গিরগিটি
______নাহিদ ফারজানা
লিজা ফোনে জানালো, আগামী দুই মাস বাসায় একটু সমস্যা আছে,দুই বাচ্চার পরীক্ষা, একজনের শেষ হলে অপরজনের, তাছাড়া বাসায় চুনকাম করানো হবে, আমরা যেন দুই মাস পরে বেড়াতে যাই, আর ওকে যেন এতোটুকু ভুল না বুঝি।
ওর বাসায় যাবো,মনস্থির করেই ফেলেছিলাম। কাজেই
বাড়ির সবাই মিলে একটু হলেও হতাশ হলাম বৈকি। সবসময়তো আর বেড়ানোর সময় বের করা যায় না।মাস চারেক পরে শুভর সেমিস্টার শুরু হবে। কি আর করা! দরকার হয়,সেমিস্টারের পরে যাবো।
শুভ আর ফাইজা যারপরনাই দুঃখিত হলো। বেচারারা চট্টগ্রাম আর সেখান থেকে রাঙামাটি, কক্সবাজার ঘুরবে বলে কতো প্ল্যান প্রোগ্রাম করেছিল। আমি আর হাসানও কৃচ্ছসাধন করে টাকা-পয়সা জমিয়েছি কিছু, আমাদের চারজনের বেড়াতে যাওয়ার খরচ, লিজাদের চারজনকেও নিয়ে যাবো আমাদের সাথে,সেটার খরচ, ওদের জন্য কিছু উপহার নিয়ে যাবো তার খরচ, দুইদিন অন্ততঃ বেশি করে কাঁচাবাজার করে দিবো, খরচ সব মিলে নেহাৎ কম না।
টাকাটা ভাঙলাম না, যত্ন করে আলাদা জায়গায় তুলে রাখলাম।
ছেলেমেয়ে দুটো একটু গাঁইগুঁই করতে থাকলো।
“তিন্নি থ্রি তে আর তাজ টুতে পড়ে। এতো ছোট ক্লাসে এমন ভয়ংকর পরীক্ষা যে দুই মাস বাসায় কোন গেস্ট ই অ্যালাউড না?”
“সবাই তো তোদের মতো ফাঁকিবাজ না। ছোটবেলা থেকে সিরিয়াস হওয়া দোষের কিছু না।”
“লিজা আন্টিরা আমার এস.এস.সি পরীক্ষার মধ্যে এসেছিলেন আম্মু,টানা পনেরো দিন ছিলেন এই বাসায়।”
“বিপদে পড়ে এসেছিলো, মা। বিপদে আমরা যে কেউ যে কোন সময় পড়তে পারি।সুতরাং এগুলো নিয়ে কথা না।”
লিজা আমার বড় বোনের ননদ। আপারা আমেরিকায় সেটেলড। অনেকের কাছে শুনেছি, আপার শাশুড়ি, দেবর,ননদ নাকি বৌকে খুব জ্বালাতেন। আপার শ্বশুর বাড়ির কাছে আমার এক দূর সম্পর্কের খালা থাকতেন, আরও কিছু চেনা পরিচিত, তাদের কাছ থেকে খবর পেতাম। কিন্তু আপার মুখে আমি অন্তত শুনিনি কখনো। একবার নাকি আব্বা আপাকে নিয়েই আসতে চেয়েছিলেন একেবারে, কিন্তু আপার আপত্তিতে আর দুলাভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে পারেন নি। যে বাপ-মা সবসময় বলতেন, “একটা মেয়েকেও দেশের বাইরে বিয়ে দিবোনা, ওদের না দেখে থাকা অসম্ভব”, সেই বাপ-মা-ই কি যে খুশি হলেন আপারা আমেরিকায় সেটেল্ড হওয়ায়। তার কয়েকমাস পরে এক অ্যাক্সিডেন্টে দুলাভাই এর বাবা-মা স্পটেই মারা গিয়েছিলেন। বাকি রইলো এক দেবর আর এক ননদ,মানে আমাদের লিজা।
লিজা ছাড়া আপার শ্বশুরকুলের বেশির ভাগ সদস্যই দেশের বাইরে থাকেন। দেবরটা সেটল করেছে সুইডেনে।
লিজা যেতে পারছেনা কারণ তার বর হাবিব ভাই এখানেই বড় একটা চাকরি করেন, তার বাবা -মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন,শহরে আসতে চান না, আর হাবিব ভাই বাবা – মা’কে ফেলে দেশ ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। দেখতে পরীর মতো বলে আপার ঐ রকম বড়লোক বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল। আমার আর ছোট বোনের বিয়ে বাবা-মা মধ্যবিত্তশিক্ষিত পরিবারেই দিলেন। বেশি উচ্চবিত্ত পরিবারকে এড়িয়ে গেলেন।ন্যাড়া কি বারবার বেলতলায় যায়?
