দাউদকান্দি কো অপারেটিভ ব্যাংকের ম্যানেজার। ঢাকার অবস্থা দেখে মামা তড়িঘড়ি কাজ সেরে ফিরে যেতে চাইলেন।আমাদের স্কুলবন্ধ,সারাদিন নানারকম দুস্টামিতে ভাইবোন রা ব্যস্ত, তাই বড়মামা আমাদের দাউদকান্দি যাবার প্রস্তাব দিলেন, কেউ রাজী হলনা,আমি একপায়ে খাড়া। মামামামী আমাকে খুব ভালবাসেন,আমি নাচতে নাচতে চললাম,আম্মার বকাঝকা শুনতে হবেনা।
Views: 17