অপালার ডায়েরি
___নাহিদ ফারজানা সোমা
ধারাবাহিক গল্প(২য় পর্ব)
অভি বেশ বিরূপ আমার ওপরে। মোটা মোটা খাতাগুলো রাত জেগে পড়ছি, এলিনের লেখাপড়ায় সাহায্য না করে পড়ছি, অনেক সময় খেতে খেতেও পড়ছি। এই খাতাগুলো পড়ার জন্য যখন পরপর দু’দিন গোসল করলাম না,তখন অভি খুব রেগে গেলো।
কিন্তু আমি নেশাগ্রস্ত। খাতাপত্র উল্টাতে পাল্টাতে যেয়ে আমার চোখে পড়েছে মেয়েটা মানসিক রোগে আক্রান্ত। অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার। সেই সাথে মারাত্মক রকমের ডিপ্রেশন আর অ্যাংজাইটি। মনের এই রোগটি আমারও আছে সেই ছোট বেলা থেকে। তাই আগ্রহটা অনেক বেড়ে গেছে। দেখি,নিজের সাথে ওর কি কি বৈশিষ্ট্য মিলে।
অপালার ডায়েরি
…………………….
আর পারছি না। মাথাটা ভীষণ ভার হয়ে আছে।বমি ভাব হচ্ছে। মোট আটবার পড়লাম পড়াটা। মগজে গেঁথে গেছে। তাও মনে হচ্ছে, পড়িনি। না পড়লে নেই। কিন্তু আমিতো এই জাল ছিঁড়ে বের হতে পারছি না। আমাকে আবারও পড়াটা পড়তে হবে।
নয়বার একই জিনিস পড়া হলো। আজকে যে এই জিনিসটা পড়েছি তার দলিল হিসাবে আজকের তারিখ দিয়ে না দেখে পড়াটা লিখে রেখেছি। কিন্তু মনটা আবার কেমন কেমন করছে। মনে হচ্ছে আবারও পড়তে হবে। উহ! কি মারাত্মক কষ্ট!
কি সাদাসিধা, সহজ সরল জীবন ছিলো আমার। হাসি-কান্না,আনন্দ -বেদনা সবকিছু নিয়ে সাধারণ সুন্দর স্বাভাবিক একটা জীবন। আর দশজনের মতো। ক্লাস সেভেন থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিষয় মাথায় আসতে থাকলো। তখন অদ্ভুত মনে হয়নি, স্বাভাবিক মনে হয়েছে। ভেবেছি, আমি ঠিক যা ভাবি,যা করি,এটাই স্বাভাবিক। এখানে যে কি গভীর অসুস্থতা, অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে আছে,তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই।কিন্তু সমস্যাগুলো এতো অদ্ভুত ধরণের,কারোর সাথে শেয়ার করা যায় না। ভীষণ লজ্জা লাগে।
আমরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতাম বাসার সবাই। ক্লাস সেভেনে মনে হলো,আমাকে শুদ্ধ, সুন্দর ভাষায় কথা বলতে হবে,না হলে জীবনই বৃথা। হঠাৎ করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা আরম্ভ করা যথেষ্ট কঠিন। সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তো আছেই, সেই সাথে মুখ ফসকে জন্ম থেকে বলে আসা আঞ্চলিক শব্দও বের হয়ে পড়ে। তখন আমার তীব্র গ্লানিবোধ হয়, মনে হয়, এতোকাল আমি লেখাপড়া, ভালো কাজ যা কিছুই করেছি,তার সবই বৃথা। অন্তঃসারশূন্য। কিন্তু আমি শিক্ষিত, সুন্দর, নির্মল জীবনের অধিকারী হতে চাই, কাজেই অশুদ্ধ কথা বলায় আমার আজকের দিনটা এবং আগের দিনগুলোর খেল খতম। আগামী কাল থেকে সুন্দর করে কথা বলা শুরু করবো,আর ভুল করবো না, কাল থেকে আমার নতুন সুন্দর একটা জীবন শুরু হবে। মনে অনেক আশা নিয়ে শুতে যেতাম,পরদিন সাবধানে সুন্দর করে কথা বলতাম, একটা দু’টা বেতাল হয়ে যেতো, ব্যাস,আমার সেই দিনটাও বাতিল।