হাসান সরকারি কর্মকর্তা। আমি একটা ছোট খাটো এনজিও তে চাকুরি করি। মোটামুটি চলে যায় সংসার।
লিজার সাথে আগে অত ভাব ভালোবাসা ছিলোনা। মেয়েটাকে সবাই অহংকারী বলতো, গম্ভীর, রাগী। শুধু আপা তার ননদের হয়ে বলতো, “ও একটু চুপচাপ।” চুপচাপ মেয়েটার বিয়ে খেতে যেয়ে আমার ছোট বোন খুব নাজেহাল হলো। সবার হাতে মেহেদি পরিয়ে ক্লান্ত হয়ে ও লিজার ঘরে শুয়ে ছিল। আপার ঘরেই শুতে গেছিল, কিন্তু ওখানে লোকজনের ভীড় দেখে বেচারি এখানে এসে শুয়েছিল। ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে চেঁচিয়ে লিজা বাড়ি মাথায় করেছিল, “এত বড় সাহস! আমার রুমে আমার মাকে ঢুকতে দিইনা, আর কোথাকার কে শুয়ে আছে!”
দুলাভাই বোনকে বকা দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে গিয়েছিল। উনার মা তখন ময়দানে নেমেছিলেন। বউ ভেড়ুয়া ছেলে শুধু বৌএর হয়ে কথা বলে। বোনের থেকে শালি বেশি আপন।
যাহোক, আপা-দুলাভাই এর মুখের দিকে চেয়ে আমার ছোট বোন বিয়ে পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল। আমরা কেউ যাইনি,আব্বা ছাড়া।
মানুষ পাল্টায়। এই লিজাই কত পাল্টে গেছে! ঢাকায় এখন আর ওর কোন কাছের লোক থাকে না, আমরা ছাড়া। একদিন আমাকে ফোন করে নিজের পরিচয় দিল। আমিতো হতভম্ব। ওর বাচ্চা হতে সমস্যা হচ্ছে, ঢাকায় নামডাকওয়ালা একজন গাইনোকোলজিস্ট দেখাতে চায়। হোটেলেই উঠতে পারে কিন্তু একটা বাসার পরিবেশের জন্য মন কেমন করছে, আমার বাসায় উঠতে পারে কিনা।
আহা মেয়েটা! আমি বললাম,”অবশ্যই পারো। আমরা খুব খুশি হবো।”
ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্টও আমরা করে রাখলাম। হাসান অফিসের গাড়ি সহজে বাসার কাজে ব্যবহার করে না, কিন্তু লিজার জন্য ব্যবস্থা করলো। সে দফা ওরা পাঁচ দিন থাকলো। আমার গুড়িয়া দুটো তখন ছোট। ওকে আমরা খুব আদর যত্ন করলাম।মায়ের বাসায় বেড়াতে নিয়ে গেলাম। মা অনেক কিছু রান্না করে খাওয়ালেন।
ডাক্তার দেখাতে ওকে তিন-চারবার আসতে হলো। প্রতিবারই আমার বাসা,হাসানের সরকারি গাড়ি। লিজার স্বামী হাবিব ভাই ভীষণ লজ্জা পেতেন, “দুই দিন পরপর আপনার বাসায় উৎপাত। ও হোটেলে যাবে না,আমার বাবার এক কাজিন আছেন, ওখানে যাবেনা, আপনার এখানেই উঠবে।”
আমরা আপ্লুত হতাম।
“ও ঠিকই করেছে।আপনি আমাদের পর ভাবেন। এটা ঠিক না।”
বলতে হয়না, সবসময় ওরা একবাক্স মিষ্টি নিয়ে আসতো। আর কিছু না। আমার দুই বাচ্চার একটাও মিষ্টি খেত না, লিজা এটা খেয়ালও করেছিল, তাও একই ঘটনা প্রতিবার।
