বিবর্ণ গোধূলি
______মোঃ মশিউর রহমান ভূঁইয়া
আমি রাষ্ট্রের একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। আমার বাড়ি গাড়ি লোক লস্কর মান সম্মান কোনো কিছুর অভাব নেই। সন্তানেরা দেশের বাইরে লেখাপড়া করে। ইচ্ছে হলে মাঝেমধ্যে আসে। ইচ্ছে না হলে আসেনা। আমরা দুজন দেশেই থাকি। চাকরির কারণে আমাকে থাকতেই হয়। তাও আবার প্রতি বৎসর দাপ্তরিক প্রয়োজনের নামে বিদেশ ভ্রমণে যাই। গিন্নীও বছরের বেশিরভাগই বিদেশে সন্তানদের কাছেই থাকে। দেশে আমরা দুজন ভালোই আছি। অফিস শেষে আমি ক্লাবে। গিন্নীও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমাদের আত্মীয়স্বজনের পরিধিটা কম হওয়াতে বাসার উটকো ঝামেলা থেকে মোটামুটি মুক্ত আছি। যে দুচারজন কাছের আত্মীয়স্বজন আছে তারাও গরীব হওয়ার কারণে বাসায় আসার সাহস পায়না। দু একজন সাহস করে এলেও গেট থেকেই দারোয়ান ধমকিয়ে বিদায় করে দেয়। যে একবার গলাধাক্কা খেয়েছে সে আর পারতপক্ষে এমুখি হয়না। কালেভদ্রে কোথাও দেখা হয়ে গেলে অবলীলায় এড়িয়ে যেতে আমার বা আমাদের এতটুকুও লাগেনা। গ্রামের বাড়িতে পারতপক্ষে যাইনা।
আমার কথাগুলো শুনে অনেকে ভাববেন আমি এতো নিষ্ঠুর কেনো! আসলে নিষ্ঠুরতার সংজ্ঞটাই আমার জানা নেই। কারো আচার ব্যবহার কোন পর্যায়ে পৌঁছালে সেটা নিষ্ঠুরতার লেভেলে পৌঁছায় সেই জ্ঞানই তো আমার নেই! বিশ্বাস না হলে শুনুন। আমি আজ যে পর্যায়ে পৌঁচেছি এখানে আসতে আমাকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। আমার জন্ম একেবারে প্রান্তিকেরও নীচে যদি কিছু থাকে সেখানে।
ঠিকানা বলতে আমার কিছু ছিলোনা। গ্রামের শেষ মাথায় একটা বিশাল দীঘি ছিলো। সেটা মূলতঃ খাস বলতে যা বোঝায় সেরকম একটা জায়গায় অবস্থিত। এই দীঘিটার পশ্চিম পাড়েই ছিলো আমাদের ঘর নামক একটা ঠিকানা। চারিদিকে পাটখড়ির বেড়া। চালায় খড়ের বিচালি। দশ বাই দশ একটা কামরা। এর মধ্যেই আমরা দুই ভাই তিন বোন আর বাবা মা সহ থাকতাম। ঘরের ভেতর কোনো চকি জাতীয় কিছুই ছিলোনা। আমরা মেঝেতেই সবাই গাদাগাদি করে ঘুমাতাম। আমাদের কোনো আসবাবপত্র ইত্যাদি ছিলোনা। এলাকার লোকেরা আমাদের এই ঘরটাকে দেখে উপহাসের সুরে বলতো- নারার ছানি তারার বেড়া। শুধুমাত্র রান্নার দু তিনটে মাটির হাড়ি আর খান তিনেক থালা। আর ছিলো পানি রাখার একটা মেটে কলসি৷ এসব নিয়েই ছিলো আমাদের সংসার।
দীঘির পশ্চিম পাশটা ছিলো একেবারে খোলা। উত্তর দক্ষিনে মাইলের পর মাইল ধু ধু ধানের ক্ষেত। মাইল দুয়েক পশ্চিমে দূরে দিগন্ত রেখায় গ্রামের অস্তিত্ব দেখা যেতো। মাঘমাসের ঠান্ডা হিমেল বাতাস হু হু করে পাটখড়ি ঘেরা আমাদের কুটিরে ঢুকে পড়তো। শীতে বস্ত্রহীন আমাদের তখন খুব কষ্ট হতো। আমরা তীব্র শীতে তখন নির্ঘুম রাত কাটাতাম। ভরা বর্ষায়ও একই অবস্থা। বেড়ার ফাঁক গলে চাল চুঁইয়ে বৃষ্টির পানি ঘর ভাসিয়ে দিতো। আমরা না ঘুমিয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতাম। আমাদের কোনো জমিজমা কিছুই ছিলোনা। তাই বাবাকে দিনমজুরি করতে হতো। মা সবসময় অসুস্থ থাকতেন। এই অসুস্থ শরীর নিয়েও মাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হতো। অসুস্থতার কারণে প্রতিদিন কাজেও যেতে পারতেন না। বাবাও বয়সের কারণে খুব একটা মজুরি করতে পারতেননা। বয়স্ক বলে লোকেরা কাজে নিতে চাইতেন না। তখন আমাদের খুব কষ্ট হতো। দিনের পর দিন উপোস থাকতে হতো। তখনকার দিনে গ্রাম অঞ্চলে ভাতের খুব অভাব ছিলো। সম্পন্ন গৃহস্থরাও মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে যেতেন।
বাবা মা যখন আর কাজে যেতে পারতেন না তখন আমরা ক্ষুধার কষ্ট সইতে না পেরে ভাইবোনেরা মিলে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ভাতের ফেন খুঁজতে বেরুতাম। মানুষের হাতে পায়ে ধরে ফেন জোগাড় করে বাড়িতে এনে লবন মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে সবাই খেতাম। মনে আছে গায়ে দেয়ার মতো কোনো জামা পরনের কোনো লুংগি হাফপেন্ট ইত্যাদি আমরা চোখে দেখিনি। তাই বাধ্য হয়ে নেঙটি পরতাম। এই নেঙটিটা ছিলো দু তিন ইঞ্চি প্রসস্ত হাত খানেকের মতো লম্বা এক টুকরো কাপড়৷ যেটাকে দু রানের ফাঁক দিয়ে নাভীর নিচে কোমরের দাঘার সাথে লজ্জা ঢাকার জন্য পেছনের দিকে পেঁচিয়ে পরা হতো। এই নেঙটি পরে গ্রামের মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করতে যেতাম।
এভাবেই কখন কী করে যেনো গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। তারপর হাইস্কুল। এসব বিদ্যালয়ে পড়ার সাথে সাথে ভিক্ষাবৃত্তিও কিন্তু অব্যাহত ছিলো। কারণ এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিলোনা। (চলবে)
Views: 55