তারপরে আমার সব বিষয়ে পারফেকশনিস্ট হওয়ার ভুত মাথায় চাপলো। আমি একটাও মিথ্যা বলবো না, গীবত করবো না,কারোর সাথে দুর্ব্যবহার করবো না,অসৎ কাজ করবো না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি একটা বাক্য উচ্চারণ করলে মনে মনে ভাবতাম,খারাপ বা মিথ্যা কিছু বললাম নাতো?একবার ভেবে হতো না, বারবার ভাবতে হতো ঐ যে তখন কথাটা বললাম,খারাপ কিছু বললাম না তো? মাথার মধ্যে একই জিনিস ঘুরতে থাকতো। ভয়ে আমি কথা বলা কমাতে থাকলাম। আমার গোসলের সময় পনেরো মিনিট থেকে বাড়তে বাড়তে এখন হয়েছে আড়াই ঘন্টা। শ্যাম্পু সাবান দিই,মনে হয় দেওয়া হয়নি,তাই আবার দিই আর ধুই,তখন আবার মনে হয়,না,আজকে শ্যাম্পু, সাবান দেওয়া হয়নি। যদি ও জানি দিয়েছি, তারপরও আবার। গোসলের প্রতি আতংক ধরে গেলো। এভাবে সব কাজ আমার জন্য খুব ভয়ের হয়ে গেলো। কারণ , যে কাজটাই করতে চাইবো তা শতভাগ নিখুঁত হতে হবে।কিন্তু তাই কি সম্ভব?
গ্রীষ্ম কালে বা মেন্টাল স্ট্রেস বাড়লে সমস্যাটা অনেক বেড়ে যায়। এই এখন যেমন। ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে কি খুশিই না হয়েছিলাম। কতো স্বপ্ন। সব ভেঙে চুরমার। চারদিকের নোংরামি , বাপ-মা-ভাই-বোনদের ছেড়ে থাকার কষ্ট, আপা আর আদিবের হোস্টেল লাইফ নিয়ে টেনশনে আমার এই অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার , যাকে কিনা সংক্ষেপে ডাক্তাররা ওসিডি বলেন, মারাত্মক বেড়ে গেছে। একটা বাক্য উচ্চারণ করলেই সেটার ময়নাতদন্ত করতে থাকি মনে মনে।একবার না, বহুবার। মিথ্যা বলে ফেললাম নাতো? কারোর নামে গীবত হলো না তো? কারোর মনে কষ্ট লাগলো না তো? আমার এখন কথা বলতেই ভয় লাগে। বাবা-মা-ভাই-বোনদের সাথে ফোনে কথা বলার পরে অনবরত ভাবতে থাকি,ওদের মনে কষ্ট দিয়ে,ওদের অপমান বা অবহেলা করে কোনো কথা বলেছি কিনা।
একই চ্যাপ্টার বারবার পড়ি। মন আমাকে পড়তে বাধ্য করে। নতুন চ্যাপ্টার শুরু করলেও সাথে পুরানোটা আবার পড়তে হয়। কাজেই পড়ায় সময় দিতে হয় অনেক বেশি। তাজিন,নায়লা,ইতুরা হাসাহাসি করে। খোঁচা মারে।এতো পড়েও রেজাল্ট একেবারেই সাধারণ। আর আমার থেকে কম পড়েও তারা আমার থেকে বেশি নম্বর পায়।
“শোন অপালা,সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলে এই অবস্থা ই হয়। আর যারা আড্ডা মারে, রাজনীতি করে, এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়ায়,তারা লাইফটাকে এনজয়ও করে,রেজাল্টও তোর থেকে অনেক ভালো করে।আউটনলেজ এদেরই অনেক বেশি হয়।”
হায়রে! তোমরা যদি জানতে আমার করুণ অবস্থার কথা। ক্লাস সেভেনে অসুখটার উৎপত্তি হলেও ক্লাস নাইন পর্যন্ত ক্লাসে আমাকে কেউ টপকাতে পারে নি। আমি ভীষণ হাসিখুশি, চঞ্চল ছিলাম। আমি ভালো গান গাইতাম। দৌড়ে আমাকে কেউ হারাতে পারতো না। আমি বিজ্ঞান মেলায় আমার উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতাম। সংগঠক ও উপস্হাপক হিসাবেও আমি অনন্য ছিলাম। ধর্মকর্ম করতাম পরম নিষ্ঠার সাথে। আর এখন নামাজ পড়ি ঠিকই,কিন্তু অস্হির মন নিয়ে। নামাজের মধ্যে রাজ্যের চিন্তা মাথায় আসে।আমি যদি অসুস্থ না হতাম তাহলে হয়তো অনেক বড় কিছু করতে পারতাম। থাক! কি পারতাম আর কি পারতাম না, সেটা ভেবে লাভ কি?