হাবিব ভাই একদিন অনেক বাজার করে আনলেন। কেন যেন ঐ রাতে ওদের স্বামী -স্ত্রীর প্রচন্ড ঝগড়া হলো,চাপা গলায়।প্রায় সারারাত। কথাগুলো বুঝা যায় নি, তবে সিরিয়াস ঝগড়া।
তারপরে সেই শুভ সংবাদ। লিজার বেবী হবে। হাবিব ভাইরা তখন সিলেট। আমরা যেতে চাইলাম। লিজা ফোনে নিষেধ করলো।”এখন এসেন না আপা, ওর মা,বোন,ভাবি সব এখানে। এরা যে কি জিনিস! আপনার কোন অপমান আমার সহ্য হবেনা।”
আরেকবার যাবো বলে চিন্তা করছি, উল্টো ওরই ফোন এলো। “আপা, পরশু ঢাকায় আসবো।বাবুকে একটু ডাক্তার দেখাবো। দুলাভাইকে বলেন না, অমুক ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখতে।”
এবারে বাচ্চা নিয়ে থাকলো সাতদিন। হাবিব ভাই দিয়ে গেলেন, নিয়ে গেলেন।
“বুঝলেন আপা,সারা দুনিয়ার মধ্যে আপনার এখানে থাকতেই আমার ভালো লাগে। মায়ের গায়ের গন্ধ পাই।”
আমি অভিভূত হলাম। ওর বাচ্চাকে কয়েক সেট কাপড় কিনে দিলাম, ডাক্তারের কাছে আনা-নেওয়া করলাম।
দিন পার হতে থাকলো। ওর আবার বাবু হলো। বিভিন্ন কারণে ওদেরকে কয়েকদফা ঢাকায় মানে আমার বাসায় আসতে হলো।
এবারে যাবোই মনে করছিলাম, কিন্তু ওদেরতো সমস্যা। বাচ্চাদের পরীক্ষা। বাসায় চুনকাম করা হবে।
হাসান বললো,”ওদের বাসায় উঠতেই হবে,এমন কথা নেই। সার্কিট হাউজে উঠবো।”
“আহা,ওর মন খারাপ হবে না?তাছাড়া মন চাইবে আমাদের সাথে ঘুরে বেড়াতে, কিন্তু বাচ্চাদের জন্য পারবে না। বারবার বলে, আপা-দুলাভাই যে আমাদের বাসায় কবে আসবে,সেদিন আমার জীবন ধন্য হবে।”
“থাক, আমাদের পদধূলিতে ওদের জীবন ধন্য করার দরকার নেই। জীবন এত তুচ্ছ না।”
অবশেষে চিটাগাং যাত্রা। সার্কিট হাউজে উঠলাম।
ফ্রেশ হয়ে ফোন দিলাম লিজাকে।
ওর গলা নিস্পৃহ। “বড়টারতো কাল ম্যাথ পরীক্ষা, প্রচণ্ড ব্যস্ত। আপনাকে সেদিনই বললাম না?”
“কাল বিকেলে আসি? তোমাদের জন্য কিছু জিনিস এনেছিলাম, পৌঁছে দিয়ে আসবো। দেখা হয়নি অনেকদিন। ”
“কি বলবো আপা! একে বাচ্চাকাচ্চার পরীক্ষা, তার উপরে কাল রাতে ওর বসের বাড়ি দাওয়াত। যেতেই হবে। আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করে সার্কিট হাউজে যাবো দেখি পরশু-তরশু, যদি পারি।”
“আমরা তো কক্সবাজার রওনা হবো পরশু।”
“আহারে আপা,কতো করে বললাম দুই মাস পরে আসেন,একসাথে সারা দুনিয়া ঘুরবো। শুনলেন না। এমন সময়ে আসলেন যখন নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। আর জিনিস পত্র আনতে গেলেন কেন? আমি কি দূরের কেউ যে ফরমালিটি করতে হবে?”
