অনটন কড়চা
________নাসরীন সুলতানা
সারাদিন রাস্তার রাস্তায় ভিক্ষে করে দিনশেষে আধা কেজি চাল আর ৫০টাকা নিয়ে শুকনো মুখে বাড়ি ফেরে মধ্যবয়স্কা জামিলা।
জামিলার তিনকূলে কেউ নেই,একেবারেই যে কেউ নেই তা বললেও ভুল হবে।স্বামীর বাড়ির আত্নীয় স্বজন সবাই আছেন।কিন্ত, স্বামীর দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হবার পর কেউ আর সেভাবে যোগাযোগ করে না।স্বামীর একটা ছোট পানের দোকান ছিল গঞ্জের হাটে।পানের সওদা করে দুজনের সংসার ভালোই চলে যেতো।
স্বামীর ইচ্ছে ছিল ১৩ বছর বয়স্কা এতিম জামিলাকে নিজের একটা মাথা গোজার ঠাঁই সে করে দেবে।টিনসেডের ছাউনি দেয়া একটা একতালা বাড়িতে একটা রুম,ছোট একটা রান্নাঘর আর বাথরুমসহ একটা ঘর ভাড়া থাকে তারা। তবুও,তো তা নিজের নয়।ভাড়া বাড়ি যতই ভালো হোক সে তো পরেরই বাড়ি,আজ ভাড়া দিতে পারলে থাকতে পারবে,কাল যদি ভাড়া দিতে না পারে বাড়িওয়ালা আর চিনবে না তাদের।নিঠুর জগতের এটাই খেলা।সে ভাবনায় জামিলার স্বামী সুজন সংসার খরচ বাদে কিছু কিছু টাকা প্রতিদিন আলাদা করে খাটের তলায় একটা মাটির বড় ব্যাংকে জমা করতো আর খুব গোপনে রাখতো।ভাবতো জামিলাকে যদি একটা টিনশেডের ঘর করে দিতে পারতো তবুও কিছুটা শান্তি পেতো মনে।
গঞ্জের বাজার থেকে একদিন লোকজন তাকে ধরাধরি করে ভ্যানে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসে।তারপর থেকেই সে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রইলো দীর্ঘদিন।জামিলা সামান্য ক্লাস ৫পাশ করা অল্পবয়েসী মেয়ে কখনো গ্রামের বাইরে পা রাখেনি স্বামীর চিকিৎসা কিভাবে করাবে সেই চিন্তায় নাওয়া খাওয়া প্রায় ছেড়ে দেয়।
স্বামীর অসুস্থতার পর থেকে জামিলা পানের দোকানটা চালাতে শুরু করলো। যে জামিলা কোনদিন ভিটের বাইরে পা রাখেনি সে আজ পেটের দায়ে দোকানে বসছে।এর আগে জামিলা শখ করে কখনো স্বামীর দোকানে ঘুরতে যেতে চাইলেও স্বামী বলত শোন বউ তুই কোনদিন গঞ্জে যাবি না, তোর এই চাঁদমুখ অন্য পুরুষে দেখুক এইডা আমার ভালা লাগে না।এরপর জামিলা আর কোনদিন গঞ্জের বাজারে যাবার আবদার করেনি।অথচ,নিয়তির কি খেলা আজ সেই জামিলা সেই গঞ্জের বাজারে প্রতিদিন বসে।
গ্রামের এক কবিরাজকে দেখিয়ে সেই সব ওষুধ খাইয়ে গফুরকে বাঁচিয়ে রেখেছে জামিলা।গফুর হাটাচলা করতে পারে না,অধিকাংশ সময় শুয়েই কাটায়।জামিলার মনে হয় মানুষটারে যদি একখান ওইযে চেয়ার ঠেইলা ঠেইলা চলন যায় সেরহম একখান চেয়ার কিন্যা দিতে পারতাম মানুষটার সারাদিন শুইয়া থাকা লাগত না।সারাদিন শুইয়া থাকা যে কি কষ্টের!ভাবতে ভাবতে জামিলার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
জামিলা প্রতিদিন সকালে অল্প চাল ফুটিয়ে ভাত রাধে আর একটা তরকারি রান্না করে এহন তো কোনকিছু আর আগের মত নাই, সবকিছুর ই যে দাম।মানুষটা আগে তাও সপ্তাহান্তে মাছ আনতো কতদিন অইছে ঘরে মাছ আসে না জামিলা নিজ মনে এসব ভাবতে ভাবতে অসুস্থ স্বামীর মুখে ভাতের লোকমা তুলে দেয়,স্বামী আগের মত খেতে পারে না,কয়েক লোকমা মুখে দেয়ার পর আর খেতে চায় না আর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার।জামিলা বুঝতে পারে তার অসহায়ত্ব তাকে যন্ত্রনা দিচ্ছে,জামিলা তার চোখ মুখে বলে ওঠে আরে আফনের কিচ্ছু অয়নাই, দেখবেন আফনে ওষুধ খাইতাছেন না জলদি আবার গঞ্জে যাইতে পারবেন।তারপর স্বামীর বেচে যাওয়া খাবারটাই জামিলা খেয়ে গঞ্জের দোকানে যায়।প্রতিদিন স্বামীর আধা খাওয়া খাবারটাই হয় জামিলার খাবার।সে মনে মনে ভাবে ভাগ কইরা খাইলে ভালোবাসা বাড়ে। দ্রব্যমূল্যের ব্যপারটা সে খুব ভালোই জানে তবুও নিজের মনকে এসব বলে সান্ত্বনা দেয় প্রতিনিয়ত।
আজ তিন দিন গফুর কিছু খেতে পারেনা,চোখ মুখের চেহারা মলিন হয়ে গেছে, তার মুখের দিকে তাকালেই জামিলার আকাশ ভেঙে কান্না আসে। কিন্ত, সে কাঁদতেও পারে না তখন সেভ ভাবে আইজ যদি আমার মা ডা বাইচ্চা থাকত মায়ের কান্ধে মাথাডা রাইখ্যা অন্তত একটু পরাণডা ভইরা কান্তে পারতাম,কানলে ভিতরডায় কি যে শান্তি আহে!