এরা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। অন্যান্য বন্ধুরাও আসে। হৈচৈ, হিন্দি গান ছেড়ে দিয়ে উদ্দাম নাচ, জম্পেশ আড্ডা। ঘরের লাইট জ্বলে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত। প্রথম প্রথম ভীষণ কষ্ট হতো,এখন অনেকটা সয়ে গেছে। লাইট অফ করতে বললে ওরা খেপে আগুন হয়ে যেতো, আমাকে গাঁইয়া বলতো। সবাই একদিকে, আমি একদিকে, এভাবে টিকে থাকা যায় না। তাই আমিও টিউব জ্বলা ঘরে হাসাহাসি, গল্পের মধ্যে ঘুমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তবে আরামের ঘুম হয়না, মাঝে মাঝেই ওদের তীব্র উল্লাস ধ্বনিতে ঘুম ভেঙে যায়।
আমরা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে এসেছি। এই আমাদের শিক্ষা দীক্ষার নমুনা? ভোগ বিলাসিতা, বিশৃঙ্খল জীবন ধারা, তেলা মাথায় তেল দেওয়া,দুর্বলদের পায়ের তলায় রাখা, এগুলো কি ছাত্র জীবনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে?এরা বাসা থেকে মাসে মাসে অনেক টাকা পায়,পনেরো দিন যেতে না যেতে আবার টাকা চেয়ে পাঠায়। পয়লা ফাল্গুন, পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন ডে, স্বাধীনতা দিবস,বিজয় দিবস,শোক দিবস,সব দিবসেই নতুন পোশাক। শাড়ি,ব্লাউজ, সালোয়ার কামিজ। আমাদের হলের নেত্রী আপাদের বিভিন্ন নির্দেশ মানতে হয়। মিছিল, মিটিং লেগেই আছে। সেগুলোর বিষয়বস্তু হলো বিরোধী দলের পিণ্ডি চটকানো,ক্ষমতাসীন দলকে তেলের সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া। এই নাকি রাজনীতি।
আপা ফাইনাল ইয়ারে উঠেছে। ওদের হোষ্টেলে এতো বেশি ঝামেলা নেই। তবে ও খুব কষ্ট পায় যখন দেখে সারা বছর একেবারেই পড়ালেখা না করা ছাত্র বা ছাত্রীরা ক্ষমতার দাপটে দলে দলে পাশ করে যাচ্ছে। লিখিত পরীক্ষার সময় খোলাখুলি নকল চলছে, নির্ভীক ও সাবলীল ভাবে। শিক্ষক ছাত্রনেতার পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছেন, ছাত্র তা লিখে নিচ্ছে। আগে লেডিজ হোষ্টেলে কোনো রাজনীতি, মারামারি, হানাহানি ছিলোনা, বেশ কয়েক বছর হলো এগুলোর আবির্ভাব ঘটেছে। মহিলা মাতব্বররা এমন ভাব করেন যেন হোষ্টেল তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি, ছাত্রীরা তাঁদের খাস বান্দি।
এরমধ্যে আমাদের পরিবারে এক বিব্রতকর ঘটনা ঘটেছে। আমার সাতচল্লিশ বছর বয়সী মা এবং তিপ্পান্ন বছর বয়সী বাবা আবারও বাবা-মা হতে চলেছেন।
অনুভূতিটা খুব একটা সুখকর নয়। এতো বয়সে মা আবার মা হবেন, ব্লাড প্রেশার ও ডায়াবেটিসের রোগী, এতোটা ধকল সহ্য করতে পারবেন তো? বাচ্চাটা কি সুস্থ ভাবে জন্ম নিবে? আপা আর আমার এখন মা হওয়ার কথা, সেখানে মা নতুন করে সন্তানের জননী হবেন,এ কেমন কথা? এমনিতেই এতো টানাটানি, কৃচ্ছসাধন, এখন সংসারের ব্যয় অনেকখানি বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে। মানুষজন কি বলবে?
