একটা স্কুল যার প্রধান ফটক গাছের গুড়ি নির্মিত। যা দেখতে রেল স্টেশনের মতো, ক্লাসরুমগুলো এক একটা বগি। যেখানে বাচ্চাদের বেঞ্চগুলো বদলে গিয়ে হয়েছে যাত্রীদের সিটের মতো। যাত্রীদের ব্যাগপত্র রাখার জায়গাটা দখলে নিয়েছে শিক্ষার্থীদের বই খাতা। তবে সামনে রয়েছে একটা ব্ল্যাক বোর্ড
ক্লাস রুম অথচ সেটার অনুভূতি ভ্রমনের মতো।
…..যে স্কুলের সব বাচ্চারা উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ক্লাস করে বাগানে।
কৃষি বিজ্ঞান শিখতে মাঠে কাজ করে। বাতাসের শব্দের সাথে সংগীতকে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখে ।
….এই স্কুলের টিফিন ঘন্টাতে সবাই একসাথে টিফিন করে হলঘরে। যা বগি সদৃশ্যক্লাস রুম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে সবাই গোল হয়ে ডেস্কে বসে । প্রধান শিক্ষক টিফিনবক্সে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে জিগাসা করে আজ কি সবাই কিছু সমুদ্রের আর কিছু পাহাড়ের খাবার এনেছো?
…..স্কুলটিতে একটা নৌকার মত পুকুর আছে। যেটা বগি ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে দেখা যায়। অর্থাৎ ক্লাসরুম আর হলরুমের মাঝে সেই পুকুরটা। যেখানে নিদৃষ্ট দিনে পানি ভরা হয় অন্যদিনে শুকনো থাকে মাঠের মতো। যেদিন পুকুরে পানি ভরা হয় সেদিন স্কুলের সব বাচ্চারা সাঁতার শিখে সাঁতারের টিচারের কাছে।
…সংগীতের ক্লাসে তারা ইচ্ছামতো পা ফেলতো তালে তালে , তাদের চলার ভঙ্গিকে সুন্দর করতে। নদীর কাছে গিয়ে শিখতো নদীর কুলকুল ভাষা, ফুলদের কাছে গিয়ে জানতো ভ্রমর কেন আসে তাদের কাছে, উড়ে যাওয়া পাখিদের দেখে শিখতো আকাশের বিশালতা।
…. যে স্কুলটাতে একজন চঞ্চল, ভুলোমনা, আনাড়ী, স্কুল বহিষ্কৃত ভ্রু কুচকানো তাচ্ছিল্যের পাত্র একটা শিশুকেউ খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। সে কেবই একটা শিশু হবার পারও তার অগোছালো এলোমেলো কথা গুলো ঘন্টার পর ঘন্টা শোনা হয়।
চোখ বন্ধ করে প্লিজ একটিবার নিজের শৈশবে ফিরে যান। যদি এমন একটা স্কুল পেতেন তবে কেমন লাগতো?
নিশ্চয় খুব চমৎকার অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে। সত্যি সত্যিই এই স্কুলটা এই পৃথিবীতে ছিলো। জাপানের টোকিওতে। স্কুলটির নাম ” তোমায়ে গাকুয়েন বিদ্যালয় ” এই স্কুলটি যিনি প্রতিষ্ঠিত করেন তার নাম কোবাইয়াশী।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই বইটার লেখক তেৎসুকো নিজেই ছিলেন সেই স্কুলের স্টুডেন্ট এবং অন্য স্কুল থেকে বহিষ্কৃত। এই বইয়ের লেখাগুলো ধারাবাহিক ভাবে একটি পত্রিকাতে বের হতো। তারপরই পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে এমন একটা স্কুলের কথা। যা তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর তেৎসুকো এটিকে বই আকার প্রকাশ করে। যা জাপানের ইতিহাসে একটা অশ্চর্যজনক ঘটনার জন্ম দেয়। বইটা প্রথম বছরেই ৪৫ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। অনূদিত হয় নানান ভাষাতে।
তোমায়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সব সময়ই খুব তেতো একটা কথা বলতেন, শিশুরা জন্মায় খুব ভালো মানুষ হিসাবে, কিন্তু বড়দের কুপ্রভাব তাদের স্বভাব বদলে দেয়। তাই শিশুদের সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষ হিসাবে চিন্তা করতে দেওয়াই মানবিক শিক্ষাব্যবস্থার মূল।
যিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ ও সংগীত বিশেষজ্ঞ । তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আর শিশুরা হলো ফুলের মতো। যাকে জোড় করে ফোটানো সম্ভব নয় বরং বিকশিত হতে দিতে হয়।
শিশুকে শিশুদের মতো করে ভাবতে সাহায্য করতে হবে বড়দের।
তাদেরকে প্রতিটি মুহুর্তে এমন মনে করানোর কোন দরকার নেই যে সে ছোট তাই সে গুরুত্বপূর্ণ নয় কিংবা বড় হওয়াটাই জীবনের সবকিছু!!
ছোটদের প্রতিটি কাজেকে অর্থহীন মনে করাটা বোকামী । এরা ভালোবাসে রাস্তার ছোট পাথরকে, উড়ে আসা হাঁসের পালককে। জমিয়ে রাখে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোকে তাদের এই মায়ার জায়গা এগুলোকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত বড়দের।
গত তিন বছর ধরে এই বইটা আমি নিয়মিত পড়ে চলেছি। কতবার পড়েছি তা বলা অসম্ভব। কারন বইটা আমার বেডরুমের মাথার কাছে থাকে আর অফিসরুমের ডেস্কে। ক্লাসে যাবার আগেও দুই পাতা পড়ে কখনও কখনও যাই আমি। এই বইটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষকের অবশ্যই পড়া উচিত। তাহলে সে বুঝতে পারবে সে শিশুদের জন্য কত গুর্তুত্বপূর্ন একজন।
প্রতিটি শিশুর পিতামাতার পড়া উচিত তাহলে তাদের শিশু পাবে একটি নিরাপদ বাবা মা এবং মানবিক আশ্রয়স্থল যেখানে আপনার সন্তানকে আপনি ভয় দেখিয়ে নয় বরং ভালোবেসে বুঝিয়ে সবটা শিখাতে পারবেন। আবার সবকিছুই যে আপনার সন্তানের জন্য জরুরী নয় তাও অনুভব করতে পারবেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য এই তোমায়ে স্কুলটি বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তবে থেকে গেছে তেৎসুকোর মতো কিছু মানুষ যারা বড় হয়ে কেউ হয়েছে বিজ্ঞানী, কেউ কবি, কেউ লেখক কেউবা সংগীত বিশেষজ্ঞ।
বইয়ের নামঃ তোত্তোচান
লেখকঃ তেৎসুকো কুরোয়ানাগী
অনুবাদকঃ চৈতী রহমান
দামঃ ২৫০টাকা
পরিবেশকঃ দ্যু প্রকাশনী
ইহা একখানা জাপানী বই। যা ১৯৮১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
#বুকরিভিউ
লিখছেন সুমেরা জাহান
Views: 45