জামিলা প্রতিদিন দুপুরে তিন কিলোমিটার পায়ে হেটে গঞ্জের দোকান থেকে এসে গফুরকে দুপুরে খাইয়ে নিজে খেয়ে আবার তিন কিলোমিটার হেটে গঞ্জে ফিরে যায়। সারাদিন দোকান চালিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে গফুরের করুন মুখটার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক শান্তি আঁকে নিজের চোখে মুখে।
গফুর হঠাৎ অতিরিক্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় গঞ্জের বাজারের পরিচিত কিছু মানুষ ছুটে আসে জামিলার বাড়িতে,তারা জামিলাকে সাথে নিয়ে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যায়।ডাক্তার অনেক পরিক্ষা নিরিক্ষা দেয়, সেগুলো করাতে জামিলা তার কানের দুল জোড়া বেচে দেয়, এই দুল জোড়া তার বিয়ের একমাত্র স্মৃতি।গফুর জানলে খুব কষ্ট পাবে কিন্ত,কানের দুল দিয়ে সে কি করবে যদি গফুরই না থাকে?গফুর ছাড়া তার যে নিজের বলতে আর কেউ নাই।
গফুরের অনেক পরিক্ষা নিরিক্ষা করাতে হবে অনেক টাকা দরকার, কানের দুলটা বিক্রি করে হাসপাতে ফেরার পর ডাক্তার জানান গফুরেরবপাকস্থলীতে ঘা হয়েছে যা দীর্ঘদিন যাবত শরীরের ভেতর থেকে থেকে এখন ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে,জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করাতে হবে।
জামিলার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছিলো। তারপর সে মনস্থির করলো দোকানটা বিক্রি করে দেবে, গফুর বেঁচে ফিরলে কিছু একটা করে খেয়ে তো বাঁচতে পারবে।এখন গফুরকে বাঁচাতে হবে যে করেই হোক।
সে গঞ্জের দোকানটা বিক্রি করে দেয়, গঞ্জের আশেপাশের চেনা পরিচিত মানুষেরাও যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।এতকিছু করেও জামিলা গফুরকে বাঁচাতে পারে না।সে গফুরকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ঠিকই কিন্ত জীবিত গফুরকে না,সে ফিরিয়ে নিয়ে আসে গফুরের মৃতদেহকে।
গফুরের মৃত্যুর পর সে আর সংসার বাধেনি, তারও বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে যায় কিন্ত,সে ভাবে এমনে মইরা গেলে তো হুনছি পরকালেও সুখ পামু না,হেরে লগে এই জনমে তো আর দেহা হইব না কিন্ত এমনে মরলে তো পরকালেও হের লগে থাহা অইব না,হে যে বড় ভালা মানুষ আছিল আল্লায় তারে ভেস্তে দিলে আমি যদি আত্নহত্যা কইরা মরি আমারে তো আল্লায় দোজখে দিব তাইলে হেরে কেম্নে পামু!বাইচা থাকতেই হইব আমার আল্লায় যতদিন হায়াত রাহে।
তারপর জামিলা গঞ্জের হোটেলে ফাইল ফরমায়েশের কাজ নেয়, মহাজন তাকে প্রতিনিয়ত কুপ্রস্তাব দিতে থাকে লোকলজ্জার ভয়ে এই কথা সে কাউকেই বলতে পারে না।রাগে দু:খে ঘৃনায় সে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমায়।
শহরে লোকের বাসায় কাজ নিয়েও সে বুঝতে পারে দুনিয়াটা কতটা ব্যাভিচারে ছেয়ে গেছে।
স্বামীর গোপনে রেখে যাওয়া কিছু টাকা দিয়ে কিছু কাঁচের চুড়ি কিনে নিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে বহুবছর কিন্ত,এই মধ্যবয়সে এসে আর সে কাজও করতে পারছে না।এদিকে সঞ্চয়ের টাকাও শেষ, বাধ্য হয়ে বস্তি থেকে বেরিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষে করে,কেউ চাল দেয় তো কেউ ২টাকা,৫ টাকা।সেভাবে আজ আধা কেজি চাল আর ৫০ টাকা পেয়েছে। তার শরীর আর সমর্থন দেয় না বাড়ি বাড়ি গিয়ে এভাবে ভিক্ষে করে খেতে এই টাকা আর চাল দিয়ে কদিন ই বা চলবে!অনিশ্চয়তায় আর দারিদ্র্যতার যন্ত্রনায় প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে জামিলা।
Views: 19