আপাও ফোনে কাঁদলো। তার একটু রাগ হচ্ছে। বন্ধুরা জানলে হাসাহাসি করবে। এটা কোনো অ্যাকসিডেন্ট না,বাবা-মা ইচ্ছা করেই সন্তান নিয়েছেন। মা নাকি স্বপ্ন দেখেছেন, কে যেন তাঁকে বলছেন, “তোমার এবারে একজন নেককার সন্তান জন্ম নিবে, তার আলোয় দুনিয়া আলোকিত হবে,তার নাম সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে, তার উসিলায় তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।”
আপা কাঁদতে কাঁদতে বললো,”এটা কোনো কথা,বল্? আসলে বাবা-মায়ের আরেকটা ছেলের শখ হয়েছে। ”
বাবা-মা কিন্তু কখনো ছেলে মেয়েতে ভেদাভেদ করেন নি। এই যে চার বোনের এক ভাই আদিব,তার থেকে আলাদা চোখে আমাদের দেখেন নি কখনো। সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধা, সবাইকে সমান আদর।
আমার ছোট বোনদুটোও বড় লজ্জার মধ্যে আছে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের কাছে মুখ দেখাতে পারছে না।
আদিব ব্যতিক্রম। সে বললো,”এটা বাবা-মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। যদিও মা আর বাচ্চার অবস্থা নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছে। মা’কে ভালো ডাক্তারের আন্ডারে রাখতে হবে এখন থেকেই। ”
ভাইটা আমার মা’কে ঢাকায় নিয়ে এসে ভালো ভালো ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করলো। মা’কে উঠালো আমার দূর সম্পর্কের এক খালার বাসায়। খালা-খালু যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। তাঁরা বেশ উচ্চবিত্ত। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত। বাবা-মা দু’জনেই প্রাইমারি স্কুলের টিচার। আমরা ভাইবোনরা পড়ালেখায় ভালো। তাতে কি?আমাদের মধ্যে একটা “গাঁইয়া” ভাব আছে।আমাদের চেহারায়,জামাকাপড়ে,চলনে বলনে স্মার্টনেসের অভাব। যদিও আমার লোকাল গার্জিয়ান হিসেবে খালুর নাম দেওয়া আছে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরে দুই তিনবার খালার বাসায় গিয়েছিলাম। তারপরে সঙ্গত কারণেই আর যাওয়া হয়নি।
মা’কে ডায়াবেটিস স্পেশালিষ্ট, হার্ট স্পেশালিষ্ট, গাইনোকোলোজিস্ট দেখিয়ে দরকারি সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে বাড়িতে রেখে আসলো আদিব। মা আর অনাগত ভাই বা বোনের সুস্হতা প্রার্থনা করে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়তে থাকলো। হলে এবং পুরো বুয়েট ক্যাম্পাসে অনেক টিটকারির শিকার হতে হচ্ছে আমার আদরের ভাইটিকে। জামাত-শিবিরের শয়তান, হুজুর, মওলানা সাহেব, স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী, লেবাসধারী, ফ্রড, মাদ্রাসার প্রোডাক্ট এমন অনেক কথা শুনতে হচ্ছে তাকে। আদিবকে দিয়ে এক ছাত্রনেতা প্রায় পা টিপায়। ও চারটা টিউশনি করে এখন। সেই টিউশনের টাকা দিয়ে প্রায় রাক্ষসগুলোকে খাওয়াতে হয় বেচারার। আচ্ছা, এই রাক্ষসগুলো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কি করবে? দেশকে আরও ধ্বংসের পথে এগিয়ে দিবে? সমানে ঘুষ খাবে? কন্ট্রাক্টরদের সিঁড়ি বানিয়ে একেকজন বিলিওনার হযে যাবে?এদের বানানো অতিকায় বিল্ডিংগুলো হঠাৎ ধূলিকণার স্তূপ হয়ে ধ্বসে পড়বে রানা প্লাজার মতো? এদের বানানো ফ্লাইওভার ভেঙে পড়বে অগুনতি মানুষের উপরে? এদের বানানো ব্রিজ, কালভার্টে ভাঙন ধরবে দুদিনেই? নাকি গডফাদারদের হাত ধরে এরা মন্ত্রী, এমপি হবে? আশা করতে দোষ নেই, আল্লাহ এদের হেদায়েত করবেন। আচ্ছা , এই দানবগুলোর বাবা-মা নেই? তাঁরা সন্তানদের অমানুষ হয়ে যাওয়ার খবর জানেন না? এতে তাঁদের কষ্ট হয়না?