আমার আম্মা
_______সেলিনা হোসেন
মানুষের জীবনে সবচেয়ে সংবেদনশীল অনুভব অনুভূতি আর স্পর্শ কাতর সম্পর্ক হল মা এর সাথে সন্তানের। আমরা একটু আঘাত পেলেই মুখ থেকে ওহ মা ” এই শব্দ টা অজান্তে ই বের হয়ে যায়।
৫ ভাই বোন এর মধ্যে আমার অবস্থান ৪ নম্বরে। আমাদের সময়ে বড় ভাই বোন রা মা বাবার মত ছোট ভাই বোন কে আগলে রাখতেন। দেখভাল করতেন।
কারণ যৌথ পরিবারে সন্তান কে নিয়ে আদিখ্যেতা করার মত সময় বা ইচ্ছা অনেক মায়ের ই ছিল না। আর মধ্যবিত্ত পরিবার হলে তো কথা ই নেই।
আব্বা চাকরি করতেন। ৯ টা ৫ টা। ব্যাস। মাসিক বাজার এর লিস্ট থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় খরচ হত আম্মার নিয়মে।
আমার আম্মা খুব ডিসিপ্লিন পছন্দ করতেন। কোন বিলাসিতা বা বাহুল্য খরচ পছন্দ করতেন না।
নিউজপ্রিন্ট আর পাকশির সাদা কাগজ রিম ধরে কিনতেন আব্বা। এটা ও আম্মা র ইচ্ছা। রাফ করবে বাড়িতে কমদামি নিউজপ্রিন্ট কাগজে। স্কুলের পাকা খাতা হবে সাদা কাগজের। শুধু কি তাই? ইয়োথ কালি ; ফাউনটেনপেন ; ডজন খানেক ইকোনো ডিএক্স; পেন্সিল রবার সুতা ; খাতা সেলাই করা ভোমর ; স্ট পলার এর পিন সব একবারই কেনা হবে।
কলম পেন্সিল রবার হারিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না বলে কঠোর আইন ছিল।
টিফিন নিতে হবে ঘরের খাবার। রুটি আলুভাজি বা ডিম কলা এইসব। ভাগ্য ভালো হলে পাউরুটি র মাঝে ডিম ভরা সেই আমলের স্যান্ডউইচ।
তিনবোন কে আম্মা র তৈরি করা এক রকম পোশাক পরতে হত। এমনকি ঈদ পর্বে ও একই ডিজাইন। তবে ঈদের জামা নিউমার্কেট থেকে তৈরি করা হত।
শ্যাম্পু থাকত আম্মার দখলে। আমরা যদি ওয়েস্ট করি!! বলা বাহুল্য আমরা তখন সাবান দিয়ে মাথা ধুইতাম। মাসে একবার হয়ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা হত। কোন অনুষ্ঠান দাওয়াত ইত্যাদি কারণে।
খাবার টেবিলে ও কড়া আইন। ভাত নষ্ট করলে আম্মার রক্তচক্ষু এবং চাপা ঘাই তো আছেই।
মানুষ হিসেবে ছোট বেলা থেকে আমি বড্ড অগোছালো। খাবার টেবিলে গেলে ই বিপত্তি বেশি। ভাত খেতে ইচ্ছে করত না। আমাকে সব ধরনের অসম্মান এর হাত থেকে অতি কৌশলে বাচিয়ে দিতেন আব্বা। আমার ভাতগুলো নিজের প্লেটে নিয়ে বলতেন আমার মেজ মা র রাতগুলো খুব মজা তো। এটা না খেলে পেট ই ভরবে না আমার।
আম্মা বাকা চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে গজ গজ করতেন।
নিয়ম বা বিধি মানা আমার জন্য দুরুহ ছিল। কারণ আমি প্রচুর খেলা প্রিয় ছিলাম। দুপুরে আম্মা একটু ঘুমালে বের হয়ে যেতাম।
গ্রামের ছেলে মেয়ে রা কেউ ই দুপুরে ঘুমাত না। খেলার সাথিরা আমাদের ভাড়া বাসার আশপাশে ঘুর ঘুর করত। কখনও চড়ুইভাতি ; কলার ভেলায় চড়া ; মাছ ধরা দাড়িয়াবাধা খেলা….. ধু ধু করা বিলে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালো লাগত।
ঘড়ি ঘন্টা মাপ ঝোপ নিয়মতান্ত্রিক জীবন বিষাক্ত মনে হত। আম্মা কে মনে হত সৎ মা।
তখন সবাই মা কে তুমি বলে ডাকে। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে শোয়। মা রুপকথার গল্প বলে ; কপালে চুমু খেয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
আমরা আম্মা আব্বা ভাই বোন সবাই কে আপনি করে বলি।আপনি র উপরে যদি কিছু থাকত আম্মাকে তাই হয়ত বলতাম!!!
আমি বুঝতে শিখেই বড় বোনের সাথে ঘুমাই। যদি কখনও জ্বর হত আমার আম্মা পাগলের মতো হয়ে যেতেন। তার সেবা তে জ্বর পালাতো। মাথায় জলপটি জলের ধারা ; বাতাস করা ; হাতে চেপে ছাকনিতে ছেকে আনারসের জুস ; লেবুর শরবত ; আপেল কমলা ঘি য়ে ভাজা পরোটা আম্মা মুখে তুলে খাওয়াতেন।
মনে হত আহা জ্বর এত তাড়াতাড়ি সারল কেন???
পক্স উঠলে আম্মার সে কি আহাজারি আজও কানে ভাসে। রাতভর নিম পাতার বাতাস ; নিমপাতার বিছানা ; আম্মার ফকির মিসকিন খাওয়ানো মানত করা ; মসজিদে টাকা দেওয়া সব কিছু করতেন।
এত প্রচন্ড আবেগ লুকিয়ে প্রচ্ছন্ন কাঠিন্যে আব্বার স্বল্প আয়ে কিভাবে আম্মা ম্যানেজ করতেন?? সব কয়টা ভাই বোনকে লেখা পড়া শিখিয়ে আজ এই অবস্থায় এনেছেন ভাবতে ও পারি না!!!
আজ আম্মা নেই একযুগ হয়ে গেছে। কিন্তু তার সন্তান হিসেবে আমরা তার নীতি নৈতিকতা আদর্শ ত্যাগ যা তার কাছ থেকে শিখেছি
সেই শিক্ষা আমরা লেখা পড়া জানা মা হয়ে ও সন্তানের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি নি।।
Views: 497