মনটা কেমন তিতা তিতা লাগলো। হাসান হাবিব ভাইকে ফোন করলো। সে বেচারা জানতেন না কিছুই। আমরা চট্টগ্রাম এসেছি, তার বাসায় না উঠে সার্কিট হাউজে উঠেছি দেখে দারুণ রাগারাগি করলেন। আমরা কিছু বললাম না। তিনি তখনই আসবেন আমাদের নিয়ে যেতে। হাসান তাকে নিরস্ত করলো বহু কষ্টে, “আমাদের জরুরি প্রোগ্রাম আছে। কাল বিকালে অবশ্যই তোমার বাসায় আসবো।তবে তোমার গিন্নীকে বোলো না,সারপ্রাইজ দিতে চাই। প্লিজ বোলো না।”
চট্টগ্রামের দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে পরদিন বিকেলে গেলাম লিজার বাড়ি।বাচ্চারা সার্কিট হাউজেই থেকে গেল।
আরি সর্বনাশ! এ তো প্যালেস। কলবেল টিপতেই হাবিব ভাই বের হয়ে এলেন।
আমাদের দেখে লিজা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। সেই সাথে মুখে কালো ছায়া।
হাবিব ভাই হাসতে হাসতে লিজাকে বললেন, “আপা-দুলাভাইয়ের রিকোয়েস্টে তোমাকে সারপ্রাইজ দিলাম, আগের থেকে কিছু জানাই নি। একি, বাচ্চারা কোথায় দুলাভাই? ”
“আর বোলোনা, ইদানীং কালের ছেলেমেয়েরা অদ্ভুত চিজ। সার্কিট হাউজেই থেকে গেলো, আসলো না।”
হাবিব ভাই অবিশ্বাসী চোখে তাকালেন।
“ওরা আমাদের বাসায় আসলো না? যাই,এখনই ওদের কান ধরে নিয়ে আসি। এতো সাহস! আপনাদের ব্যাগ -স্যুটকেসও নিয়ে আসবো,আগেই জানিয়ে রাখলাম। না,না আপা, কোনো কথা শুনবো না। আল্লাহর ওয়াস্তে আমার কথাটা রাখেন, আমাদের বাসায় থাকেন। আমরা থাকতে সার্কিট হাউজে উঠলেন? খুব কষ্ট পেয়েছি।
“ভাই, এইবার ক্ষমা করতে হবে। খুব লজ্জিত আমরা।
ওর অফিস কলিগরা দাওয়াত দিয়ে রেখেছে আগের থেকেই। ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে থাকতে এবারে ইচ্ছা পাখির মতো ঘুরে বেড়াবো। আজ রাতে আপনার বসের বাড়ি পার্টি না?”
“না তো?”
হাসান কপট রাগের গলায় বললো, “কার কি কথা শুনেছো,হাবিবের সাথে মিলিয়ে ফেলেছ!”
লিজার সাদা হয়ে যাওয়া মুখে রক্ত ফিরে এলো।
আমি ওদের উপহারগুলো বের করলাম। এগুলো কিনতে আমাদের বহু বাজেট কাটছাঁট করতে হয়েছে।
লিজার জন্য অনেক দাম দিয়ে কেনা জামদানী, হাবিব ভাই এর শার্ট, বাচ্চাদের কাপড়, প্রিমিয়ামের মিষ্টি।
হাবিব ভাই খুব অসন্তুষ্ট আমরা তাঁর বাসায় না থাকায়। কিন্তু কিছু করার নেই। হাসান উনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “ভায়রা, প্লিজ মন খারাপ কোরোনা। বিশ্বাস কর, আমাদের থাকার কোন উপায় নেই। এখন বসারও কোন উপায় নেই। থাকলে কি তোমার বাসায় থাকতাম না? আমাদের বোঝার ট্রাই কর।”
“চা খাওয়ার উপায়ও নেই? ”
“না রে ভাই, আমার ব্যক্তিগত খুব বড় একটা সমস্যা হয়ে গেছে। তুমি এতো আপনার মানুষ, তোমাকেও বলতে পারছি না।”
আরও খানিকক্ষণ কথা কাটাকাটি চললো। এই ফাঁকে নাশতার অর্ডার দিতে লিজা বসার ঘরের বাইরে বের হলো। আমিও পিছন পিছন গেলাম। লিজার চোখে চোখ রেখে খুব নিচু গলায় বললাম, “সাপ আসলে সাপই থেকে যায়। সাপ কি মানুষ হতে পারে? সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব তুমি নিওনা,ওদের ভালো চাইলে হাবিব ভাইকে দায়িত্ব দাও। আর শোন, দরকার পড়লে আমাদের বাসায় আসতে সংকোচ বোধ কোরোনা কিন্তু। ”
রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসলাম হাবিব ভাই আর বাচ্চাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। পাহাড় আর সমুদ্রের বিশালতা নিশ্চয় আমাদের সব অপমানবোধ ধুয়ে মুছে দিবে।
সমাপ্ত
Views: 28