সন্তানদের ঠিক পথে আনার চেষ্টা করেন না তাঁরা? বলেন না,”ওরে, তোরা এখন যাদের বাবা-মা-বড় ভাই-বড় আপা ভাবছিস,ওরা তা না।ওরা তোদের আপনজন না। ওরা তোদের ব্যবহার করছে। তোরা মরলে তোদের লাশ ওরা নিজেদের লাভের জন্য ব্যবহার করবে, এক ফোঁটা শোক ওদের হবেনা। দরকারে ওরা তোদের গলায় ছুরি চালাতেও দ্বিধা করবেনা। ওরা তোদের কেউ না।ওরা তোদের শত্রু, দেশের শত্রু। আমাদের বুকে ফিরে আয় লক্ষীসোনারা।”নাকি অনেক সরলপ্রাণ বাবা-মা বুঝেনই না যে তাঁদের আদরের বাচ্চা এখন দানব হয়ে গেছে। অনেক বাবা-মা নিজেরাই হয় তো দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।
এদের হাতে জিম্মি সমস্ত দেশ। আমার ছোট চাচা, বড় মামা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন। তাঁদের বাবা-মায়েরা ছেলেদের যুদ্ধে যেতে দিতে চান নি। ঘরে ছেলেদের তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। বন্ধুদের সাহায্যে তাঁরা পালাতে সক্ষম হন, বাবা-মা-ভাই-বোন সবার তীব্র ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করে, নিশ্চিত পাঁচ বেলা পেট ভরে ভালোমন্দ খাবার, আনন্দময় পারিবারিক বা বন্ধুদের আড্ডা, আরামের ঘুম সবকিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। দেশকে ভালোবেসে, শুধুমাত্র মাতৃভূমিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে। শুধু মাত্র স্বাধীনতার আশায়। বড় মামাকে বিহারিরা জবাই করেছিলো। জবাই করার আগে ও পরে আনন্দোৎসব করেছিলো, বড় মামা জেনে গিয়েছিলেন তাঁকে জবাই করা হবে দুই তিন ঘন্টা পরে। ঘাতকগুলোই জানিয়েছিলো। তারপরে শুরু করেছিলো পৈশাচিক অত্যাচার। সারা শরীরে ছুরিকাঘাত, চোখে মরিচের গুঁড়ো, পানি চাইলে মুখে পেশাব করে দেওয়া,অতঃপর অনেক সময় নিয়ে জবাই।
ছোট চাচার শরীর জীবন্ত অবস্থায় টুকরা টুকরা করা হয়েছিল। চাচার আর্তনাদ আর পিশাচদের হাসি। যতো হৃদয় বিদারী চিৎকার, ততো পৈশাচিক আনন্দ। আমাদের এক চাচাতো ভাই আর তার বন্ধুদের মুখ খোলাতে না পেরে পাকসেনারা তাদের পুড়িয়ে মেরেছিলো। আমার আপন বড় খালাকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলো রাজাকাররা। আটদিন বেঁচে ছিলেন আমার খালা, ক্রমাগত ধর্ষণের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি শহিদ হন। তাঁর লাশ আমার নানি নিজের চোখে দেখেছিলেন। রক্তাক্ত নগ্ন শরীর, স্তন বৃন্ত কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে হানাদারগুলো, সিগারেট আর বেয়োনেটের খোঁচা সারা শরীরে।
কতো ঘটনা বলবো? গুলি করে, শরীরের সব রক্ত সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে, গলা কেটে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, জ্যান্ত কবর দিয়ে আমাদের মেরেছিলো পাকসেনা আর তাদের দোসররা। তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে কি পেলে আমাদের মাতৃভূমি? স্বাধীনতা? একে স্বাধীনতা বলে? পাকিস্তানি দানবগুলোর আত্মসমর্পণের পরেও কি একদিনের জন্য মুক্তির স্বাদ অনুভব করেছে এই জাতি?
চলবে।
Views: 13